নেন ভাই পাতা নেন দাম কম
স্টেশন রোডের দুপাশটা যেন সবুজ পাতায় সাজানো। ব্যস্ত রাস্তার দুদিকে স্তুুপ করে রাখা হয়েছে পাতা আর পাতা। ছোট ছোট ডালে সবুজ সতেজ পাতা। ডালগুলো থেকে হরহামেসাই বের হচ্ছে সাদা রঙের কস। অন্য কোন পাতা নয়। একেবারে সবুজ সজিব কাঠাল পাতা। ছোট ছোট ডাল একত্র করে যতেœর সাথে বাধা হচ্ছে আঁটি। লোকসকলের সাইকেল কিংবা মটরসাইকেলের পেছনে বেধে দেয়া হচ্ছে পাতার আঁটিগুলো। কেউ কেউ রিক্সায় তুলে নিচ্ছে দশ-বারটি আঁটি। কেউবা আবার ২/১টি আঁটি হাতে নিয়েই ছুটছেন বাড়ির দিকে। এখানকার সবাই যেন সবুজ পাতার ভালবাসায় মত্ত। এখানে পাতা প্রেমিদের এরকম আনাগোনা চলে সারাবছরই। সকাল হতে রাত অবধি। রোদ কিংবা বৃষ্টিতেও থেমে থাকে না পাতার কেনাবেচা। এ রাস্তায় চলতে গেলেই দু’পাশ থেকে নারী কন্ঠগুলো ঘিরে ধরে।
চারপাশ থেকে ডাকাডাকি -‘নেন ভাই, পাতা নেন, দাম কম’। দিনাজপুর জেলা শহরের মধ্যেই বাহাদুর বাজার। বাজারের ঠিক পাশেই নামকরা এক মিষ্টির দোকান। নামটিও বেশ অন্যরকম। পাবনা সুইটস। দিনাজপুর শহরে দোকান অথচ নামটি কেন ‘পাবনা সুইটস’? চিন্তার জট খুলতে খুলতেই পৌছে যাই সেখানে।
দোকানের বাইরে রাস্তার পাশে ছোলা, পিয়াজু, জিলাপি, আলুর চপ, ডিম চপ আর নানা ধরণের বাহারী ইফতার সাজিয়ে বসেছেন পাবনা সুইটসের দোকানি। আর সে ইফতার কিনতে যেন হুমড়ি খেয়ে পড়েছে শহরবাসী। ইফতারের পাশাপাশি ঘোল কিনতে লাইন বেধেছে সবাই। ইফতারিতে ঠান্ডা ঘোলে প্রাণ জুড়ানোর সে কি প্রাণান্তর চেষ্টা। এ সবই শহরের অবস্থাশালীদের রীতি।
পাবনা সুইটসের সামনের রাস্তাটি টিএন্ডটি অফিসের ঠিক সামনে গিয়ে মিশেছে স্টেশন রোডের সাথে। ভিড় ঠেলে সে পথেই এগোই আমরা। এখানটা একেবারে অন্যরকম। লোকজনের ভিড় নেই বললেই চলে। রাস্তার দুপাশে ১০-১৫ জন নারী-পুরুষ দা হাতে বসা। তাদের প্রত্যেকের পেছনেই সবুজ সতেজ কাঠাল পাতার স্তুপ। হ্যাঁ, এভাবেই আমরা আবিষ্কার করি দিনাজপুরের পাতার বাজারটিকে।
কাঠাল পাতা ছাগলের প্রিয় খাবার। দিনাজপুর শহরে নিজ বাড়িতে যারা ছাগল পোষে। তাদের সংখ্যা নেহায়েত কম নয়। শহরের মধ্যে পর্যাপ্ত কাঠাল গাছ না থাকায় সবার নির্ভরতা এই পাতার বাজারের ওপর। সে রকমটিই জানালেন পাতা কিনতে আসা রায়হান নামের একজন সরকারী চাকুরীজীবি।
কবে থেকে এ পাতার বাজারের শুরু সে বিষয়ে স্থানীয়দের সুর্নিদিষ্ঠ কোন ধারণা নেই। তবে পাতা বিক্রেতা পঞ্চাশোর্ধ্ব নারী মহসিনা জানালেন নানা তথ্য।
এখানে পাতা বিক্রির সাথে যুক্ত আছেন ১৬ জনের মতো। এরা প্রায় সকলেই এ ব্যবসা করছেন বিশ বছর পূর্ব থেকে। তারও পূর্বে নাকি এখানে পাতা বিক্রি হতো স্বল্প পরিসরে।
মহসিনা প্রতি আঁটি পাতা বিক্রি করেন ১০ টাকা থেকে ২০ টাকায়। যা লাভ হয় তা দিয়েই চলে সংসার। কেমন লাভ হয়? মহসিনার উত্তর, ‘দাদা, কহনো লাভ কহনোও আবার লস, আল্লা চালায়া নেয়’।
মহসিনার পাঁচজনের সংসার চলে এই পাতার ব্যবসার ওপর। তার বাড়ী পঞ্চগড়ে। মেয়ের সুখের জন্য বাবা-মা মহসিনাকে বিয়ে দেয় স্থানীয় খুরশেদের সাথে। বিয়ের পর পরই বাবা-মায়ের স্বপ্ন রুপ নেয় দুঃস্বপ্নে। জুয়াড়ী স্বামীর অত্যাচার থেকে রক্ষা পেতে ছেলে মেয়েদের নিয়ে মহসিনা চলে আসেন দিনাজপুরে। শুরু করেন পাতার ব্যবসা। সে থেকেই মহসিনার বেঁচে থাকার সংগ্রাম শুরু। পেছনের কথা এখন আর মনে করতে চান না মহসিনা। পাতার ব্যবসার সাথে সাথেই বদলে যায় তার জীবনের পাতাটিও।
