কথা বলতে বলতেই পলাশ কিছুটা ক্ষেপে যায়। যে দেশে নিজের বাংলাভাষাই ঠিক রাখা যায় না সেখানে আবার আদিবাসীদের ভাষা। দেশের প্রতি এক প্রকার দায়িত্ববোধ থেকেই হতাশা নিয়েই কথাগুলো বলে সে। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের ছাত্র পলাশের কথাগুলো একেবারেই অমূল নয়। বাংলাভাষাকে রক্ষার জন্য প্রাণ দিতে হয়েছিল সালাম, বরকত, রফিক, শফিক, জব্বারদের। অথচ এদেশেরই গণমাধ্যমগুলোতে এখন বিকৃত করা হচ্ছে বাংলাভাষাকে। সস্তা বিনোদনের প্রলোভনে ভাষা বিকৃত হচ্ছে নানা ঢংয়ে। সেগুলো প্রচার হচ্ছে নাটক আর নানা অনুষ্ঠানের মাধ্যমে। আর বেসরকারি রেডিওর আরজেদের কথা তো বাদই দিলাম। এ সকল বিনোদনের গোলক ধাঁধায় যেন হুমড়ি খেয়ে পড়েছে সবাই। বাংলাভাষাকে এক বিকৃত ঢংয়ে বলার প্রবণতা সহজেই ছড়িয়ে পড়েছে তরুণ আর যুবকদের মুখে মুখে। ফলে নিঃশব্দে বিকৃত হচ্ছে রক্ত দিয়ে পাওয়া প্রিয় মাতৃভাষা বাংলা।
আমাদের ভাষা আন্দোলনের ইতিহাসটি আজ ছড়িয়ে পড়েছে সারা বিশ্বে। ২১ ফেব্রুয়ারি তারিখটি সারা বিশ্ব উদ্যাপন করে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে। কিন্ত দুঃখের বিষয় এই ভাষা আন্দোলনের দেশেই আদিবাসী শিশুরা বঞ্চিত হচ্ছে নিজের মাতৃভাষায় শিক্ষালাভ থেকে। এ যেন মোমবাতির নিচের অন্ধকারের মতো অবস্থা।
এ বছরে পঞ্চম শ্রেণীর প্রাক সমাপনী পরীক্ষা দেখতে গিয়েছিলাম দিনাজপুরের আদিবাসী এলাকার কেন্দ্রগুলোতে। কালিয়াগঞ্জ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় কেন্দ্রটি ছিল একেবারে সীমান্ত ঘেঁষা। এ এলাকাটিতে মূলত নানা আদিবাসীদের বাস। শালবনকে ঘিরে পাড়া ভেদে বাস করছে আদিবাসী সাঁওতাল, মুন্ডা পাহান, ওঁরাও, ভুনজার, কড়া আর তুরি সম্প্রদায়ের আদিবাসীরা। ফলে আদিবাসীদের সংখ্যাই বেশি। পরীক্ষা কেন্দ্রের সচিবের দায়িত্বে থাকা ঐ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক জানালেন পরীক্ষায় অংশগ্রহণকারীদের সংখ্যাটি। কেন্দ্রটিতে ৩৩৯জন ছাত্র-ছাত্রীর মধ্যে ঐ কেন্দ্রে আদিবাসী শিশু পরীক্ষা দিচ্ছে মাত্র ১০জন। এদের মধ্যে ৭ জনই সাঁওতাল আর বাকিরা অন্যান্য সম্প্রদায়ের। আদিবাসী এলাকা হওয়া সত্ত্বেও আদিবাসী শিশুদের এমন রুগ্ন অংশগ্রহণ আমাদের অবাক করে।
