কাশেম মোল্লার অস্ত্র ছিল রেডিও
৭১-এ পাকিস্তানিদের রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে চায়ের দোকানে তিনি রেডিওতে বাংলা খবর শোনাতেন। রাতে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র এবং বিবিসি, ভয়েজ অব আমেরিকা ও কলকাতা বেতারের খবর শোনার জন্য আশপাশের মানুষ দু’বেলাতেই নিয়মিত ভিড় জমাতো তার চায়ের দোকানে। গোপনে মাঝে মধ্যেই দল বেঁধে আসত মুক্তিযোদ্ধারা। রাজাকার আর পাকিস্তানিদের নানা খবর জেনে যেত কাশেম মোল্লার কাছ থেকে। চা খেতে আসা নানা লোকের নানা তথ্য থাকত কাশেমের কাছে। তিনি সেসব খবর দিতেন মুক্তিযোদ্ধাদের।
ঈশ্বরদীকে অনেকেই জানে জেলা হিসেবে। জেলা শহরের প্রায় সব সুবিধাই আছে অতি পুরনো এই উপজেলাটিতে। আছে ব্রিটিশ আমলের তৈরি হার্ডিঞ্জ ব্রিজ। ১৪ ফেব্রুয়ারি ১৮৯৮ খ্রিস্টাব্দে রূপসা-বাগেরহাট সেকশনে প্রথম চালু হওয়া ২ ফুট ৬ ইঞ্চি ন্যারো গেজ ট্রেনটি রাখা হয়েছে এখানেই। সাহসী বাঙালির নানা কাহিনীতে ভরা এই ঈশ্বরদী। পাঁচ শহীদের মোড় আর শহীদপাড়ার গণকবরটি তো আজও ইতিহাসের সাক্ষী। রাখা আছে মুক্তিযুদ্ধের সময়ে হার্ডিঞ্জ ব্রিজ এলাকায় নিক্ষিপ্ত বোমার অংশবিশেষও।
বন্ধু শামীমের বাড়ি ঈশ্বরদীতে। তার সঙ্গে ঈশ্বরদীর নানা ঐতিহাসিক স্থান ঘুরে দেখছি। কথায় কথায় শামীম জানাল বিবিসি বাজারের কথা। বিবিসি নামে বাজার, শুনেই আগ্রহী হলাম। যেতে যেতে শামীম জানাল বিবিসি বাজার নিয়ে নানা কথা।
১৯৭১ সাল। পাকিস্তানি সেনাবাহিনী ক্যাম্প বসিয়েছে পাকশী পেপার মিল ও হার্ডিঞ্জ ব্রিজ এলাকাতে। সেখান থেকে খুব কাছেই রূপপুর গ্রাম। সে গ্রামে রাস্তার পাশের এক কড়ইতলায় ছোট্ট একটি চায়ের দোকান বসায় এক দোকানি। সবার কাছে সেটি মোল্লার দোকান। গ্রামের মানুষ কাশেম মোল্লাকেই ভালোবেসে ডাকত ‘মোল্লা’ বলে।
রূপপুরসহ আশপাশের গ্রামের সবাই ছিল মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের। অনেক পরিবারেরই যুবক ছেলেরা গিয়েছে মুক্তিযুদ্ধে। পাকিস্তানিরা নির্বিচারে জ্বালিয়ে দিচ্ছে গ্রামের পর গ্রাম। সবাই উৎকন্ঠা আর আতংকে দিন কাটাচ্ছে। দেশের কোনো খবর জানে না কেউ। রেডিও পাকিস্তান এ সঠিক কোনো খবর নেই। যা খবর পাওয়া যায় তা শুধুই বিবিসি, ভয়েজ অব আমেরিকা, কলকাতা বেতার আর স্বাধীন বাংলা বেতারে।
দশ গ্রামের মধ্যে শুধু কাশেম মোল্লারই ছিল একটি থ্রি ব্যান্ডের ফিলিপস রেডিও। প্রতি সন্ধ্যায় চায়ের দোকানে বসে তিনি শর্টওয়েভে সবাইকে বিবিসির খবর শোনাতেন। বিবিসিতে দেশের খবর, মুক্তিযোদ্ধাদের বীরত্বের খবর শুনতে চায়ের দোকানে ভিড় লেগে যেত। ক্রমেই ভিড় আরো বাড়তে থাকল। চায়ের দোকানের পাশে গড়ে উঠলো আরো বেশ কয়েকটি দোকান। এভাবে তৈরি হয় একটি গ্রাম্য বাজারের।
