ছড়া গানে সাঁওতাল বিদ্রোহ
সকাল হতেই ঝুম বৃষ্টি। ঘন মেঘের আড়ালে মুখ লুকিয়েছে সূর্যটা। তবু দিনাজপুরের চনকালি মাঠে ভিড় জমিয়েছে আদিবাসীরা। হাতে হাতে ফুলের তোড়া। কিন্তু নামিদামি কোনো ফুল নেই তাতে। অচেনা ফুলের মধ্যে মুখ তুলে আছে কয়েকটি জবা। মাঠের পাশে ছোট্ট একটি স্মৃতিসৌধ। তাতে একে একে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানাচ্ছে সব বয়সী আদিবাসীরা। স্মরণ করছে সিদু-কানুকে।
মূলত এটি একটি সাঁওতাল গ্রাম। প্রতি ৩০ জুনেই আদিবাসী এ গ্রামে চলে এ রকম আয়োজন। সাঁওতালরা নিজেদের সানতাল বলতেই পছন্দ করে। তাই তাদের কাছে দিনটি সানতাল বিদ্রোহ দিবস। অনেকের কাছে এটি সিদু-কানু দিবস।
শ্রদ্ধা শেষে শুরু হয় কলাগাছে তীরবিদ্ধ করার খেলা। নানা ঢঙে তীর ধনুক নিয়ে সব সম্প্রদায়ের আদিবাসীরাই অংশ নেয় খেলাটিতে। একটি শেষে শুরু হয় অন্য আরেকটি খেলা। চোখ বেঁধে হাঁড়িভাঙা খেলা। এটি সাঁওতালদের ঐতিহ্যবাহী এক খেলা। কলাগাছে তীরবিদ্ধ ও লাঠি দিয়ে হাঁড়িভাঙাকে এরা অপশক্তির প্রতীকী বিনাশ বলে মনে করে।
হঠাৎ মুষলধারে বৃষ্টি শুরু হয়। খেলা থামিয়ে সবাই ছুটে পালায় মাঠ থেকে। কেউ বটের তলায়। কেউ আশ্রয় নেয় রাস্তার পাশে। দোকানের ছাউনিতে। মাঠের পাশের একটি বাড়িতে আশ্রয় হয় আমাদের।
এখানকার আদিবাসী সমিতিটি প্রতিবারই ঘটা করে পালন করে সিদু-কানু দিবসটি। সমিতির সভাপতি বিমল মার্ডী তেমনটিই জানাল। বিমল পড়াশোনা করেছেন এইচএসসি পর্যন্ত। পরিবারে বাবা মা ধর্মান্তরিত না হলেও বছর দুয়েক আগে সে গ্রহণ করেছে খ্রিষ্টান ধর্ম। আদিবাসীদের আন্দোলন সংগ্রাম বিষয়ে বেশ ভালো তথ্য জানে সে। মিশন থেকে আনা বই সমৃদ্ধ করেছে তার ভাণ্ডারকে। বৃষ্টির সময়টাতে বিমলের সঙ্গে সিদু-কানুকে নিয়ে আলাপ জমে আমাদের। বিমল আগ্রহ নিয়ে বলতে থাকে ইতিহাসের নানা তথ্য।
সাঁওতালরা সে সময় জঙ্গল কেটে চাষাবাদের জমি তৈরি করত। সে জমিতে চোখ পড়ে কোম্পানির অনুগত জমিদারদের। সাঁওতালরা মেহনত করে ফসল ফলাত কিন্তু ব্যাপারি আর মহাজনরা সামান্য দেনার অজুহাতে তাদের ঠকাত। ফলে সাঁওতাল কৃষকদের দেনা কখনই শেষ হতো না। দেনা পরিশোধের জন্য অনেক সাঁওতালকে মহাজনের বাড়িতে পরিবারসহ গোলামি করতে হতো। সাঁওতালরা আদালত আর পুলিশ থেকেও কোনো সাহায্য পেত না। বরং তারা কাজ করত শোষক শ্রেণীর স্বার্থে। এতে ক্রমেই সাঁওতালদের মধ্যে চাপা ক্ষোভ দানা বাঁধতে থাকে। ফলে সাঁওতালরা জমিদার, মহাজন আর সরকারকে তাদের শত্রু ভাবতে থাকে।