টিফিন বিরতির পরই শুরু হবে ধর্ম পরীক্ষা। এই ফাঁকে কথা চলে তাদের সঙ্গে। জানা গেল দুজন বাদে এদের অধিকাংশ পরিবারই ধর্মান্তরিত হয়ে ইতোমধ্যেই খ্রিস্টান ধর্ম গ্রহণ করেছে। এরপর কি পরীক্ষা? প্রশ্ন করতেই একযোগে উত্তর, ‘ধর্ম’। অবাক বিষয় হলো ধর্মান্তরিত হওয়া পরিবারের শিশুরাও পরীক্ষা দিচ্ছে হিন্দু ধর্মের প্রশ্নে। অভাবের কারণে ধর্মান্তরিত হলেও শিশুদের মন থেকে তখনো বিলীন হয়নি তাদের চিরচেনা সনাতন হিন্দু রীতি।
মুন্ডা পাহান সম্প্রদায়ের সুদেব পাহানের জন্য টিফিন নিয়ে এসেছে তার বাবা খোসকা পাহান। তার বাড়ি গোদাবাড়ী গ্রামে। একেবারে সীমান্ত ঘেঁষা প্রত্যন্ত অঞ্চলে। তিনি জানলেন সুদেব পাহানের শিক্ষা নিয়ে নানা তথ্য।
চরম দারিদ্র্যতার মাঝে টিকে আছে গোদাবাড়ী গ্রামের ২০টি মুন্ডা পাহান পরিবার। এরা কথা বলে আদিবাসী সাদরী ভাষায়। মুন্ডা ভাষায় মায়ের ঘুম পাড়ানি গান আর বাবার বকুনি খেয়েই বেড়ে ওঠে সুদেব। পূজার উৎসবে আদিবাসী গানের তালে নেচে গেয়ে আনন্দের ছোঁয়ায় বড় হয় সে।
সুদেবের বয়স যখন ছয় তখন স্কুলে যেতে বাদসাধে তার বাবা। বাবা খোসকা পাহানের ইচ্ছা ছেলে কাজে যাবে তার সঙ্গে। ফলে সংসারে বাড়তি আয় আসবে। সংসার ভালো চলবে। কিন্ত সুদেবের মায়ের স্বপ্ন ভিন্ন। তার ছেলে শিক্ষিত হয়ে বড় হবে। কেউ তাকে ঠকাতে পারবে না। সুদেব আলো জ্বালাবে পাহান গ্রামে। পাহান জাতির সম্মান বাড়বে। স্ত্রীর সঙ্গে মনোমালিন্যের এক পর্যায়ে সুদেবকে স্কুলে যাওয়ার সম্মতি দেয় খোসকা পাহান। বুক ভরা আশা নিয়ে সুদেবকে ভর্তি করা হয় স্থানীয় প্রাইমারী স্কুলে।
প্রথম দিনেই সুদেবের কচি মনের হাসি-আনন্দ উবে যায়। তার মনে জায়গা করে নেয় অজানা আতঙ্ক। যে মুন্ডা ভাষায় হেসে খেলে সে বড় হয়েছে। সুদেব দেখলো সে ভাষার প্রচলন নেই তার স্কুলে। এমনকি ঐ ভাষা জানা কোন শিক্ষকও নেই। ফলে তার ওপর আরোপ হয় অজানা এক বাংলা ভাষা। যার সে কিছুই বুঝে উঠতে পারে না। স্কুলের বাঙালি শিক্ষকদের পক্ষেও সম্ভব হয় না তাকে বোঝানো।
এভাবেই চলতে থাকে কয়েকদিন। একে তো ভাষার ভীতি তার ওপর ক্লাসের বন্ধুদের আচরণে সুদেব একেবারেই মুষড়ে পড়ে। আদিবাসী বলে তাকে বসতে হয় আলাদা এক বেঞ্চিতে। কেউ তার সঙ্গে বন্ধুত্ব করতে চায় না। সবাই তাকে আড়চোখে দেখে।
