ভ্রমণকথা

চিলাহাটীর পথে পথে

সূর্যটা আজ মুখ লুকিয়েছে। আকাশে মেঘের ঘনঘটা। এমনটা হবে আশাই করিনি। গতকালও আকাশ ছিল ফকফকে। ফাগুন মাসের ৪ তারিখ। অথচ ভরা বর্ষার ভাব চারপাশে। কয়েকবছর ধরেই আবহওয়ার এমন বে-হিসেবি নিয়ম চলছে। মেঘ বৃষ্টিতে কিভাবে দেখব চিলাহাটীর সৌন্দর্য। ঢাকা থেকে নীলফামারীর ডোমারে আসাটা কি তাহলে বৃথা হয়ে যাবে। বাস কাউন্টারে বসে এসব এলোমেলো চিন্তাই করছিলাম বার বার।

চিলাহাটী ডোমার উপজেলার একটি ইউনিয়নের নাম। সেখানে বন্ধু মৃদুলদের বাড়ি। সকালের আলো বের হতেই পৌঁছে যাই ডোমারে। ঘুম ঘুম চোখে ভাবছি নানা কিছু। হঠ্যাৎ খেয়াল ফিরে পাই। যুবক বয়সী এক সুদর্শন খোঁজ করছে আমায়। সে বন্ধু মৃদুলের ছোট ভাই সুবল।

সুবল এসেছে আমাকে নিতে। হর্ন বাজিয়ে ব্যস্ত রেলগেইট পার হয়ে চিলাহাটীর দিকে ছুটে চলে সুবলের মটরসাইকেল। কিন্ত খানিক এগোতেই ঝুম বৃষ্টি। রাস্তার পাশে ছোট্ট একটি হোটেল। সেখানে বসে আমরা অপেক্ষায় থাকি বৃষ্টি থামার।

ছনেঢাকা হোটেলটিতে একজনই দোকানী। ভেতরে মাটির চুলোর উপর বড় একটি কড়াই। কাড়াইটিতে ডুবো তেল। গরম তেলে ভাজা হচ্ছে জিলাপী। ভাজা জিলাপীগুলোকে ডুবিয়ে দেওয়া হচ্ছে চিনির শিরায়। এরকম দৃশ্য দেখলে তো জিভে পানি এসে যায়। আমরা আর দেরি করি না। পেটের মধ্যে টপাটপ চালান করে দেই গোটা পাঁচেক জিলাপী।

চিলাহাটী স্টেশন
চিলাহাটী স্টেশন

ডোমার থেকে চিলাহাটী ২০ কিলোমিটার দূরত্বে। বৃষ্টি থামলে আমরা আবারও রওনা হই। পাকা ও মসৃন রাস্তার দুপাশে সবুজ দৃশ্যে ভরা। এক একটি দৃশ্যকে পেছনে ফেলে ছুটে চলি আমরা। চিলাহাটীর চৌড়ঙ্গীর মোড়ে পৌঁছাতে লাগে মিনিট ত্রিশ। মৃদুলদের বাড়িতে চলে জলপান আর খানিকটা বিশ্রাম। অতঃপর বেরিয়ে পড়া।

চৌড়ঙ্গীর মোড় হয়ে উত্তর পাড়ার রাস্তার শেষ প্রান্তে ডাংগাপাড়া সীমান্ত। গোসাইগঞ্জ পাড় হয়ে পাকা রাস্তায় আমরা এগোই সে দিকটায়। রাস্তার দুদিকে ঘন সবুজ গমক্ষেত। ভারী বাতাসে সবুজ জমিনে চলছে ঢেউ ঢেউ খেলা। একটি ধানক্ষেতে দু’চারজন আগাছা তুলছে যতেœর সাথে। ওমা! পাশেই দেখি চারটি সাদা বক একপায়ে দাঁড়িয়ে। তারা পা গেরেছে মাছের আশায়।

রাস্তায় মাঝে মধ্যেই সাইট দিতে হচ্ছে পাট বোঝাই ভ্যানগুলোকে। বোঝা যায় এখানে পাটের চাষ নেহায়েত কম নয়। এখানকার অধিকাংশ বাড়িগুলোর সামনে সারি সারি কলাগাছ। কলার ভারে নুয়েও পড়েছে দু’একটি। এসব দেখতে দেখতেই পৌঁছে যাই মুক্তিরহাটে।

