স্বপ্ন পূরণের জন্য মেডিটেশন
মঞ্চে উঠেই সৈয়দ হারুন কথা শুরু করেন। কখনও হাসিমুখে। কখনও গম্ভীরভাবে। মানুষের জীবনে সমস্যা দুটি। কথা শুনে আমরা মুখ চাওয়া চাওয়ি করি। একটি হলো ‘কী করব জানি না’। অন্যটি ‘কীভাবে করব জানি না’। তিনি বলতে থাকেন। আমরা নিজের খবর নিজেই রাখি না। জানিই না আমরা কী শক্তি নিয়ে বসে আছি। হতাশা, ভয়, পাওয়া না পাওয়ার অতীত আর ভবিষ্যতের শংকায় আমরা মুষড়ে পড়ি। দিন যত এগোয় সময় তত বদলায়। কিন্ত বদলায় না নিজের ভেতকার পদ্ধতিগুলো। ফলে না পাওয়া কিংবা অধিক পাওয়ার আকাঙ্খা আমাদের অস্থির করে তোলে। আমরা ক্রমেই হারিয়ে ফেলি শরীর ও মনের নিয়ন্ত্রণ।
কথাগুলো নতুন। চারপাশে যখন লক্ষ-কোটি ‘না’ এর বসবাস তখন ‘হ্যাঁ’ বোধক কিছু শুনলেই নতুন মনে হয়। সকালে পত্রিকা খুললেই ‘না’ বোধক আর ভয়ংকর সব খবর। টিভি অন করলে একই দশা। নাটকগুলোতে উচ্চবিত্তদের প্রেম কাহিনী আর বিলাসী জীবনের রঙচটা প্রকাশ মধ্যবিত্ত আর নিন্মবিত্তদের দীর্ঘশ্বাস ওঠায়। নাটকের ফাঁকে মিথ্যাচারে পূর্ণ বিজ্ঞাপনের থাবা আমাদের শিশুদের মনে কী যে সর্বনাশ করছে, সে খেয়ল কে রাখে।
সৃষ্টির সেরা মানুষ এখন নিজেকে নিয়ে ব্যস্ত। লাভের আশায় সবখানে চলছে ভেজালের শিল্প। মাছে ভেজাল। ওষুধে ভেজাল। ফলে ভেজাল। খাবারে ভেজাল। মাছওয়ালা ওষুধ খায়, ওষুধওয়ালা মাছ। ফলওয়ালা খাবার খায়, খাবার ওয়ালা খায় ফল। তাহলে কে কাকে ঠকায়?
আপন মনেই ভাবছিলাম এসব। সৈয়দ হারুন তখন বলছিলেন স্বপ্নপুরণের কথা। শত সমস্যায় কীভাবে নিজের মন ও শরীরকে নিয়ন্ত্রণে রেখে অগ্রসর হওয়া যায় নিজের লক্ষ্যের দিকে। কীভাবে সবকিছুতে নিজেকে পজেটিভ রাখা যায়। সঠিক সময়ে নেয়া যায় জীবনের সঠিক সিদ্ধান্তটি। তিনি বলেন হোঁজে সিলভার আবিস্কৃত পদ্ধতিটি।
মানুষের ব্রেইন ফ্রিকোয়েন্সি নিয়ন্ত্রণে রেখে শরীর ও মনকে সুস্থ রাখা যায়। ব্রেইন ফ্রিকোয়েন্সি প্রতি সেকেন্ডে ১৪ বা তদূর্ধবার স্পন্দিত লেভেলকে বলা হয় ‘বিটা’ লেভেল। এই লেভেলে ব্রেইন ফ্রিকোয়েন্সি যত বাড়তে থাকে মানুষের শরীরে তত ইনব্যালেন্সি তৈরী হতে থাকে। মানুষ তখন হয়ে ওঠে অস্থির ও উত্তেজিত। এভাবেই এক সময় সে আর নিজেকে ধরে রাখতে পারে না। তাই বিটা লেভেলে মানুষ ঘটায় নানা অঘটন। টেনশনের সময়ও মানুষের ব্রেইন ফ্রিকোয়েন্সি একইভাবে বেড়ে যায়। এতে ঘটে স্ট্রোক ও হার্ট এ্যাটাকের মতো ঘটনা। তাই ব্রেইন ফ্রিকোয়েন্সি নিয়ন্ত্রণে রাখা খুবই প্রয়োজন।
