সীমান্তবর্তী আদিবাসীদের কথা
শেরিফ আল সায়ার
বাংলাদেশে আদিবাসীদের নিয়ে কাজ হয়েছে অনেক। কাজ চলছেও। বহু গবেষক কিংবা সামাজিক আন্দোলনের সাথে জড়িত মানুষরা ছুটে যাচ্ছেন বাংলাদেশের সীমান্তবর্তী
অঞ্চলগুলোতে, যেখানে পৃথিবীর সুযোগ-সুবিধা থেকে অনেক দূরে অবস্থান করছে আমাদের আদিবাসীরা। নিজস্ব সংস্কৃতি-ভাষা-আচার-অনুষ্ঠান নিয়ে এখনও কোনোমতে বেঁচে আছেন তারা। তবে অনেকেই ধীরে ধীরে লুপ্ত হতে চলেছেন। হারিয়ে যেতে শুরু করেছে তাদের ভাষা থেকে শুরু করে নিজস্ব আদি ভাবনাগুলো। এদের এখন বলা হয় সংখ্যালঘু। তাদের আবাসভূমি দখল হয়ে যাচ্ছে রাজনীতির কাছে।
পাহাড়ের কোল ঘেঁষে তাদের বসবাস। সেই পাহাড়ও এখন ভূমিদস্যুদের হাতে চলে যাচ্ছে। আর তাই হুমকির মুখে পড়েছে তাদের অস্তিত্ব। তাদের হারিয়ে যেতে বসা ঐতিহ্য নিয়ে কাজ করছেন সালেক খোকন। দীর্ঘদিন সীমান্তবর্তী এলাকাগুলোতে যুব উন্নয়ন অধিদপ্তরের হয়ে কাজ করছেন তিনি। আর সেই অভিজ্ঞতা থেকে কিংবা বলা যেতে পারে সেই সব অসহায় মানুষের টানেই তাদের জীবন-জীবিকা নিয়ে লিখে চলেছেন লেখক।
এবারের বইমেলায় আদিবাসীদের নিয়ে সালেক খোকনের প্রথম প্রকাশিত বই ‘আদিবাসী মিথ এবং অন্যান্য’। বইটিতে আছে ২৭টি গদ্য। এর সবই আদিবাসীদের বিভিন্ন ধ্যান-ধারণা, আচার-অনুষ্ঠান, বিশ্বাস, ভাষা, এমনকি কয়েকজন আদিবাসী মুক্তিযোদ্ধার গল্পও উঠে এসেছে।
প্রথম গদ্যটি হচ্ছে ‘আদি বিশ্বাসের আদি মানুষেরা’। এই লেখায় উঠে এসেছে কড়া সম্প্রদায়ের কথা। বিলুপ্তপ্রায় এই সম্প্রদায়ের মাত্র ১৯টি পরিবার অবশিষ্ট আছে। তাদের নাম কেন ‘কড়া’ হয়েছে এর ব্যাখ্যাও সুস্পষ্ট করে দিয়েছেন লেখক। ‘কড়া’ অর্থ হলো ‘মাটি খোঁড়া’।
একসময় ইংরেজরা চলাচলের সুবিধার্থে ট্রেন চালুর কথা ভাবে। মাটি কেটে, পাহাড় কেটে রেললাইন স্থাপন করা হবে। সেই সময় এই সম্প্রদায়ের পূর্বপুরুষেরা আসেন বাংলায়। জীবিকার তাগিদে কড়া সম্প্রদায়ের হাজার হাজার মানুষ আসেন শুধু রেললাইন স্থাপনের কাজ করার জন্য। সেই থেকেই তাদের নাম কড়া। এমনই বিশ্বাস তাদের। তাহলে বলতে হয়, বাংলাদেশের অধিকাংশ রেললাইনের পেছনে আছে কড়া সম্প্রদায়ের পরিশ্রম-ঘাম। আবার আদিবাসীদের ভাষার ব্যবহার নিয়েও লেখা রয়েছে। লেখক আদিবাসীদের ভাষাকে উল্লেখ করেছেন বর্ণহীন বলে। চাকমা-সাঁওতাল-মারমা-গারো ইত্যাদি বিভিন্ন ভাষার বিভিন্ন ব্যবহার তুলে ধওেছেন তিনি ‘বর্ণহীন ভাষার আদিবাসীরা’ লেখায়।