মুক্তির হাট থেকেই এই পথেই রেল যেত ভারতের হলদি বাড়িতে
মুক্তির হাট থেকেই এই পথেই রেল যেত ভারতের হলদি বাড়িতে

মুক্তিযুদ্ধের সময় ভারতের হলদিবাড়ী থেকে ট্রেনিং নিয়ে এ পথেই ঢুকতো মুক্তিযোদ্ধারা। সে থেকেই জায়গার নাম হয়ে যায় মুক্তিরহাট। যুদ্ধের সময় এখানকার রেললাইনের ওপর ফেলা হয় তিনটি বোমা। বোমার আঘাতে তৈরি হওয়া বড় তিনটি গর্ত আমরা ঘুরে দেখি। দেশভাগের পূর্বে এই পথেই রেল যোগাযোগ ছিল ভারতের সাথে। স্থানীয় যুবক মনা। সে জানালো রাস্তাটিই চলে গেছে মাত্র দেড় কিলো ভেতরে। ভারতের মধ্যে। শুনেই আমরা তাকিয়ে থাকি সে দিকটায়।

মুক্তিরহাট থেকে আমরা আসি ডাংগাপাড়ায়। বড় একটি বাঁশঝারের ভেতর দিয়ে এগোতে থাকি সীমান্তের দিকে। চোখের সীমানায় কোন জনবসতি নেই। রাস্তাটি শুকনো বাঁশপাতায় ঢাকা। পা পরতেই চট্ চট্ শব্দে চারপাশের নিরবতা ভাঙ্গে। মনে হচ্ছিল কোন এক সুড়ঙ্গের ভেতর আমরা। সীমান্ত বলে খানিকটা ভয় ভয়ও লাগছিলো।

বাঁশঝারের শেষপ্রান্ত। চোখের সামনেই ভেসে ওঠে ভারতের হলদিবাড়ীর অংশ বিশেষ। হলদিবাড়ী ভারতের কুচবিহার জেলার একটি থানা। বেশ কয়েকবছর আগেও ভিসা নিয়ে ভারতে ঢোকা যেত এ পথে।

সাইকেলে প্যাডেল মেরে যাচ্ছে এক লোকে। নাম নুরুল ইসলাম। কথা হয় তার সাথে। এ সীমান্তের শেষ বাড়িটি তার। দেশভাগের সময় তাদের জায়গা জমির বেশি অংশ চলে যায় ভারতে। সীমান্তের কাটা তারের বেড়া নুরুল ইসলামের আত্মীয়দের মধ্যে বিভেদ টেনেছে। তারা আজ বাংলাদেশী। আর অন্য আত্মীয়রা ভারতীয়। নুরুল ইসলামের কথায় আমরা দীর্ঘশ্বাস ফেলি। ভিন্নরকম অনুভূতি নিয়ে ডাংগাপাড়া থেকে ফিরে আসি গোসাইগঞ্জ বাজারে।

বাজারের ডানদিকের রাস্তা ধরে আমরা যাব সবজীগঞ্জে। মোড়ের মধ্যে এক দোকানীকে দেখি ভাগা বসিয়েছে মাংসের। গরু কিংবা খাসির মাংস নয়। চামড়া ছাড়ানো মুরগির মাংস। মুরগির মাংস বিক্রির এমন দৃশ্য অন্য কোথাও আগে চোখে পড়েনি। মুচকি হেসে মৃদুল জানালো এটি ‘ খাসি মুরগার মাংস’।

চিলাহাটী ফরেস্ট
চিলাহাটী ফরেস্ট

পাকা রাস্তা পেরিয়ে আমরা গ্রামের মেঠোপথ ধরি। রাস্তার পাশে ছনে ছাওয়া একটি বাড়ি চোখে পড়ে। নীল রঙের সীমফুল ঢেকে রেখেছে বাড়ির ঘরগুলোকে। ফুলে ফুলে ঘুরে বেড়াচ্ছে ছোট্ট ছোট্ট মৌমাছিরা। দেখতে বেশ লাগছে। এরকম মনপাগল দৃশ্য দেখতে দেখতে আমরা চলে আসি বড় একটি আম বাগানের ভেতর। দুপাশে সারি সারি আম গাছ। হাজার খানেক গাছের সবগুলো মাঝারি উচ্চতার। বোঝা যায় এটি আ¤্রপালির বাগান। একেবারে মাপ মতো দূরত্বে লাগানো। সাইনবোর্ড থেকে জানলাম এটি ব্র্যাকের হর্টিকালচার।