হোঁজে সিলভার ব্রেইন এ্যাবুয়েলেশন চার্ট অনুসারে প্রতি সেকেন্ডে ৭ থেকে ১৪ বার স্পন্দিত ব্রেইন ফ্রিকোয়েন্সি লেভেলকে বলা হয় ‘আলফা’ লেভেল। এটি সবচেয়ে কার্যকরী লেভেল। যে কোন সিদ্ধান্ত গ্রহণে বা সমস্যা সমাধানের উপযোগি লেভেল। ব্রেইন ফ্রিকোয়েন্সি প্রতি সেকেন্ডে ৪ থেকে ৭বার স্পন্দিত লেভেলটি ‘থিটা’ লেভেল। উন্নত দেশে যে সকল রোগীকে এ্যানেসথেসিয়া দেয়া সম্ভব হয়না তাদেরকে বিশেষ ব্যবস্থায় থিটা লেভেলে এনে ব্যথা মুক্ত সার্জারী করা হয়।
সবশেষ বা প্রতি সেকেন্ডে ১/২ থেকে ৪ বার স্পন্দিত ব্রেইন ফ্রিকোয়েনন্সির লেভেলটি ‘ডেল্টা’। হোঁজে সিলভার ভাষায় এই পর্যায় থেকে স্পিরিচুয়্যাল ডাইমেনশনে উচ্চ বুদ্ধি সম্পন্ন অতীন্দ্রিয় সত্ত্বার সাথে যোগাযোগ করতে পারা যায়। মন নিয়ন্ত্রণে হোঁজে সিলভার সর্বশেষ আবিষ্কার আলট্রা মাইন্ড ইএসপি সিসটেমে এই লেভেলে কাজ করা শেখানো হয়। বিশ্বের ৪০টি দেশের মতো বাংলাদেশে আলট্রা মাইন্ড ইএসপি কোর্সটির কান্ট্রি সুপারভাইজার ও একমাত্র প্রশিক্ষক এই সৈয়দ হারুন। কোর্সটির আয়োজক এমকিউ মিশন (৬/১০, ব্লক- এ, লালমাটিয়া, ঢাকা, মুঠোফোন : ০১৯১৫ ৪৯০৫৪১)।(সুত্র: www.silvaultramind.com)।
সৈয়দ হারুন বলেন, ‘মেডিটেট হয়ে শরীরের কোটি কোটি সেলকে কমান্ড করতে পারলে বিস্ময়করভাবে মানুষের নানা নেগেটিভিটিসহ শারীরিক ও মানসিক আসক্তি দূর হয়ে যায়। ফলে গভীর রিল্যাক্সজেশনের মাধ্যমে টেনশন, নিদ্রাহীনতা, মাথাব্যাথা, মাইগ্রেন, মাদকাসক্তিসহ যে কোন মানসিক চাপ থেকে মুক্তি মিলে।’ প্রতিদিন কয়েক মিনিটে পদ্ধতি নিয়মিত অনুশীলনে হতাশা,বিষন্নতা,নার্ভাসনেস,রাগ,ক্ষোভ,হিংসা,উত্তেজনা প্রভৃতি শুধু দূরই হয় না বরং মানুষের সাইকিক এ্যাবিলিটি বৃদ্ধি পায় অকল্পনীয়ভাবে। এতে অন্যের জন্য, অন্যের কল্যাণের জন্য মানুষের মনে পজেটিভ এ্যানর্জির সঞ্চার ঘটে। হোজেঁ সিলভা তার পদ্ধতিতে বলছেন, ‘তুমি অন্যের সাথে ঠিক সেই ব্যবহার কর যে ব্যবহারটি তুমি তার কাছ থেকে আশা কর।’ এতে মানুষের ব্যক্তিগত, দাম্পত্য ও পারিবারিক সম্পর্কসহ সকল সামাজিক সম্পর্কগুলো উন্নত ও সুন্দর হয়। পৃথিবীর প্রতিটি মানুষকে বয়সানুপাতে নিজের বাবা-মা, ভাই-বোন অথবা নিজের সন্তানের সমান মনে করতে বলেছেন হোঁজে সিলভা। তবেই মানুষ হয়ে উঠবে সুস্থ, সতেজ, প্রাণবন্ত ও তারুণ্যদীপ্ত। জীবন হয়ে উঠবে স্বপ্নের মতোই সাফল্যময়।