সন্ধ্যে হলেই রূপপুর গ্রামে হাকডাক শুরু হতো। গ্রামের লোকেরা একে অন্যকে বলত, ‘চল বিবিসি শুনতে যাই’। এভাবে মোল্লার দোকানে বিবিসির খবর শোনাকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠা বাজারের নাম প্রথমে ‘বিবিসি শোনার বাজার’ এবং পরে তা হয়ে যায় ‘বিবিসি বাজার’।
লালন শাহ সেতুমুখী হাইওয়ে রাস্তা হতে কিলোখানিক পথ পেরোতেই জমজমাট একটি বাজার ঠেকলো। শামীম জানাল এটিই সেই বিবিসি বাজার। দেখলাম কাশেম মোল্লার হাতে লাগানো সেই কড়ইগাছটি এখন আকাশচুম্বি। গোটা বাজারে দোকানের সংখ্যা শতাধিক। কিন্তু সেখানে নেই বাজারেরই প্রবর্তক কাশেমের কোনো দোকান।
বিবিসি বাজারে চঞ্চল মিষ্টি ভান্ডারে বসে কথা হয় চর রূপপুরের একজন মুক্তিযোদ্ধার সঙ্গে। নাম মো. ওমর আলী। কথা হয় দোকান মালিক আশরাফ মালিতার সঙ্গেও। ১৯৭১ এ কাশেম মোল্লার চায়ের দোকানে বসে বিবিসির খবর শোনার স্মৃতি তাদের কাছে আজো জীবন্ত হয়ে আছে। পাকিস্তান আর্মিদের গাড়ির শব্দ পেলেই সবাই চায়ের দোকান থেকে সরে পড়ত গ্রামের ঝোপঝাড়ে। তারা জানাল জীবন বাজি রেখেই কাশেম মোল্লা সবাইকে বিবিসির খবর শোনাত। সে সময় মোল্লার দোকানে বিবিসির খবর শুনে উদ্বুদ্ধ হয়ে যুদ্ধে গিয়েছে শত শত যুবক। এভাবে বিবিসি বাজার, সেই কড়ইগাছ আর কাশেম মোল্লা জায়গা করে নেয় ইতিহাসের পাতায়।
কিন্ত কাশেম মোল্লাকে কোথায় পাব?
একজন জানালো পাকশী রেলবাজারে তার একটি ছোট্ট মিষ্টির দোকান আছে। আমরা আর দেরি করি না। রওনা হই রেলবাজারের দিকে। বিবিসি বাজারের কাশেম মোল্লাকে চেনে সকলেই। তাই দোকান খুঁজতে খুব একটা বেগ পেতে হয়নি।
দোকানটিতে কাশেম মোল্লা নেই। বসে আছে তার মেজ ছেলে আব্দুস সামাদ। ভাঙাচোরা দোকানের এক কোণে ঝুলছে বড় একটি ছবি। ছবিতে কাশেম মোল্লার সঙ্গে সাংবাদিক আতাউস সামাদসহ বেশ কয়েকজনকে দেখা গেল।
সামাদ জানাল বিবিসি নামে একটি বাজারের নামকরণের কথা শুনে বিবিসির ৫০ বছরপূর্তি উপলক্ষে ১৯৯২ সালে এখানে এসেছিলেন বিবিসির তৎকালীন ‘ইস্টার্ন সার্ভিস সেকশনের প্রধান ব্যারি ল্যাংরিজ, বাংলা সার্ভিসের উপপ্রধান সিরাজুল ইসলাম, প্রযোজক ও প্রেজেন্টার দীপঙ্কর ঘোষ এবং সংবাদদাতা আতাউস সামাদ। বিবিসি শোনার সেই রেডিওটি কোথায়? এমন প্রশ্নে সামাদ নিশ্চুপ থাকে। পরে জানাল স্বাধীনের পর অভাবের কারণে তার বাবা কাশেম বিক্রি করে দিতে বাধ্য হয় ’৭১-এর স্মৃতিবিজড়িত সেই রেডিওটি।