সুদেবের বাবা-মা লেখাপড়া না জানায় তাদের পক্ষেও সম্ভব হয় না সুদেবকে সাহায্য করা। ফলে নানা ভীতি ভর করে সুদেবের মনে। স্কুলে যাওয়া তার কাছে রীতিমতো আতঙ্কের বিষয় হয়ে দাঁড়ায়। ফলে প্রথম পরীক্ষায়ই ফেল করে সে। স্কুলের দুর্বল ছাত্রের তালিকায় নাম ওঠে তার। কেউ বুঝতে পারে না সুদেবের পিছিয়ে পড়ার কারণ। ক্রমেই সুদেব হারিয়ে ফেলে স্কুলে যাওয়ার আগ্রহ।
মা ভারতীয় পাহান সুদেবকে ভর্তি করে দেয় নিকটবর্তী একটি ব্র্যাক স্কুলে। যেখানে শিক্ষক হিসেবে ছিল আদিবাসী একজন। তিনি সুদেবকে তার মাতৃভাষায় সব বোঝাতে থাকেন। মাতৃভাষার ছোঁয়ায় সুদেবের ভীতি ক্রমেই কেটে যেতে থাকে। ক্রমেই অন্য ভাষাকে আয়ত্ত করতেই সুদেব হয়ে ওঠে ক্লাসের সবচেয়ে মেধাবী ছাত্র। এভাবেই সুদেব পার করে দেয় ৪টি ক্লাস। আজ সে পঞ্চম শ্রেণীর প্রাক সমাপনী পরীক্ষা দিচ্ছে। সুদেবের একই ঘটনাটিতে গোটা বাংলাদেশের আদিবাসী শিশু শিক্ষার একটি নমুনা পাওয়া যায়। হয়ত এভাবেই সারাদেশে আদিবাসী শিশুদের শিক্ষা আজ এনজিওদের হাতে চলে এসেছে। আর সরকার একেবারেই নিশ্চুপ।
দিনাজপুরের আরেক প্রত্যন্ত অঞ্চল ঝিনাইকুড়ি। সেখানে রয়েছে আদিবাসী কড়া সম্প্রদায়ের লোকেরা। ঝিনাইকুড়িতে যাওয়ার ভঙ্গুর পথই বলে দেয় গ্রামের কর্তাব্যক্তিদের নজর পড়েনি এখানটায়। অথচ এই ঝিনাইকুড়িতেই কোনো রকমে টিকে আছে আদিবাসী কড়া সম্প্রদায়ের মাত্র ১৬টি পরিবার। এ গ্রামে আদিবাসী শিশু রয়েছে ২৫টির মতো। এ বয়সে যাদের স্কুলে যাওয়ার কথা। অথচ বাবা-মার সঙ্গে তারা ছুটছে কাজের সন্ধানে।
কড়া সম্প্রদায়ের একমাত্র শিক্ষিত যুবক কৃষ্ণ কড়া। সে পড়েছে ৮ম শ্রেণী পর্যন্ত। কৃষ্ণ জানাল, কিছুদিন আগেও তাদের গ্রামে আরডিআরএস নামক একটি এনজিওর শিশু শিক্ষা কেন্দ্র ছিল। কৃষ্ণ নিজেই শিক্ষক হিসেবে সে স্কুলে বাচ্চাদের পড়াতেন। এনজিওদের প্রকল্পভিত্তিক মারপ্যাঁচে হঠাৎ করেই স্কুলটিকে সরিয়ে নেয়া হয় অন্যগ্রামে। ফলে কড়া শিশুরা পড়ে থাকে নিরক্ষরতার আধারে। এভাবেই শিক্ষা বঞ্চিত হয় আদিবাসী শিশুরা।
শিক্ষার অধিকার মানুষের স্বীকৃত একটি মৌলিক অধিকার। এ অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য জাতিসংঘের আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা ১৯৫৭ সালের ৫ জুন ৪০তম অধিবেশনে ১০৭নং কনভেনশনে আদিবাসী ও উপজাতীয় ভাষা বিষয়কে প্রাধান্য দিয়ে কিছু নীতিমালা তৈরি করে এবং এ কনভেনশনে বাংলাদেশ স্বাক্ষরকারী অন্যতম দেশ।
কনভেনশনের অনুচ্ছেদ ২১-এ উল্লেখ রয়েছে, ‘সংশ্লিষ্ট জনগোষ্ঠীর সদস্যদের জাতীয় জনসমষ্টির অবশিষ্ট অংশের সঙ্গে সমতার ভিত্তিতে সকল স্তরে শিক্ষা অর্জন করার সুযোগ নিশ্চিত করতে হবে।’
