মনকথা

মাহী কাজী : বাংলাদেশে মেডিটেশন চর্চার পথিকৃত

আরিফ সাহেবের দুই মেয়ে, এক ছেলে। ছেলে পড়ে ক্লাস সেভেনে। পেশায় একজন সরকারী চাকুরে। থাকেন মোহাম্মদপুরে। আয় একেবারে সীমিত। তা দিয়ে বাড়ী ভাড়া আর ছেলেমেয়েদের পড়াশুনার খরচ চালানো কষ্টকর। প্রতিমাসেই ধার কর্জ করে চলতে হয়। সন্তানদের ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে হরহামেশাই ফেলেন দীর্ঘশ্বাস। এরই মধ্যে দেখা দেয় হার্টের রোগ। রোগের কথা শুনেই আরিফ সাহেব যেন আরো ভেঙ্গে পরেন। রাজ্যের দুঃচিন্তা ভর করে তার মনে। নিকট আত্মীয়রা একে একে দেখতে আসে তাকে। নামকরা সব ডাক্তার দেখিয়েও কোন ফল হয় না। সবার একই কথা টেনশন ফ্রি থাকতে হবে। কিন্ত কিভাবে তা সম্ভব? কেউ বলতে পারে না। প্রেসার কিংবা ঘুমের ঔষধ খেলে কি টেনশন কমে? পরিবারের নানা সমস্যায় চিন্তা না করে কি থাকা যায়?
উপরের ঘটনাটি রূপক অর্থে লিখা। শরীর কি মন কে নিয়ন্ত্রণ করে, নাকি মন নিয়ন্ত্রণ করে শরীরকে। মন আগে, নাকি শরীর। এরকম নানা প্রশ্ন কখনও কখনও ভর করে আমাদের মনে। আজ থেকে প্রায় পচিশ বছর আগে এদেশের মানুষও জনতো না মনের শক্তির কথা। জানতো না মনকে নিয়ন্ত্রণে রেখে শরীরকে ঠিক রাখার কায়দা কানুন। মনকে নিয়ন্ত্রণ করার বা মেডিটেশন পদ্ধতি শিখার কোন ব্যবস্থাও ছিলনা তখন। মনকে নিয়ন্ত্রণে রেখে লক্ষ্যে পৌছানোর পদ্ধতি বাঙালিদের মাঝে প্রথম নিয়ে আসেন যিনি তিনিই প্রয়াত মাহী কাজী।

মানিকগঞ্জের কাজী পরিবারের কৃতি ও প্রতিভাবান ছেলে মাহী কাজীর পুরো নাম ছিল আব্দুল হামিদ কাজী। ১৯৫৬ সালে তিনি তৎকালীন আহসান উল্লাহ ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ (বর্তমান বুয়েট) থেকে ইঞ্জিনিয়ারিং পাশ করেন। ১৯৬৪ সালে আইবিএম কোম্পানী কর্তৃক উপমহাদেশের দুইজন কম্পিটার প্রশিক্ষকের মধ্যে তিনি অন্যতম। তার তত্ত্বাবধানে বাংলাদেশে আণবিক শক্তি গবেষনা কেন্দ্রে সর্বপ্রথম কম্পিউটার স্থাপিত হয়।02প্রাচীনকাল থেকেই মন নিয়ন্ত্রণের বিভিন্ন পদ্ধতির প্রচলন ছিল। ভারত মহাদেশে ছিল এর আদি চর্চা। পরবর্তীতে আমেরিকার টেক্সাস লরেডো শহরে মননিয়ন্ত্রণের আধুনিক ও ডাইনামিক পদ্ধতির প্রবর্তন করেন হোঁজে সিলভা নামক স্পেনিশ বংশভুত এক ব্যক্তি। তিনি দীর্ঘ ২২ বছর মন নিয়ে গবেষণা করে ১৯৬৬ সাল থেকে প্রথম মন নিয়ন্ত্রণ বিষয়ক বেসিক লেকচার সিরিজ কোর্সের প্রশিক্ষণ প্রদান শুরু করেন।