টি-ব্রেকে আমরা আলাপ জমাই আগতের সাথে। সাধারণ শ্রেণী থেকে খ্যাতিমান প্রায় ২০০ লোক হল-রুমটিতে। পেছনের দিকে বসা চিত্রনায়ক ইলিয়াস কাঞ্চন ও রিয়াজ। রিয়াজের সাথে আমাদের আলাপ হয়। তিনি বলেন ‘পেশাগত জীবনে পাইলটের চাকুরী ছেড়ে যখন আমি চলচ্চিত্র জগতে আসি তখন বেশ দুঃচিন্তাগ্রস্থ ছিলাম। আলট্রা মাইন্ড কোর্সটির নিয়মিত চর্চায় সে দুঃচিন্তা নাই বললেই চলে। এছাড়া ইমাজিনেশন ও ভিজ্যুলাইজেশন শক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে আমি যে কোন অভিনয় অল্পসময়ে চমৎকারভাবে করে ফেলতে পারি। আমি মনে প্রাণে বিশ্বাস করি চলচ্চিত্রে আমার সফলতার প্রধান সহায়ক শক্তি আলট্রা মাইন্ড সিসটেম’।
কাদের জন্য কোর্সটি উপযোগী? এমন প্রশ্নে রিয়াজ মুচকি হেসে বলেন, ‘বিশেষ করে ঐ সকল মানুষদের যারা অনেক মানুষের ভাগ্যকে নিয়ন্ত্রণ করে। এদেশের রাজনৈতিক দলের নেতানেত্রী এবং সরকারের উচ্চ পদস্থ কর্মকর্তাদের কোর্সটি করাতে পারলে দেশের আরো মঙ্গল হতো। কেননা এই কোর্সটি করার পর মানুষের অমঙ্গলের জন্য কোন কাজ করতে পারা যায় না। অনেকেই বলে বাঙালিরা অন্যের ভালো দেখতে পারে না। কিন্তু মেডিটেশন অন্যের ভালোর জন্য চিন্তা করতে শেখায়। তাই এটি সকলের জন্য নিশ্চয়ই কল্যাণকর’।
দরজা ঠেলে ঢুকলো পরিচিত এক মুখ। তিনি কন্ঠশিল্পী শাহীন সামাদ। কথা হয় তার সাথে। তিনি বললেন ঠিক এইভাবে, ‘গতকাল সারারাতই নানা ব্যস্ততায় কেটেছে, একফোটা ঘুমাতে পারিনি। কিন্ত আজ এই বিকেল পর্যন্ত আমাকে কী মনে হচ্ছে আমি ক্লান্ত। এটিই মেডিটেশন’।
সাধারণ পোষাকের এক বৃদ্ধা কথা বলছেন মাঝ বয়সী এক যুবকের সাথে। তাঁর সাথে কথা হয় আমাদের। আলাপ জমতেই অবাক হই। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বায়োকেমিষ্ট্রি ডিপার্টমেন্টের প্রফেসর খন্দকার আব্দুর রহিম। তিনি কয়েকবছর আগের কথা জানিয়ে বললেন, ‘আমার বিভাগের ছাত্র-ছাত্রীরা কেন জানি আশানুরূপ রেজাল্ট করছিল না। আমি এর কারণ খুঁজতে গিয়ে দেখলাম তারা প্রায় প্রত্যেকেই নানা মানসিক সমস্যা মাথায় নিয়ে পড়াশুনা করছে। আমরা শিক্ষকরা তাদের ব্যক্তিগত সমস্যাগুলোকে জানার বিষয়ে তেমন পাত্তা দেই না। শুধুমাত্র কিছু উপদেশ দিয়েই নিজের দায়িত্ব শেষ মনে করি। তাদের মানসিক সমস্যা সমাধানের লক্ষ্যে ইন্টারনেট থেকে মন বিষয়ক নানা তথ্য সংগ্রহ করছিলাম। ছাত্র-ছাত্রীদের মানসিক সমস্যা সমাধানের ইচ্ছা নিয়ে কোর্সটি করতে এসে দেখলাম আমি নিজেই নিজের অনেক সমস্যা সমাধান করতে পারছি। আগে আমি ছিলাম যে কোন বিষয়ে অতিমাত্রায় নেগেটিভ। এখন আমি প্রায় প্রতিটি বিষয়েই পজেটিভ চিন্তা করতে শিখেছি ’।