ঘণ্টাখানেক পরে দোকানে আসেন কাশেম মোল্লা। বয়সের ভারে নুয়ে পড়েছেন। হানাদার বাহিনীর আঘাতে জখম হওয়া পা নিয়ে চলছেন খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে লাঠিতে ভর দিয়ে। চা খেতে খেতে কাশেম মোল্লা বলেন, মুক্তিযুদ্ধের সে সময়কার কথাগুলো।
অভাবের কারণে ক্লাস সেভেনের বেশি পড়া হয়নি কাশেমের। ফলে জীবন টিকাতে নেমে পড়েন টুকিটাকি ব্যবসায়। এক সময় পাকশী রেলবাজারে দেন একটি মুদি দোকান। ’৭১-এর ২৫ মার্চের পরে পাকিস্তানি আর্মি বাজার পুড়িয়ে দিলে তিনি চলে যান নিজ গ্রাম রূপপুরে। নিজের হাতে লাগানো কড়ইতলীতে বসান ছোট্ট একটি চায়ের দোকান।
বিয়ের পরে স্ত্রী আনোয়ারা বেগম আবদার করে একটি রেডিও কেনার। রেডিও শোনার প্রতি কাশেমেরও এক ধরনের ঝোঁক ছিল। তাই টাকা জমিয়ে তিনি কিনলেন একটি থ্রি ব্যান্ডের ফিলিপস রেডিও। কাশেম মোল্লার সেই রেডিওই হয়ে যায় ইতিহাস।
কাশেম জানালেন ’৭১-এ পাকিস্তানিদের রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে চায়ের দোকানে তিনি রেডিওতে বাংলা খবর শোনাতেন। রাতে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র এবং বিবিসি, ভয়েজ অব আমেরিকা ও কলকাতা বেতারের খবর শোনার জন্য আশপাশের মানুষ দু’বেলাতেই নিয়মিত ভিড় জমাতো তার চায়ের দোকানে। গোপনে মাঝে মধ্যেই দল বেঁধে আসত মুক্তিযোদ্ধারা। রাজাকার আর পাকিস্তানিদের নানা খবর জেনে যেত কাশেম মোল্লার কাছ থেকে। চা খেতে আসা নানা লোকের নানা তথ্য থাকত কাশেমের কাছে। তিনি সেসব খবর দিতেন মুক্তিযোদ্ধাদের।
হাসতে হাসতে কাশেম জানালেন, সে সময় বিবিসির খবর শুনে শুনে এমন অবস্থা হলো যে, কেউ অধিবেশন শুরুর পরে এলেও ঠিক ঠিক বলতে পারতেন কার কন্ঠ শুনছেন? সিরাজুর রহমান, নুরুল ইসলাম,শ্যামল নাকি কমল বোস। এমন কি কেউ কেউ তাদের কন্ঠ এবং ভঙ্গি পর্যন্ত অনুকরণ করতে পারত। বিবিসি শুনতে আসা গ্রামের মানুষ শুধু খবরই শুনতেন নাÑ পর্যালোচনা করতেন, বিশ্লেষণ করতেন।
কাশেম জানালেন স্বাধীনের ঠিক কয়েকদিন আগে রাজাকারদের তথ্যের ভিত্তিতে পাকিস্তানি আর্মি হানা দেয় তার চায়ের দোকানে। সেদিনের কথা মনে হলে আজো তিনি আঁৎকে ওঠেন। কাশেম আপন গতিতে বলতে থাকেন। পাকিস্তানি আর্মি এসে তাকে হুংকার দিয়ে বলে ‘এ মাদার চোত, তোম এদার আও, তোমারা দোকান মে রেডিও বাজতা হ্যায়, শালে, তুমকো খতম কারদেগা, তুম রেডিও নিকালো’। কাশেম বলেন, সেনাদের কথায় আমার জানে তো পানি নাই। ভেবেছিলাম মাইরে ফেলবি। আমি কলেম ‘ও চিজ হামারা নেহি হে, আদমি লোক খবর লেকে আতা হে, শুনালকে লেকে চলে যাতা হে’। কথা শুনে আর্মিরা রোলার দিয়ে কাশেমের ডান পায়ে বেশ কয়েকটা বাড়ি দেয়। আর্মিদের সেই বাড়ির কারণেই এখন আর তিনি ডান পায়ে ভর দিয়ে চলতে পারেন না।