হোঁজে সিলভা তার আবি®কৃত পদ্ধতিতে মানুষের ব্রেইন ফ্রিকোয়েনন্সি নিয়ন্ত্রণে রেখে শরীরিক ও মানসিকভাবে সুস্থ্য থাকার কথা বলেছেন। ব্রেইন ফ্রিকোয়েনন্সি প্রতি সেকেন্ডে ১৪ বা তদূর্ধ্ববার স্পন্দিত লেভেলকে ‘বিটা’  লেভেল বলা হয়। এই লেভেলে ব্রেইন ফ্রিকোয়েনন্সি যত বাড়তে থাকে মানুষের শরীরে তত ইনব্যালেন্সি তৈরী হতে থাকে। মানুষ তখন হয়ে ওঠে অস্থির ও উত্তেজিত। এভাবেই এক সময় সে আর নিজেকে ধরে রাখতে পারে না। তাই বিটা লেভেলে মানুষ ঘটায় নানা অঘটন। টেনশনের সময়ও মানুষের ব্রেইন ফ্রিকোয়েনন্সি একইভাবে বেড়ে যায়। এতে ঘটে স্ট্রোক ও হার্ট এ্যাটাকের মতো ঘটনা। তাই শারীরিক ও মানসিক সুস্থ্যতার জন্য মানুষের ব্রেইন ফ্রিকোয়েনন্সি নিয়ন্ত্রণে রাখা একান্ত প্রয়োজন।

পেশাগত কারণে মাহী কাজী যুক্তরাজ্যে গেলে সেখানেই পরিচিত হন সিলভা মেথডের সংগে। সরাসরি হোঁজে সিলভা থেকে উন্নত প্রশিক্ষণ গ্রহণ করে ক্যামব্রিজ শহরে সিলভা মেথড এর প্রশিক্ষক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন বেশ কিছুদিন। ১৯৯০ সালের শেষের দিকে মাহী কাজী দেশে ফিরে আসেন এবং বাংলাদেশে সর্বপ্রথম মন নিয়ন্ত্রণ বিষয়ক সিলভা মেথড শেখাতে শুরু করেন।

সে থেকেই শুরু। উন্নত বিশ্বের মতো এ দেশের মানুষের মধ্যেও আজ সচেতনতা বেড়েছে, বেড়েছে রোগ নিরাময়ের প্রয়োজনে যত্রতত্র ঔষধ গ্রহণ না কারার প্রবণতা। ঔষধের পার্শ্বপ্রতিক্রয়া থেকে বাঁচতে মানুষ নির্ভর করছে নানা ধরণের বিকল্প চিকিৎসা পদ্ধতির ওপর। পৃথিবীর প্রায় ১২০টি দেশের মতো এ দেশেও চলছে মনকে নিয়ন্ত্রণ করে শারীরিক ও মানসিকভাবে সুস্থ্য থাকার বিভিন্ন পদ্ধতির চর্চা। মন নিয়ন্ত্রণ বা মেডিটেশন চর্চা করছেন হাজার হাজার মানুষ।
বর্তমানে বাংলাদেশে মননিয়ন্ত্রণের প্রশিক্ষণ দিচ্ছে বেশ কয়েকটি প্রতিষ্ঠান। তৎমধ্যে সিলভা আলট্রামাইন্ড কোর্সটির আয়োজন করে এম কিউ (মাহী কাজী) মিশন। যার প্রশিক্ষক হিসেবে দায়িত্ব পালণ করছেন মাহী কাজীর ঘনিষ্ট সহচর সৈয়দ হারুন। এছাড়া বহুল প্রচলিত কোয়ান্টাম মেথড এর প্রবর্তক মহাজাতক শহীদ আল বোখারী এবং স¤প্রতি চালু হওয়া ক্রিয়েটিভ মেডিটেশন এর প্রবর্তক ড.হাসান ও আইসোমেট্রিক সহ এদেশে যতগুলো মন নিয়ন্ত্রণের মেথড চালু রয়েছে তাদের প্রায় সবাই মাহী কাজীর কাছ থেকেই প্রথম সিলভা মেথড কোর্সের প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেছেন।