স্যারের পরে আমাদের সাথে কথা হয় একজন ডাক্তারের। তিনি হোলি ফ্যামিলির ডাঃ মোস্তাফিজুর রহমান। তিনি বলেন, ‘এদেশে ডাক্তারদের মন বিষয়ক জ্ঞানের ঘাটতি রয়েছে। ছাত্র অবস্থা থেকে ডাক্তার হওয়া পর্যন্ত আমরা শুধু শরীর নিয়েই নড়াচড়া করছি। কিন্ত মাইন্ড এর মতো বড় একটি বিষয় নিয়ে জানার সময় নেই আমাদের। অথচ আমরা যখন শরীরের ভেতরের কোন একটি অংশ কেটে ফেলি তখন কীভাবে সে কাটা অংশ শুকিয়ে যায়। আমরা কী কখনই সেটা চিন্তা করেছি। আসলে শরীরই শরীরকে হিলিং করে। তবে বর্তমানে এদেশের তরুণ ডাক্তারদের মধ্যে এ বিষয়ে সচেতনতা বৃদ্ধি পাচ্ছে। আমি মনে করি, যে যত বেশী মন বা মেডিটেশন বিষয়ে জানবে সে তত ভালো ডাক্তার হবে। একজন মানুষের সুস্থতার জন্য যেমন ঔষধের প্রয়োজন, তার চেয়ে বেশী প্রয়োজন সঠিক মেডিটেশন। আর আধুনিক মেডিকেল সায়েন্সও তাই বলছে’।
আমাদের প্রত্যেকেরই ব্যক্তিগত,পারিবারিক ও সামাজিক জীবনে রয়েছে নানা সমস্যা। প্রত্যেকেই চাই এই সমস্যাগুলোর শান্তিময় সমাধান। চাই রোগহীন চিন্তামুক্ত জীবন। না পাওয়ার বেদনা আমাদেরকে করে তুলেছে অস্থির। ফলে আমরা ধীরে ধীরে হারিয়ে ফেলছি নিজের আত্মবিশ্বাসটুকু। ফলে মনের স্বপ্নগুলো স্বপ্নই থেকে যাচ্ছে। অপরের ভাল ও কল্যাণের কথা চিন্তা করার মানসিক সক্ষমতা আমাদের মাঝে লোপ পাচ্ছে প্রবলভাবে। ফলে ক্রমেই ম্লান হয়ে যাচ্ছে মানবতা বোধটুকু। ঔষধ, ডাক্তার, ফকির, পাথর প্রভৃতির ওপর আমরা নির্ভর করছি, করছি অগাত বিশ্বাস। কিন্তু নিজের মানসিক শক্তির উপর বিশ্বাস থাকছে না বিন্দুমাত্র। অন্যরকম এক আমি যেন ফিরছি। ভাবছি এখনই সময় নিজেকে জানার। দৃষ্টিভঙ্গিটাকে বদলানোর। জীবনের বাকী সময়টুকুকে জীবনের শ্রেষ্ঠসময় রুপে গড়ে তোলার। তাই হতাশা, ব্যর্থতা আর দুঃখবোধগুলোকে বিদায় করে দিন। হয়ে উঠুন পরিশুদ্ধ, তারুণ্যদীপ্ত, সফল ও প্রাণবন্ত একজন মানুষ। দেখবেন স্বপ্নপূরণ তখন হাতের মুঠোয়।
ছবি : এমকিউ মিশন
লিখাটি প্রকাশিত হয়েছে বাংলা নিউজ২৪.কমে, প্রকাশকাল: ২৮ মে ২০১১
© 2011 – 2018, https:.