পাতার বাজারের রাশেদা ২টি আঁটি বেধে দিচ্ছেন এক ক্রেতার সাইকেলের সাথে। কথা হয় তার সাথে। লাভের কথা জানতে চাইলে উত্তরে বলে, ‘ছাওয়াল পাওয়াল নিয়ে বাঁচতে পারি’।
প্রতিদিন ভোর হতেই দা হাতে রাশেদা বেড়িয়ে পরে কাঠাল পাতা সংগ্রহে। সংগ্রহ করা পাতা সারাদিন বিক্রি করে যা পায় তা দিয়েই চলে ৫জনের সংসার। এভাবে পাতা বিক্রি করেই বিয়ে দিয়েছেন এক মেয়েকে। কোন কোনদিন বিক্রি কম হলে কাধে নিয়ে পাতার আঁটি ফেরি করে বেড়ায় রাশেদা।
পেছনের কথা বলতে গিয়ে রাশেদা আনমনা হয়ে যায়। তার বাড়ি ফরিদপুরের নগরকান্দায়। ১০ বছর বয়সেই তার বিয়ে হয়। বাবার মৃত্যুর পরে স্বামী সালামের হাত ধরে চলে আসেন দিনাজপুরে। কোন কাজ না পেয়ে মাত্র ৩০০ টাকা পুঁজিতে শুরু করেন পাতার ব্যবসা।
নিজে পাতার ব্যবসা করলেও রাশেদার রিক্সা চালক ছেলের পছন্দ নয় এ ব্যবসা। এ নিয়ে রাশেদার দুঃখের শেষ নেই। পাতার ব্যবসায় শরীর নোংরা হয় বেশি। সে কারণেই ছেলের কাছে মায়ের পাতার ব্যবসাটি আজ ‘নোংরা ব্যবসা’।
মহসিনার পাশেই ডাল কেটে আঁটি বাধায় ব্যস্ত প্রতিবন্দী এক বৃদ্ধ। নাম জানালো মান্নান। শিক্ষায় মেট্রিক ফেল। থাকেন বালু বাড়ি রেল ব্রিজের পাশে। পাতার ব্যবসা করছেন ২৫ বছর আগ থেকে। প্রতিদিন সকালে পাতার সন্ধানে সে বেড়িয়ে পরে আশে পাশের গ্রামগুলোতে। যাদের বাড়িতে কাঠাল গাছ আছে তাদের জানান গাছের পাতা ছাটার নানা সুফলগুলোর কথা। পাতা বাড়ির চাল নষ্ট করে, উঠান নষ্ট করে আর ডাল ছেটে দিলে গাছ আরো বাড়ে। যাদের সম্মতি মিলে তাদের কাছ থেকে গাছ প্রতি ১৫০-২০০ টাকা হিসেবে পাতা কিনে নেন তিনি। অতঃপর গাছের ৪ভাগের ৩ভাগ পাতা কেটে এনে বিক্রি করেন।
মান্নান জানালো ১৫০ টাকায় কেনা একটি গাছের পাতা বিক্রি করে পাওয়া যায় ৫০০ থেকে ৬০০ টাকা । পরিবহণ খরচ বাদ দিয়ে যা থাকে তাই লাভ। কখনও কম, কখনও আবার বেশি। এ ব্যবসায় পুঁজি লাগে খুবই কম। আবার যাদের পুঁজি নেই তারা নিজের পরিশ্রম আর অন্যের টাকায় শেয়ারে ব্যবসা করেন।
এক সময় পানের দোকান দিয়েই জীবন শুরু করেছিলেন মান্নান। বাকীর ভারে আর এনজিওদের ঋণের কিস্তির চাপে বন্ধ হয়ে যায় দোকানটি। জীবনে টিকে থাকতে পরিশ্রমকে পুঁজি করেই শুরু করেন পাতার ব্যবসা। এ ব্যবসা করেই নিজের ছেলে মেয়েদের শিক্ষিত করে তুলছেন মান্নান। এখন ৫ ছেলে আর ৩ মেয়েসহ এগার জনের সংসারটি চলছে এ পাতার উপর। মান্নান বলেন, ‘ আল্লা ভরসা, ধৈর্য্য ধরতে হয়, তাইলে তিনি রিজিক দেন’।
মান্নানের মতে পাতার ব্যবসা অনেক পরিশ্রমের। তার ওপর হরহামেসাই নানা কষ্টে বুক ভেঙ্গে যায় পাতা বিক্রেতাদের। ছোট ছোট ছেলেরা এসে তুই তোকারি করে। বলে- ‘ঐ পাতা দে রে’। কখনও কখনও শিক্ষিত লোকেরাও গায়ের জোরে গালাগাল দিয়ে আরো পাতা দাবী করে। সব মেনেই ব্যবসা করতে হয়। মান্নানের ভাষায়,‘গরিব বলেই হয়তো গালি খেতে হয়’।
কথার ফাঁকে কথা চলে অমেলাসহ অন্যান্যদের সাথেও। পরিশ্রম আর সততাকে পুঁজি করে টিকে আছে পাতার বাজারের সংগ্রামীরা। জীবন যুদ্ধে জয়ী এসব মানুষদের পাশে নিজেকে আবিষ্কার করি অন্যভাবে। এদের কাছে জীবনের মানে পাতার মতোই জম্মানো আবার জড়ে যাওয়া। পাতাই এদের জীবন, পাতাই স্বপ্ন। পাতায় পাতায় বদলে যায় এদের জীবন।
লিখাটি প্রকাশিত হয়েছে প্রথমআলোতে ১৩ মে ২০১১
Human story: Tobuo hamara to shadin
© 2011 – 2018, https:.