সাগরের খোজেঁ রামসাগরে
খননের পরও দিঘিতে পানি না উঠায় পানির অভাবে প্রজাদের মৃত্যুচিন্তায় রাজা রামনাথ বিমর্ষ হয়ে পড়েন। এক রাতে রাজা স্বপ্নে দৈবনির্দেশ পান, প্রিয় পুত্র রামকে দিঘির গর্ভে ডুবিয়ে বলি দিতে হবে। তবেই উঠবে পানি। রাজার পুত্র রাম পিতার মতোই দয়ালু। প্রজাদের জীবন রক্ষায় নিজেকে উৎসর্গ করে সে। রাম দিঘির গভীরে তৈরি করা মন্দিরে প্রবেশ করামাত্র চারদিক থেকে পানি উঠতে থাকে।
শহর পেরোতেই মোটরসাইকেলের গতি বেড়ে যায়। পুলকসহ আমরা ছুটে চলি দক্ষিণ দিকের রাস্তায়। পুলহাট পার হতেই নামে নির্জনতা। রাস্তাটি বেশ পুরনো। দুই পাশের বড় গাছগুলোর অবয়ব দেখলেই তা বেশ বোঝা যায়। পুলক জানাল, এটিই বিখ্যাত মুর্শিদাবাদ সড়ক।
দিনাজপুর শহর থেকে সড়কটি সোজা রামসাগরে গিয়ে ঠেকেছে। রাস্তার দুদিকে ঝাঁকড়া চুলের বড় বড় লিচুগাছ। ভারী বাতাসে পাতা নাড়িয়ে গাছগুলো যেন আমাদেরই স্বাগত জানাচ্ছে। পাশেই বিস্তীর্ণ মাঠজুড়ে ধানক্ষেত। চারপাশে মন ভোলানো সবুজের রাজত্ব। ফুরিয়ে যাওয়ার ভয়ে প্রাণভরে নিঃশ্বাস নিই খানিকক্ষণ।
এভাবেই চলছি পথ ধরে। একসময় টিন আর তাঁবুতে ঘেরা সারি সারি টংঘরের দেখা মেলে। আরে, এ যে মেলা! জানতে পারি, রামসাগর ঘিরে বছরে একবার এখানে মেলা জমে। স্থানীয় লোকেরা একে বলে চেরা ডেংগির মেলা।
নানা জিনিসের পসরা সাজিয়ে মেলায় বসেছেন দোকানিরা। মুরলী, মুড়কি, হাওয়াই মিঠাই, পাঁপর, মিষ্টি আর জিলাপি খাওয়ার ভিড় লেগেছে দোকানগুলোতে। দূর থেকে ভেসে আসছে নাগরদোলার ক্যাঁচ ক্যাঁচ শব্দ। মাইকে সুর করে সার্কাস, পুতুলনাচ আর যাত্রা দেখার আহ্বান জানাচ্ছে। একটি দোকানে গোটা পাঁচেক গুড়ের গরম জিলাপি খেয়ে নেই আমরা।
মেলার কোলাহলকে পেছনে ফেলে এগোতে থাকি। জানতে চাই, রামসাগর কোথায়? হাসি হাসি মুখে এক বৃদ্ধ বলে, ‘ওই তো রামসাগর’।
চারপাশ সবুজ বৃক্ষরাজিঘেরা রামসাগরকে দূর থেকে অরণ্য ভেবে ভুল করতে পারেন অনেকে। আমাদেরও তেমটি হয়েছে। পাঁচ টাকায় টিকিট কেটে অরণ্যের মধ্যে সাগর খুঁজতে ভেতরে চলে আসি। ইট বিছানো উঁচু রাস্তাটিতে উঠে বাঁ দিকে চোখ ফেরাই। বিস্তীর্ণ জলরাশি চোখের সামনে মূর্ত হয়। অবাক দৃষ্টি নিয়ে তাকিয়ে থাকি সাগরের মতো বিশাল দিঘিটির দিকে। স্থির, স্বচ্ছ রূপ নিয়ে মনোহরণ করতে থাকে ।
মূল দিঘির চারপাশে উঁচু টিলা। টিলাজুড়ে নানা জাতের গাছগাছালি। গাছগুলোতে পাখিরা আড্ডা জমিয়েছে। তাদের কলকাকলিতে মুখরিত হয়ে উঠছে চারপাশ। আমরা হারিয়ে যাচ্ছি আনমনা উদাসী আনন্দে। হেঁটে চলি দিঘির পাড় ঘেঁষে। দিঘিতে ভেসে আছে অজস্র শাপলা ফুল। হঠ্যাৎ একটি পানকৌড়ি দিঘিতে নেমেই দিল ডুব। তারপর অতি দ্রুত স্নান সেরে আকাশের দিকে দিল ছুট।