নার্সারি ওয়ার্কার ইসমাঈলের সাথে কথা হয় আমাদের। প্রতি বছর কয়েক লাখ চারা তৈরি হয় এই বাগান থেকে। মাঝেমধ্যেই এখানে ভিড় জমে যায় পর্যটকদের। বাগানের মাঝ বরাবর রাস্তায় আমরা খানিকটা হেঁটে বেড়াই।

ব্যাকের আম্র কানন
ব্যাকের আম্র কানন

আমবাগানের পাশ দিয়ে যেতে হয় সবজীগঞ্জের ফরেস্টে। কিন্ত ঐ বালুময় পথে যেতে হবে ভ্যানে। আমরা তাই করি। ভ্যানে প্রায় ৩ কিলো ভেতরে যেতেই আমাদের চোখ কপালে ওঠে। প্রত্যন্ত এই চিলাহাটীতে এমন নজরকারা এক বাগান পাব, ভাবতেই পারিনি। প্রথমেই দেখি একটি কড়ইবন। বড় বড় কড়ইগাছ। কয়েক হাজার তো হবেই। বড় বড় গাছের গুড়ির ভেতর দিয়ে পেছনের সবুজ গ্রাম দেখার আনন্দই আলাদা।

খানিকটা ভেতরে এগোই। দেখি ছোট্ট একটি পুকুর। পানি একেবার হলদে রঙের। লাল মাটির আলিঙ্গনেই পানির এমন রঙ হয়েছে। পুকুরের ওপর হেলে পড়েছে কড়ইগাছের একটি ডাল। পানির মধ্যে কালো ছায়া পড়েছে ডালটির। চার-পাঁচটি শালিক সেখানে বসে মনের আনন্দে কিচির মিচির করছে। নীরব বনে শালিকের ডাক। শুনতে বেশ লাগে।

বন্ধু মৃদুল জানালো সচরাচর কোন পর্যটকদের পায়ের ছাপ পড়ে না ভেতরের এই দিকটায়। কষ্টকরে এতো ভেতরে এসে প্রকৃতি দেখার সাধ্যি কার। আমরা বনের আরো গহীনে যেতে থাকি। হঠাৎ আমাদের সামনে দিয়েই দুটি কাঠবিড়ালি ছুটে পালায় পাশের গাছে। তা দেখে তো আমরা অবাক! একটি আবার ডালে বসে আড়চোখে তাকাচ্ছে আমাদের দিকে। আমরা মুচকি হাসি। পাশ থেকে মৃদুল বলে ‘কাঠবিড়ালী কাঠবিড়ালী পেয়ারা তুমি খাও’। মৃদুলের কথায় সে দে ছুট।