আমাদের প্রত্যেকেরই ব্যক্তিগত, পারিবারিক ও সামাজিক জীবনে রয়েছে নানা সমস্যা। প্রত্যেকেই চাই এই সমস্যাগুলোর শান্তিময় সমাধান। চাই রোগহীন চিন্তামুক্ত জীবন। না পাওয়ার বেদনা আমাদেরকে করে তুলে অস্থির। ফলে আমরা ধীরে ধীরে হারিয়ে ফেলি নিজের প্রতি আত্মবিশ্বাসটুকু। অপরের ভাল ও  কল্যাণের কথা চিন্তা করার মানসিক সক্ষমতা আমাদের মাঝে লোভ পাচ্ছে প্রবলভাবে। ক্রমেই ম্লান হয়ে যাচ্ছে মানবতার বোধটুকু। তাই মনকে নিয়ন্ত্রণ করে নিজের দৃষ্টিভাঙ্গিটাকে বদলানো এখন সময়ের ব্যাপার মাত্র।

মাহী কাজী পরলোক গমন করেন ৪ জানুয়ারী ২০০৭ সনে। রেখে যান  মানবতাবোধ সম্পন্ন হাজার হাজার অনুসারীকে। এদেশে মেডিটেশন চর্চার ইতিহাসে মাহী কাজী স্বর্ণাক্ষরে লিখা একটি নাম। তাই শ্রদ্ধার সাথে স্মরি তাঁকে।

লিখাটি প্রকাশিত হয়েছে সচলায়তন ব্লগে ৪ জানুয়ারি ২০১১

© 2011 – 2018, https:.

এই ওয়েবসাইটটি কপিরাইট আইনে নিবন্ধিত। নিবন্ধন নং: 14864-copr । সাইটটিতে প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো তথ্য, সংবাদ, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করলে আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।

Show More

Salek Khokon

সালেক খোকনের জন্ম ঢাকায়। পৈতৃক ভিটে ঢাকার বাড্ডা থানাধীন বড় বেরাইদে। কিন্তু তাঁর শৈশব ও কৈশোর কেটেছে ঢাকার কাফরুলে। ঢাকা শহরেই বেড়ে ওঠা, শিক্ষা ও কর্মজীবন। ম্যানেজমেন্টে স্নাতকোত্তর। ছোটবেলা থেকেই ঝোঁক সংস্কৃতির প্রতি। নানা সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠনের সঙ্গে জড়িত। যুক্ত ছিলেন বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র ও থিয়েটারের সঙ্গেও। তাঁর রচিত ‘যুদ্ধদিনের গদ্য ও প্রামাণ্য’ গ্রন্থটি ২০১৫ সালে মুক্তিযুদ্ধ ভিত্তিক মৌলিক গবেষণা গ্রন্থ হিসেবে ‘কালি ও কলম’পুরস্কার লাভ করে। মুক্তিযুদ্ধ, আদিবাসী ও ভ্রমণবিষয়ক লেখায় আগ্রহ বেশি। নিয়মিত লিখছেন দেশের প্রথম সারির দৈনিক, সাপ্তাহিক, ব্লগ এবং অনলাইন পত্রিকায়। লেখার পাশাপাশি আলোকচিত্রে নানা ঘটনা তুলে আনতে ‘পাঠশালা’ ও ‘কাউন্টার ফটো’ থেকে সমাপ্ত করেছেন ফটোগ্রাফির বিশেষ কোর্স। স্বপ্ন দেখেন মুক্তিযুদ্ধ, আদিবাসী এবং দেশের কৃষ্টি নিয়ে ভিন্ন ধরনের তথ্য ও গবেষণামূলক কাজ করার। সহধর্মিণী তানিয়া আক্তার মিমি এবং দুই মেয়ে পৃথা প্রণোদনা ও আদিবা।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

Back to top button