কাশেম মোল্লার চায়ের দোকান ছিল খুবই ঝুঁকির জায়গা। পাশেই ছিল আর্মি ক্যাম্প আর চারপাশে রাজাকারদের পদচারণা। এরই মধ্যে তিনি রেডিওতে বিবিসি খবর শুনাতেন আর মুক্তিযোদ্ধাদের নানা খবর দিতেন গোপনে। মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে ছিল তার নিবিড় সম্পর্ক। কাশেম সম্পর্কে এভাবেই বললেন মুক্তিযোদ্ধা সংসদের ঈশ্বরদী উপজেলা কমান্ডার মো. আব্দুর রাজ্জাক। তার মতে কাশেম মোল্লা একজন ত্যাগী মুক্তিযোদ্ধা। যার হাতে অস্ত্র হিসেবে ছিল রেডিও আর নানান সংবাদ।
তিনি দুঃখ করে বলেন যার কারণে বা যিনি ঐতিহাসিক বিবিসি বাজারের প্রবর্তক, সেই বাজারে তার একটি দোকান নেই, এটা জাতি হিসেবে আমাদেরই ব্যর্থতা। কাশেম মোল্লাকে মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে সম্মানিত করা এবং তার সুচিকিৎসার বিষয়ে মুক্তিযোদ্ধা সংসদ তার পাশে থাকবে বলে তিনি অঙ্গীকার করেন।
৪০ বছর আগের মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি নিয়েই বেঁচে আছেন কাশেম নামের অন্য রকম এই মুক্তিযোদ্ধা। জখম হওয়া পায়ের দিকে তাকালে আজো তার মনে পড়ে সেসব দিনের কথা। বিবিসি বাজারের ইতিহাস জানতে মাঝে মধ্যেই সাংবাদিকরা ভিড় জমায় কাশেমের কাছে। সংবাদ প্রকাশও হয়। কিন্ত কাশেমের অবস্থার কোনো পরিবর্তন ঘটে না। উপজেলায় বিজয় দিবস ও স্বাধীনতা দিবস পালন হয় ঘটা করে। কখনো কখনো স্বাধীনতাবিরোধীরাও দাওয়াত পায় সসম্মানে। কিন্তু একজন কাশেম মোল্লার খোঁজ রাখে না কেউ। কাশেমের ভাষায় ‘ভিক্ষুকের মতো বাড়িতে পইরে আছি’। তবু ৭১ এর স্মৃতি আর বিবিসি বাজারের কথা উঠলেই গর্বে বুক ভরে যায় তার। বেঁচে থাকার জন্য এই তার একমাত্র অবলম্বন।
লেখাটি প্রকাশিত হয়েছে কালেরকন্ঠের রাজকূটে, প্রকাশকাল: ২২ ডিসেম্বর ২০১০ এবং সচলায়তন ব্লগে
বিঃ দ্রঃ মৃত্যুর আগ পর্যন্ত এ মানুষটি পাননি কোনো স্বীকৃতি। আবুল কাশেম মোল্লা রোগশোকে ভুগে ৬ ফেব্রুয়ারি ২০১৫ তারিখ ভোর চারটায় ৭৫ বছর বয়সে মৃত্যুবরণ করেন। তিনি চার ছেলে ও পাঁচ মেয়ে এবং অসংখ্য গুণগ্রাহী রেখে গেছেন।
© 2011 – 2018, https:.
I really want to make a post about this on my blog. Thanks for your inspiring ideas. You are welcome to read my follow-up to this at howtogethits.net You can consider my post for July 15th to be the comment to this!
thanks….
best of luck to you
thanks for wishes.
Thanks, many many thanks for this item.
you r wellcome…
u r wellcome