অনুচ্ছেদ ২৩(১)-এ উল্লেখ রয়েছে, ‘সংশ্লিষ্ট জনগোষ্ঠীর ছেলেমেয়েদের তাদের মাতৃভাষায় পড়তে ও লিখতে শিক্ষাদান করতে হবে। কিংবা যেখানে এটা সম্ভব নয়, সেখানে তাদের সমগোত্রীয়দের মধ্যে সাধারণভাবে বহুল প্রচলিত ভাষায় শিক্ষাদান করতে হবে।’
অনুচ্ছেদ ২৩(২)-এ উল্লেখ রয়েছে, ‘মাতৃভাষা বা আদিবাসী ভাষা থেকে জাতীয় ভাষা কিংবা দেশের একটি অফিসিয়াল ভাষায় ক্রমান্বয়ে উত্তরণের জন্য ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।’
এ ছাড়াও বাংলাদেশ সরকার স্বাক্ষরিত ‘আন্তর্জাতিক শিশু অধিকার সনদ’-এর ৩০ নং ধারায় উল্লেখ রয়েছে, যে সব দেশে জাতিগোষ্ঠীগত, ধর্মীয় কিংবা ভাষাগত সংখ্যালঘু কিংবা আদিবাসী সম্প্রদায়ের লোক রয়েছে, সেসব দেশে ঐ ধরনের সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ভুক্ত বা আদিবাসী শিশুকে সমাজে তার নিজস্ব সংস্কৃতি ধারণ, নিজস্ব ধর্মের কথা ব্যক্ত ও চর্চা করা, তার সম্প্রদায়ের অপরাপর সদস্যদের সঙ্গে ভাষা ব্যবহার করার অধিকার থেকে বঞ্চিত করা যাবে না।’
এদেশে চুক্তিগুলো পড়ে থাকে কাগজের ভাঁজে। ফলে নানা ভাষাভাষির আদিবাসীদের মাঠে নামতে হয় নিজেদের মাতৃভাষাকে টিকিয়ে রাখতে, মাতৃভাষায় শিক্ষালাভের জন্য। এ বড়ই পরিতাপের বিষয়।
সরকার সবার জন্য শিক্ষা নিশ্চিত করতে নানামুখী প্রচেষ্টা চালাচ্ছে। সব শিশুর জন্য প্রাথমিক শিক্ষাকে বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। অথচ মাত্র দুই-তৃতীয়াংশ আদিবাসী শিশু স্কুলে যায়। যাদের মধ্যে বড় একটি অংশ অল্প সময়ের মধ্যেই ঝরে পড়ে। তাই প্রয়োজন আদিবাসীদের ভাষাকে টিকিয়ে রাখার উদ্যোগ গ্রহণ করা। একই সঙ্গে আদিবাসী শিশুদের মাতৃভাষায় শিক্ষাদান, আদিবাসী এলাকায় বিদ্যালয় স্থাপন, আদিবাসী এলাকার স্কুলগুলোতে বাধ্যতামূলভাবে আদিবাসী শিক্ষক নিয়োগ প্রভৃতি। এই উদ্যোগগুলো বাস্তবায়নে প্রয়োজন শুধুই সরকারের আন্তরিকতা।
আমরা চাই না সুদেব পাহানের মতো আদিবাসী শিশুদের ‘পিছিয়ে পড়া’ বলে অপবাদ দিতে। আমরা চাই রক্ত দিয়ে মাতৃভাষা বাংলাকে টিকিয়ে রাখার গৌরবময় এই দেশে আদিবাসী শিশুরা শিক্ষালাভ করুক তার চিরচেনা মায়ের ভাষায়।
ছবি: সালেক খোকন
লিখাটি প্রকাশিত হয়েছে সাপ্তাহিকে ২১ অক্টোবর ২০১০
© 2011 – 2018, https:.