বলতে বলতে বিমলের চোখ দুটি যেন স্থির হয়ে যায়। সে বলতে থাকে। ১৮৫৪ সালের প্রথম দিকের কথা। গোপনে সাঁওতালরা শত্রুর বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ হয়। বীর সিং-এর নেতৃত্বে তৈরি হয় একটি দল। কিন্তু টিকতে পারে না তারা। পাকুড় রাজার দেওয়ান জগবন্ধু রায়ের বিশ্বাসঘাতকতায় বীর সিংকে ধরে আনা হয়। জরিমানাসহ সবার সামনে তাকে জুতাপেটা করা হয়। বিমল এবার শুরু করে গোচ্চোর কথা। গোচ্চো ছিলেন ধনী সাঁওতাল। তার টাকার ওপর ছিল মহাজনদের বিশেষ লোভ। তাই তারা মহেশ দারোগাকে দিয়ে তাকে শায়েস্তা করার পরিকল্পনা করে। তার বিরুদ্ধে দেয়া হয় চুরির মামলা। জমিদার, মহাজন আর পুলিশের এ জুলুম-পীড়নের কাহিনী সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ে। ফলে সাঁওতালরা ভেতরে ভেতরে ক্ষিপ্ত হতে থাকে।
সিদু, কানু, চাঁদ, ভৈরব ছিল চার ভাই। সাঁওতাল পরগনার ভাগনাদিহি গ্রামের এক দরিদ্র সাঁওতাল পরিবারে এদের জন্ম। এক সময় এরা বেশ সচ্ছল ছিল। একবার ফসল না হওয়ায় মহাজনদের কাছে তাদের দেনা বেড়ে যায়। ফলে ক্রমেই তারা দরিদ্র হয়ে পড়ে।
বীর সিং আর গোচ্চোর অপমান ও পীড়ন সিদু-কানুর মনে দাগ কাটে। সাঁওতালদের ওপর জুলুম আর অত্যাচার দেখে সিদু-কানু বিদ্রোহী হয়ে ওঠে। তারা তখন জমায়েত হবার জন্য চারপাশের সাঁওতালদের কাছে পাতা সমেত ছোট শালের ডাল পাঠায়। এভাবে ডাক দেয়ার রীতিটি ছিল সাঁওতালদের ঐতিহ্য।
১৮৫৫ খ্রিষ্টাব্দের ৩০ জুন। সিদু-কানুর ডাকে প্রায় ১০ হাজার সাঁওতাল একত্রিত হয় ভাগনাদিহি গ্রামে। সেদিন সিদু-কানু সবাইকে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার ডাক দেন। সিদু-কানুর বক্তব্য শুনে সাঁওতালরা গর্জে ওঠে। সবাই শপথ নেয়Ñ জমিদার মহাজনদের, ইংরেজ শাসকের, পুলিশ-পাইক-পেয়াদার আর জজ ম্যাজিস্ট্রেটের নিপীড়ন ও দাসত্ব সহ্য না করার। সিদ্ধান্ত নেয় খাজনা না দেয়ার। বিদ্রোহী কণ্ঠে সবাই স্লোগান দিতে থাকেÑ ‘জমি চাই, মুক্তি চাই’।