নয়নাভিরাম প্রাকৃতিক সৌন্দর্য তো আছেই, রামসাগর ইতিহাসের পাতায়ও নাম রেখেছে। ভেতরে টাঙানো তথ্য বোর্ড থেকে জানা যায়, দিনাজপুরের রাজা রামনাথ প্রজাদের অভাব ও দুর্ভিক্ষের হাত থেকে রক্ষার জন্য তৈরি করেন এ দিঘি। ২০ লাখ শ্রমিক পাঁচ বছর (১৭৫০-১৭৫৫ খ্রিস্টাব্দ) সময় নিয়ে খনন করে সাগর আকৃতির দিঘিটি। এর দৈর্ঘ্য তিন হাজার ৩৯৯ ফুট এবং প্রস্থ ৯৯৮ ফুট। উত্তর দিকে দিঘির পাড়ভূমির বাইরে রয়েছে একটি প্রাচীন অথচ ভঙ্গুর দেবমন্দির। পুলক জানাল, দিঘির পাশে মন্দির থাকাটা নিয়মের মতো। দিঘি খননের নানা কাহিনীর দোলায় আমরা দুলতে থাকি। খননের পরও দিঘিতে পানি না উঠায় পানির অভাবে প্রজাদের মৃত্যুচিন্তায় রাজা রামনাথ বিমর্ষ হয়ে পড়েন। এক রাতে রাজা স্বপ্নে দৈবনির্দেশ পান, প্রিয় পুত্র রামকে দিঘির গর্ভে ডুবিয়ে বলি দিতে হবে। তবেই উঠবে পানি। রাজার পুত্র রাম পিতার মতোই দয়ালু। প্রজাদের জীবন রক্ষায় নিজেকে উৎসর্গ করে সে। রাম দিঘির গভীরে তৈরি করা মন্দিরে প্রবেশ করামাত্র চারদিক থেকে পানি উঠতে থাকে। সেই থেকে রামনাথের দয়ালু পুত্র রামের নামেই দিঘির নামকরণ। জনশ্রুতি আছে, এই দিঘির পানি নাকি কখনো শুকায় না।
দিঘির পশ্চিম পাড়ের বেলেপাথরের ঘাটটি রাজার আমলেরই পরিচয় বহন করছে। রামসাগর ছাড়াও রাজারা এই দিনাজপুরেই তৈরি করেছেন আরো কয়েকটি বিশালাকৃতির মনোরম দিঘি। দিঘিগুলোর নামকরণের সঙ্গে গেঁথে আছে মজার সব কাহিনী। সুখসাগরে চলত রানির সুখী ও অলস বিচরণ, রাজা-রানির আনন্দবিহার হতো আনন্দ সাগরে। আর রাজমাতার ব্যবহারের জন্যই নাকি তৈরি করা হয়েছে মাতাসাগরটি। রামের পুণ্যস্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে আবার তাকিয়ে থাকি দিঘির দিকে। ছেলেমেয়েদের চিৎকারে সম্বিত ফিরে পাই। এরই মধ্যে রামসাগরে ঢুকে পড়েছে বেশ কয়েকটি পিকনিক বাস। ছেলেমেয়েদের প্রাণখোলা হাসিতে দিঘির পানি যেন কেঁপে কেঁপে উঠছে।
টিলার ওপর বেশ মনোরম একটি দোতলা বাংলো। কিন্তু গেটে বড় একটি তালা ঝুলছে। কেয়ারটেকার জানান, ভেতরে ঢোকার অনুমতি নেই। অনুমতি নিতে হয় জেলা প্রশাসন থেকে। অনুমতি ছাড়া প্রবেশ নিষেধ। তাই আর ওমুখো হলাম না। দিঘিপানে চেয়ে দেখি মাছ ধরিয়েদের বেশ ভিড় জমেছে। জানলাম বন্ধের দিনে টিকিটের বিনিময়ে দিঘিতে মাছ ধরার ধুম পড়ে যায়। দেড় মণ ওজনের রুই মাছও নাকি পাওয়া গেছে!
রামসাগর থেকে বের হওয়ার পথে শেষবারের মতো দিঘিপানে চেয়ে মন খারাপ হয়ে যায়। আবার কবে দেখতে পাব_ভাবতে থাকি।
লিখাটি প্রকাশিত হয়েছে কালেরকন্ঠে ২২ ফেব্রুয়ারি ২০১০
© 2011 – 2018, https:.
Terrific! This is why we can count on PBS. I just sent this link to all 126 of my employees. A MUST SEE for everyone.
thanks.
সেই ৮০ দশকে যেতাম, রামসাগরে। অদ্ভুত সুন্দর। ক্ষুদে শাপলাগুলো সৌন্দর্য আরও বাড়িয়ে দিয়েছে বহুগুণ।
ধন্যবাদ মিতা।