সামনের দেবদারু বাগানের দিকে আমাদের চোখ পড়ে। গাছগুলোর উপরের অংশের পাতা বিবর্ণ হয়ে ঝরে পড়েছে। আর গোরা জড়িয়ে মায়াবী বেতের সবুজ গাছগুলো বেয়ে উঠছে উপরের দিকে। দূর থেকে গোটা বাগানটিকেই অন্যরকম লাগে। উপরে বিবর্ণ সুন্দর আর নিচে সবুজের ভালোলাগা। আমরা এগোই। পায়ের তলায় শুকনো পাতাগুলো মচ্ মচ্ করে ওঠে। হঠাৎ দমকা বাতাস। চারদিকে পাতা ঝরার শব্দ। পাতা পড়ার অন্যরকম দৃশ্য। আমরা শুধু ‘ওয়াও’ আর ‘অদ্ভুদ’ শব্দ দুটি বলতে থাকি। বনের মধ্যেই দেখা মিলল বন প্রহরী জয়নাল আবেদীনের। সে জানালো বাগানের ১৫৫ একর জায়গায় কড়ই, জারুল, দেবদারু, ইউকিলপটাস ছাড়াও নানা প্রজাতির গাছ আছে দুলাখের মতো। আছে র্দুলভ প্রজাতির খোপাতি শালিক আর শত শত কাঠ বিড়ালী ও খরগোশ । চিলাহাটী রেলস্টেশন দেখে আমরা দুপুরের খাবার সেরে নেই। দুপুরের পর তদন্ত থানার পাশ দিয়ে আইলের পথ ধরে চলে আসি বালাপাড়া খাখড়াবাড়ি ছিটমহলে। প্রায় আটটি গ্রাম নিয়ে এই ছিটমহল। ছিটমহল মানে, জমি ভারতের কিন্ত চারপাশে বাংলাদেশ। ফলে সরকার ছিটমহলের ভেতরে তৈরি করতে পারছে না কোন স্কুল, হাসপাতাল কিংবা অন্য কোন সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠান। আমাদের দেখে তারা আশা নিয়ে ভিড় জমায়। ছিটমহলের ইউপি মেম্বার সবু জানায় নানা কষ্টের কথা। এখানে চিকিৎসার অভাবে অনেককেই মৃত্যুবরণ করতে হয়। ছিটমহলের শিশুরা বঞ্চিত হচ্ছে শিক্ষা থেকে। আমাদের কষ্ট হয় ছিটের মানুষদের জন্য। মনে মনে ঘৃণা জানাই ব্রিটিশদের প্রতি।

ছিটমহল থেকে যখন ফিরছি তখন আকাশের মেঘ পুরোপুরি কেটে গেছে। চারপাশে বাতাস বইছে। বসন্ত বাতাস ছুঁয়ে দিচ্ছে চিলাহাটীর পথ,ঘাট, প্রান্তর। আনন্দ, হাসি আর মুগ্ধতা নিয়ে আমরা পুরো বিকেলটা ঘুরে বেড়াই চিলাহাটীর পথে পথে।

লিখাটি প্রকাশিত হয়েছে দৈনিক সংবাদ ২৩ সেপ্টেম্বর ২০১১  বাংলানিউজ২৪.কমে ২৭ মার্চ ২০১১

© 2011 – 2018, https:.

এই ওয়েবসাইটটি কপিরাইট আইনে নিবন্ধিত। নিবন্ধন নং: 14864-copr । সাইটটিতে প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো তথ্য, সংবাদ, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করলে আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।

Show More

Salek Khokon

সালেক খোকনের জন্ম ঢাকায়। পৈতৃক ভিটে ঢাকার বাড্ডা থানাধীন বড় বেরাইদে। কিন্তু তাঁর শৈশব ও কৈশোর কেটেছে ঢাকার কাফরুলে। ঢাকা শহরেই বেড়ে ওঠা, শিক্ষা ও কর্মজীবন। ম্যানেজমেন্টে স্নাতকোত্তর। ছোটবেলা থেকেই ঝোঁক সংস্কৃতির প্রতি। নানা সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠনের সঙ্গে জড়িত। যুক্ত ছিলেন বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র ও থিয়েটারের সঙ্গেও। তাঁর রচিত ‘যুদ্ধদিনের গদ্য ও প্রামাণ্য’ গ্রন্থটি ২০১৫ সালে মুক্তিযুদ্ধ ভিত্তিক মৌলিক গবেষণা গ্রন্থ হিসেবে ‘কালি ও কলম’পুরস্কার লাভ করে। মুক্তিযুদ্ধ, আদিবাসী ও ভ্রমণবিষয়ক লেখায় আগ্রহ বেশি। নিয়মিত লিখছেন দেশের প্রথম সারির দৈনিক, সাপ্তাহিক, ব্লগ এবং অনলাইন পত্রিকায়। লেখার পাশাপাশি আলোকচিত্রে নানা ঘটনা তুলে আনতে ‘পাঠশালা’ ও ‘কাউন্টার ফটো’ থেকে সমাপ্ত করেছেন ফটোগ্রাফির বিশেষ কোর্স। স্বপ্ন দেখেন মুক্তিযুদ্ধ, আদিবাসী এবং দেশের কৃষ্টি নিয়ে ভিন্ন ধরনের তথ্য ও গবেষণামূলক কাজ করার। সহধর্মিণী তানিয়া আক্তার মিমি এবং দুই মেয়ে পৃথা প্রণোদনা ও আদিবা।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

Back to top button