প্রচণ্ড বিক্ষোভে সেদিন সাঁওতাল চরিত্রের উগ্ররূপ সম্পূর্ণ নগ্নভাবেই প্রকাশ পেল। বিমল জানাল এ নিয়ে বীরভূমের সমসাময়িক কবি কৃষ্ণদাস রায় ‘সাঁওতাল হাঙ্গামার ছড়া’ লিখেছিলেন। তার ছড়াতেই তা প্রকাশ পায়। তিনি লিখেছিলেনÑ
‘শুন ভাই বলি তাই সভাজনের কাছে
শুভবাবুর হুকুম পেয়ে সাঁওতাল ঝুঁকেছে
বেটারা কুক্ ছাড়িল জড়ো হৈল হাজারে হাজারে
কখন আসে কখন লুটে থাকা হৈল ভার।
গেল কুমড়াবাদে সকল ফদে হৈল একাকার
ঘরে অগ্নি দিয়ে বেটারা করলে ছারখার।
পোড়াইলে ধানের গোলা, তিল জুল্যা সরিষা আদি যত
গরু মহিষ ছাগল ভেড়া পুড়িল কত শত’।
আর সাঁওতালরা? তারা চিৎকার করে বলে উঠেছিলÑ
‘নেরা নিয়া, নুরু নিয়া
ডিডা নিয়া ভিটা নিয়া…’
ভাবার্থ : স্ত্রী-পুত্রের জন্য
জমি-জায়গা বাস্তু-ভিটার জন্য,
হায়! হায়! এ মারামারি, এ কাটাকাটি
গো-মহিষ লাঙ্গল ধন-সম্পত্তির জন্য,
পূর্বের মতো আবার ফিরে পাবার জন্য
আমরা বিদ্রোহ করব’।
বিমল জানাল তারা বিশ্বাস করে সিদু-কানুর সংগ্রামে পরাজয় ছিল কিন্তু আপস ছিল না। ফলে সাঁওতালরা নির্ভয়ে মৃত্যুবরণ করেছিল। সে সময় ইংরেজ শাসকবর্গও এ কথা স্বীকার করেছিল। ওল্ডহাম সাহেব লিখেছেন-
‘পুলিশ ও মহাজনের অত্যাচারের স্মৃতি যাদের দেশপ্রেম জাগিয়ে তুলেছিল, আন্দোলন তাদের সবাইকে আকৃষ্ট করল; কিন্তু যে মূল ভাবধারাকে কাজে পরিণত করার চেষ্টা চলছিল তা ছিল সাঁওতাল অঞ্চল ও সাঁওতাল রাজ্য প্রতিষ্ঠার চিন্তা’।
বিমলের তথ্যে আমরা বেশ অবাক হই। সে জানাল সে সময় বিদ্রোহে যোগ দিয়েছিলেন ছটরায় দেশমাঝিও। বিদ্রোহের ঘটনা বর্ণনা করতে গিয়ে তিনি বলেছেন-
‘বিদ্রোহ আরম্ভ হওয়ার পূর্বে সিদু কানু জাহির করল, আমরা মহিষ টানা লাঙ্গল ৮ আনায় ও বলদে টানা লাঙ্গল ৪ আনায় দেব আর সরকার আমাদের কথা না রাখলে আমরা যুদ্ধ আরম্ভ করব, দোকোদের খতম করব এবং আমরাই রাজা হব’।অরণ্যরাজ্যে সুখশান্তিতে বসবাস করার জন্য সাঁওতালরা জমি করেছে, গ্রাম বসিয়েছে, শান্তির দেশ গড়ে তুলেছে। কিন্তু সেই শান্তির দেশে তাদের শ্রমের অংশ লুট করে নেবার জন্য কোম্পানির অনুগত জমিদার ও মহাজনরা হাত বাড়ায়। তারা প্রতিবাদ জানালে ব্রিটিশ শাসকরা কর্ণপাত করে না। তাদের সহ্যের সীমা যখন অতিক্রম করল তখন তারা বহুদিনের জমানো বিক্ষোভে ফেটে পড়ে। তাই সিদু-কানুর ডাকে হাজার হাজার সাঁওতালের কণ্ঠ থেকে সেদিন উচ্চারিত হয়
