ভ্রমণকথা

হরিণমারীর আমগাছ

গাছটির বর্তমান মালিক নূর ইসলাম। পূর্বপুরুষদের কোন আমলে আমগাছটি লাগানো হয়েছে তা তার জানা নেই। প্রাচীন এই গাছটি সম্পর্কে সে জেনেছে তার দাদার কাছ থেকে। তার দাদা আবার সেটা জেনেছে তার দাদার কাছ থেকে। এভাবেই ধারণা করা হয় গাছটির বয়স ২০০ বছরেরও বেশী। যুগ যুগ ধরে এই সূর্যপুরি আমগাছটিই নূর ইসলামদের দিয়ে আসছে রসালো ও সুস্বাধু আম। এখনও এ গাছ থেকে প্রতি বছর প্রায় ৪০০ মন আম পাওয়া যায়।’

মৃদুলের  ডাকে আমার ঘুম ভেঙ্গে যায়। মাইক্রোবাসটি চলছে মধ্যম গতিতে। গতির তালে বাজছে সায়ানের গান।  গান শুনে শুনে জানালায় চারপাশ দেখা। এ তো অন্যরকম আনন্দ।  অন্যরকম মজা। এ রকম আনন্দের জোয়ারে কখন যে ঘুমিয়ে পরেছি টেরই পাইনি। জেগেই দুদিকে দোকানের  সাইনবোর্ডগুলোতে চোখ রাখি। কোথায় আমরা?  পেছন থেকে  অরণ্যের কন্ঠ। আমরা বালিয়াডাংগিতে।

হরিণমারীর আমগাছ
হরিণমারীর আমগাছ

ঢাকা থেকে পাঁচ বন্ধু বেড়াতে এসেছি ঠাকুরগাঁও  এ । শহরে এসে জানলাম শুধু ঐতিহাসিকতার স্পর্শই নয়, এ জেলায় আছে প্রাচীন একটি গাছ। গাছটির বয়স নাকি ২০০ বছরেরও অধিক।  তাও আবার বট কিংবা অশ্বথ গাছ নয়। একেবারে জীবন্ত সূর্যপুরী আমগাছ। আমাদের কাছে অবিশ্বাস্য ঠেকলো।  তাই অদ্ভুত সেই আম গাছটি দেখতে  আমরা বেড়িয়েছি।