‘সাঁওতাল সর্দার পাঁড়ু রাজার বিদ্রোহ’ লেখাটি পড়ে পাঠক খুঁজে পাবেন ইতিহাসের এক অজানা অধ্যায়ের। আমরা সবাই জানি, ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলন থেকে শুরু করে ’৭১-এর স্বাধীনতা যুদ্ধে অংশ নিয়েছিলেন আমাদের আদিবাসীরা। কিন্তু সংখ্যালঘু বলে তাদের নিয়ে খুব একটা ভাবা হয় না। এটাই হয়তো তাদের নিয়তি। পাড়ু রাজা ছিলেন সাঁওতালদের সর্দার। ব্রিটিশদের সময় সবাইকে খাজনা দিতে হতো। পাঁড়ুই প্রথম খাজনা দেওয়া থেকে বিরত হলেন। আর সব সাঁওতালদের বললেন ব্রিটিশদের খাজনা না দিতে। আশেপাশের সব গ্রামে শুরু হয়ে যায় বিদ্রোহ। সবাই খাজনা দেওয়া বন্ধ কওে দেন। ব্রিটিশরা ুব্ধ হয়। কলকাতা থেকে অতিরিক্ত সৈন্য নিয়ে এই বিদ্রোহকে সামাল দেওয়া হয়। গ্রেফতার করা হয় পাঁড়ুকে। একসময় তাকে ছেড়েও দেয় ব্রিটিশরা। কিন্তু বিপ্লবীরা অনেক সময় খুন হন নিজের মানুষের কাছে। এটা তো ইতিহাসের পরিণতি। পাড়ুরও একই পরিণতি হলো। স্থানীয় শত্রুতার জের ধরে তাকে কুপিয়ে হত্যা করা হলো। পাঁড়ুর কথা ইতিহাস থেকে হারিয়ে গেল।
এভাবেই একের পর এক অজানা তথ্য পাঠকের সামনে উন্মুক্ত হতে থাকবে ‘আদিবাসী মিথ এবং অন্যান্য’ বইটি পড়ার সময়। উঠে আসবে সতেন কড়া ও থোপাল কড়া নামে দুজন মুক্তিযোদ্ধার গল্প। এরা কেউ নিজেদের মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে পরিচয় দেন না। কারণ তারা যুদ্ধ করেছেন দেশ স্বাধীন করার জন্য। ব্যক্তিগত কোনো প্রাপ্তির আশায় তারা যুদ্ধ করেননি। মুক্তিযুদ্ধ সনদের বিষয়টিও তাদের কাছে খুব একটা স্পষ্ট নয়। তাই সেদিকেও ভাবনা তাদের নেই। তবে তাদের যুদ্ধ শেষ হয়নি। কড়া সম্প্রদায়ের এই দুই যোদ্ধা এখনও যুদ্ধ করছেন তাদের নিজেদের অস্তিত্ব রার জন্য। কারণ, শুরুতেই বলেছি, বাংলাদেশে কড়া সম্প্রদায়ের ১৯টি পরিবার অবিশিষ্ট আছে, যার মধ্যে ১৭টি দিনাজপুরের সীমান্তবর্তী এলাকায়।
সীমান্তবর্তী এলাকায় শিক্ষাগ্রহণ অনেকটা চাঁদ হাতে পাওয়ার মতো। আর তা যদি হয় আদিবাসীদেও, তাহলে বলতে হয় চাঁদের দেখাই তারা পায়নি। ‘আদিবাসী শিশুশিক্ষা : বাংলা ভাষার জাঁতাকলে’ লেখাটি পড়লে পাঠক ভয়াবহ তথ্য আবিষ্কার করবেন। ব্রিটিশ আমলের মতো এখনও মানুষকে ধর্মান্তরিত করা হচ্ছে। অধিকাংশ আদিবাসী খ্রিষ্টান ধর্মে রূপান্তরিত হয়ে যাচ্ছে। অভাবের তাড়নায় তাদের এই পরিণতি সত্যিই ভয়ঙ্কর। আর শিক্ষার ক্ষেত্রে তো ব্যাপারটা অগ্রহণযোগ্য। কারণ, যে দেশের মানুষ ভাষার জন্য প্রাণ দিয়েছেন সেই দেশেরই সরকার আদিবাসীদের নিজস্ব ভাষায় শিক্ষা ব্যবস্থার ক্ষেত্রে তেমন অবদান রাখতে পারছে না। এর হিসাব পাওয়া যায় লেখকের অভিজ্ঞতা থেকে। একটি পরীক্ষাকেন্দ্রে গিয়ে তিনি দেখেন মোট ৩৩৯ জন শিক্ষার্থীর মাঝে মাত্র ১০ জন আদিবাসী পরীক্ষা দিচ্ছে। এছাড়া নিজস্ব ভাষায় শিক্ষার সুযোগের অভাবে অসংখ্য আদিবাসী শিক্ষার্থী সহজেই আগ্রহ হারিয়ে ফেলে শিক্ষার প্রতি।
এমনই সব তথ্য পাঠকের সামনে নিয়ে আসার চেষ্টা করেছেন লেখক সালেক খোকন। কখনও ভ্রমণ কাহিনীর মতো করে, কখনও গল্পের ছলে তিনি বর্ণনা করেছেন সীমান্তবর্তী আদিবাসীদের কথা।
লিখাটি প্রকাশিত হয়েছে বাংলানিউজ২৪.কমে ১৭ মার্চ ২০১১, সাময়িকীতে ০৯ এপ্রিল ২০১১
© 2011 – 2018, https:.