‘নুসাসাবোন, নওয়ারাবোন চেলে হঁ বাকো তেঙ্গোন,
খাঁটি গেবোন হুলগেয়া হো
খাঁটি গেবোন হুলগেয়া হো,
দিশম দিশম দেশমৗঞ্জহি পারগানা
নাতো নাতো মাপাঞ্জিকো
দঃ বোন দানাং বোন বাং গেকো তেঙ্গোন
তবে গেবোন হুলগেয়া হো।
ভাবার্থ:
‘আমরা বাঁচব, আমরা উঠব, কেউ আমাদের পাশে দাঁড়াবে না
আমরা সত্যি বিদ্রোহ করব
আমরা সত্যি বিদ্রোহ করব
দেশের মাঝি ও পারগানারা
গ্রামের মোড়লরা
আমাদের সর্বপ্রকারে সাহায্য করবে, কেউ পাশে দাঁড়াবে না
তবে আমরা নিশ্চয়ই বিদ্রোহ করব’।
এভাবে বিদ্রোহ ছড়িয়ে পড়তে লাগল। বারহেট দখলের পরই সিদু-কানু সাঁওতাল বাহিনী গড়ে তুলতে লাগলেন। সে সময় রেলপথ তৈরি হচ্ছিল বলে জয়ান জয়ান সাঁওতাল ছেলেরা কাজে গিয়েছিল। তাদের ডেকে আনা হলো যুদ্ধে যাওয়ার জন্য। এছাড়া সাঁওতাল নেতারা গ্রামে গ্রামে শালডাল পাঠাতে লাগলেন। সাঁওতালদের কাছে শালডাল হলো একতার প্রতীক। তারা দলবেঁধে গ্রামে গ্রামে গিয়ে গান গেয়ে সবাইকে অনুপ্রাণিত করতে লাগল বিদ্রোহে যোগ দেয়ার জন্য। গ্রামের নাম উল্লেখ করে তারা গাইল :
‘ধানজুড়ি হে/ ঢোল বাজে হে/ ঢাক বাজে হে/ সিদো কানহু চাঁদ ভায়রো/ হুলে হু… লে’।
ভাবার্থ : শুন হে ধানজুড়িবাসী, ঢোল বাজছে, ঢাক বাজছে, সিদো কানহু চাঁদ ভায়রো, বিদ্রোহ বি…দ্রোহ।
গ্রামবাসীর কাছ থেকে যদি সাড়া না মিলত তখন তারা টিটকারী দিয়ে গান গাইত :
‘ধানজুড়ি হে/ জানি হইল ম…রদ/ মরদ হইল জা…নি/ হে হে হে… হে’।
বিমল মার্ডী মনে করে সাঁওতাল বিদ্রোহীরা মৃত্যুবরণ করলেও তাদের উদ্দেশ্য বিফলে যায়নি। এ সংগ্রাম বাংলার ও ভারতের কৃষক সংগ্রামের ঐতিহ্যকে গৌরবান্বিত করেছে। বিদ্রোহীদের বীরত্বের কাহিনী পরবর্তী কৃষক সংগ্রামে ও সিপাহী বিদ্রোহের প্রেরণা জুগিয়েছিল। পরবর্তীতে সাঁওতালদের সংখ্যালঘুর স্বীকৃতি দেয়া হয়, তাদের জন্য পৃথক সাঁওতাল পরগনা জেলা গঠন করা হয়, সেখানে জমির ওপর তাদের মালিকানা প্রতিষ্ঠা পায়।
বৃষ্টি থামতেই আদিবাসীরা আবার মাঠে জড়ো হতে থাকে। নানা আয়োজনে তারা স্মরণ করে সিদু-কানুকে। সিদু-কানু আজো আদিবাসী সাঁওতালদের সংগ্রামের প্রতীক।
ছবি: সালেক খোকন
লিখাটি প্রকাশিত হয়েছে সাপ্তাহিকে ২১ জুলাই ২০১১
© 2011 – 2018, https:.
bah Darun !!
thanks for reading dear.
thanks to visit.