ঠাকুরগাঁও থেকে বালিয়াডাংগি উপজেলার দুরত্ব ২৫ কিলো। কিন্তু চমৎকার মসৃন রাস্তা সে দুরত্বকে ভুলিয়ে দেয়।  ক্লান্তি ভর করার আগেই আমরা পৌছে যাই বালিয়াডাংগিতে। উপজেলা সদর থেকে ১০ কিলো ভেতরে হরিণমারী। রাস্তার হলুদ মাইলফলকে  চোখ রেখে আমরা এগুতে থাকি।
একটি ছোট ব্রীজ পেরুতেই হরিনমারীর পিচঢালা পথ ।  দুদিকে সারি সারি কাঠাল গাছ। নানা পাখ-পাখালি খেলা করছে গাছের ডালগুলোতে। খানিকটা হেলে দুলে  রাস্তাটি চলে গেছে ভেতর গ্রামে। চারপাশের বিস্তীর্ণ মাঠে ঘন সবুজ গম খেত। বসন্ত বাতাসে গম খেতে চলছে ঢেউ ঢেউ খেলা। এ রকম দৃশ্যে  প্রকৃতির মতো আমাদের মাঝেও নিরবতা নামে।
রাস্তার পাশে  তেমন জনবসতি চোখে পড়ল না। দূরে বেশ কয়েকটি ঘন সবুজ বাঁশঝাড়। গম খেতের মধ্যে  সর্দারি ঢঙে  দাড়িয়ে আছে সেগুলো। আমরা সে দিকটায় এগোই। বাতাসে বাঁশপাতা নড়ার চট্ চট্ শব্দে আমরা অভিভূত  হই। মনে হচ্ছিল বাঁশগাছগুলো  যেন আমাদেরই অভিনন্দন জানাচ্ছে।
রাস্তার বাঁকে হঠ্যাৎ আমাদের গাড়িটি থেমে যায়। গাড়ি থেকে প্রায় লাফিয়ে নেমে পড়ে মৃদুল। আমরা তাকিয়ে থাকি তার দিকে। সবুজের রাজত্বে লম্বা নি:শ্বাস টেনে মৃদুলের মুখে উচ্চারিত হয় কয়েকটি শব্দ  – ‘ওয়াও’, ‘অদ্ভুত’, ‘চমৎকার’। আমগাছের সৌন্দর্য দেখা  এখনও বাকী। অথচ চারপাশের অন্যরকম মনভোলান দৃশ্যে এরই মধ্যে মৃদুল মজে যায়। মৃদুলের কান্ড দেখে  আমরা  মুচকি হাঁসি।
পাকা রাস্তা শেষে এবার শুরু ইটের পথ। দুপাশে মাটি আর ছনের তৈরী সারী সারী ঘর।  ঘরগুলোর চাল অবধি জড়িয়ে আছে নীল রংয়ের সীম ফুল। পানি বিহীন একটি ছোট্ট দীঘির দেখা মিলল। দীঘির মধ্যে রান অবধি কাদা।  গ্রামের আবাল বৃদ্ধরা তারই মধ্যে হুমড়ি খেয়ে পড়ছে মাছ ধরতে। তাদের চোখে মুখে কাদার ঝাপটা। কাউকেই ঠিকঠাক চেনা যাচ্ছে না।  এসব দৃশ্য আমাদের ছেলেবেলাকে মনে করিয়ে দেয়।
প্রাণ জুড়ানো নানা দৃশ্য পেরিয়ে আমরা পৌছে যাই হরিণমারীর নয়াবাড়ী গ্রামে। আম গাছের খোঁজ করতেই  ষাট উর্ধ্ব এক দোকানী দূর থেকে দেখিয়ে দেয় ২০০ বছরেরও পুরনো আম গাছটিকে। দূর থেকে মনে হচ্ছে উচু আমগাছের বাগান। কিন্তÍ কাছে যেতেই আমাদের চোখ তো ছানা ভরা। বাগান কোথায় , পাহাড় সমান আকার নিয়ে একটি আমগাছই যেন আকাশ ছুতে চাচ্ছে।
গাড়ি থেকে নেমেই দে ছুট। সবাই চলে আসি আমগাছটির নিচে। অবাক হয়ে দেখতে থাকি  প্রায় ২ বিঘা জায়গা জুড়ে দাঁড়িয়ে থাকা ২০০ বছরের বৃদ্ধা আমগাছটিকে। অক্টোপাসের মতো মাটিতে নেমে এসেছে এর ১৯ টি মোটা মোটা নুয়ে পড়া ডাল। গাছটির উচ্চতা আনুমানিক ৮০ ফুট আর ঘের ৩০ ফুটের মতো।

01মজার বিষয় হলো, গাছটির ডালগুলো মাটিতে নুয়ে পড়লেও সেখান থেকে নতুন কোন গাছ জম্মায় নি।  নুয়ে পড়া মোটা ডালগুলো দেখলেই মনে হয় গাছটি অতি প্রাচীন। ডালগুলোকে  মৃত মনে হলেও গাছটির শীর্ষভাগ এখনও চির সবুজ। এরই মধ্যে মুকুল এসেছে গোটা গাছ জুড়ে। আমরা সকলেই কালের সাক্ষি আমগাছটির বড় বড় মলিন ডালগুলোকে স্পর্শ করে দেখতে থাকি।
দর্শনার্থীদের জন্য গাছের নিচেই রয়েছে বসার ব্যবস্থা। আমগাছটির ছায়ায় বসলেই দেখা যায় গাছটির অবয়ব। সবার মনে একই প্রশ্ন, কত জীবনী শক্তি নিয়ে গাছটি বেঁচে আছে?  গাছটিকে নিয়ে প্রচলিত আছে একটি কল্প কাহিনী। এলাকাবাসী শামীম জানালো সে কথা। আম গাছটির নিচে নাকি মোহরের কলস রেখে গাছটিকে লাগানো হয়েছিল।
আমরা বিস্ময় নিয়ে খুটিয়ে খুটিয়ে দেখি গাছটিকে। তখনই সেখানে উপস্থিত হয় গাছটির বর্তমান মালিক নূর ইসলাম। পূর্বপুরুষদের কোন আমলে আমগাছটি লাগানো হয়েছে তা তার জানা নেই। প্রাচীন এই গাছটি সম্পর্কে সে জেনেছে তার দাদার কাছ থেকে। তার দাদা আবার সেটা জেনেছে তার দাদার কাছ থেকে। এভাবেই ধারণা করা হয় গাছটির বয়স ২০০ বছরেরও বেশী। যুগ যুগ ধরে এই সূর্যপুরি আমগাছটিই নূর ইসলামদের দিয়ে আসছে রসালো ও সুস্বাধু আম। এখনও এ গাছ থেকে প্রতি বছর প্রায় ৪০০ মন আম পাওয়া যায়।

নূর ইসলামের কথায় আমাদের চোখ কপালে ওঠে। ৪০০ মণ আম! আমরা অবাক হই।  সত্যি, গাছের মতো এমন ত্যাগী বন্ধু কি মিলবে কখনও ? আমগাছের ছায়ার  স্নিগ্ধতায় আমাদের মন ভরে যায়। আমাদের খেয়াল এড়িয়ে এরই মধ্যে অনেক দর্শনার্থী ভিড় জমিয়েছে গাছটির নিচে।  সবাই  মুগ্ধ হয়ে দেখছে আমগাছটিকে।
ফেরার সময় দূর থেকে চোখ রাখি গাছটির দিকে।  কয়েকটি কোকিল বাসা বেঁধেছে গাছটিতে। অবিরতভাবে ভাবে ডাকছে তারা। তাদের মন ভুলানো কুহু কুহু ডাকে মুখরিত চারপাশ। আমগাছটির প্রতি শ্রদ্ধা আর ভালবাসায় মনে মনে বলতে থাকি  – ‘বেঁচে থাকো যুগে যুগে’

লিখাটি  প্রকাশিত হয়েছে কালেরকন্ঠে, ১৫ মার্চ ২০১০

© 2011 – 2018, https:.

এই ওয়েবসাইটটি কপিরাইট আইনে নিবন্ধিত। নিবন্ধন নং: 14864-copr । সাইটটিতে প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো তথ্য, সংবাদ, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করলে আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।

Show More

Salek Khokon

সালেক খোকনের জন্ম ঢাকায়। পৈতৃক ভিটে ঢাকার বাড্ডা থানাধীন বড় বেরাইদে। কিন্তু তাঁর শৈশব ও কৈশোর কেটেছে ঢাকার কাফরুলে। ঢাকা শহরেই বেড়ে ওঠা, শিক্ষা ও কর্মজীবন। ম্যানেজমেন্টে স্নাতকোত্তর। ছোটবেলা থেকেই ঝোঁক সংস্কৃতির প্রতি। নানা সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠনের সঙ্গে জড়িত। যুক্ত ছিলেন বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র ও থিয়েটারের সঙ্গেও। তাঁর রচিত ‘যুদ্ধদিনের গদ্য ও প্রামাণ্য’ গ্রন্থটি ২০১৫ সালে মুক্তিযুদ্ধ ভিত্তিক মৌলিক গবেষণা গ্রন্থ হিসেবে ‘কালি ও কলম’পুরস্কার লাভ করে। মুক্তিযুদ্ধ, আদিবাসী ও ভ্রমণবিষয়ক লেখায় আগ্রহ বেশি। নিয়মিত লিখছেন দেশের প্রথম সারির দৈনিক, সাপ্তাহিক, ব্লগ এবং অনলাইন পত্রিকায়। লেখার পাশাপাশি আলোকচিত্রে নানা ঘটনা তুলে আনতে ‘পাঠশালা’ ও ‘কাউন্টার ফটো’ থেকে সমাপ্ত করেছেন ফটোগ্রাফির বিশেষ কোর্স। স্বপ্ন দেখেন মুক্তিযুদ্ধ, আদিবাসী এবং দেশের কৃষ্টি নিয়ে ভিন্ন ধরনের তথ্য ও গবেষণামূলক কাজ করার। সহধর্মিণী তানিয়া আক্তার মিমি এবং দুই মেয়ে পৃথা প্রণোদনা ও আদিবা।

2 Comments

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

Back to top button