সরকারি উদ্যোগ ও আদিবাসীদের স্বপ্নগুলো
বাজারের ঠিক মাঝেই বটগাছটি। শাখা প্রশাখার অবয়বই বলে দেয় গাছটি শতবর্ষী। বটের ছায়ায় আয়েশি ঢঙে বসা এক যুবক। সাদাসিধে পোশাক। পাশের পুকুরপানে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে। কী যেন ভাবছে সে। আমাদের পায়ের শব্দে তার মনোযোগ ভাঙে। অপরিচিত মুখগুলো দেখে অবাক হয়। খানিকটা ভয়ও। বসা থেকে দাঁড়িয়ে বিনীত ভঙ্গিতে বলে ‘জোহার’। এই গ্রামের নাম কী? প্রশ্ন শুনেই উত্তরে বলে, ‘ই পাদ্দা ঘি নাম বোগলডিঘী।’ আমরা একজন আরেকজনের দিকে তাকাই। বোঝার চেষ্টা করি। কিন্তু বুঝে উঠতে পারি না। কুদ্দুস আসতেই সবকিছু খোলাসা হয়। যুবকটি তার পরিচিত। কুদ্দুস জানাল পাশের ওঁরাও সম্প্রদায়ের আদিবাসী সে। নাম নিপেন টিগ্গা। নিপেনের ওঁরাও ভাষায় উত্তরটির অর্থ হলো ‘এই গ্রামের নাম বহবলদিঘী’। নিপেনকে সঙ্গে নিয়ে আমরা বাজুন মার্ডির বাড়ির দিকে এগোই।
দিনাজপুরের বহবলদিঘী একেবারেই সীমান্তঘেঁষা। এখানে ব্রিটিশ আমলেরও পূর্ব থেকে নানা ভাষাভাষী আদিবাসীদের বাস। পাড়াভেদে বাস করে এরা। স্ব স্ব ধর্ম আর সংস্কৃতিকে বাঁচিয়ে রেখে দরিদ্রতার সঙ্গে প্রতিনিয়ত সংগ্রাম করে বেঁচে আছে এখানকার আদিবাসীরা। এখানে আছে ওঁরাও, সাঁওতাল, মুন্ডা, ভুনজার, কড়াসহ নানা সম্প্রদায়ের আদিবাসীরা।
বহবলদিঘীর আদিবাসীরা অধিকাংশই ভূমিহীন কৃষক। এরা অন্যের জমিতে আধিয়ার খেটে জীবন চালায়। ফলে ফসল তোলা আর লাগানোর সময় ছাড়া বাকিটা সময় এরা থাকে কর্মহীন। সে সময় আশপাশ থেকে সংগ্রহ করা শাকপাতা আর বনের জংলি আলু খেয়ে এরা জীবন চালিয়ে নেয়। বছর বছর সরকার থেকে যৎসামান্য অনুদান কিংবা সাহায্য মিললেও আদিবাসীদের প্রয়োজন কাজের।
প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে দেশের ২৩টি উপজেলায় আদিবাসীদের ভাগ্যোন্নয়নের জন্য চালু করা হচ্ছে আয়বৃদ্ধিমূলক একটি করে প্রকল্প। আদিবাসীরাই এই প্রকল্পে কাজ করবে। প্রকল্পে যে লাভ হবে তাও বণ্টন করা হবে আদিবাসীদের মধ্যেই। ফলে সারা বছরের জন্য কাজের সুযোগ ও আদিবাসীদের স্থায়ী আয়ের পথ তৈরি হবে।
সে হিসেবে বিরল উপজেলার আদিবাসীদের জন্য বহবলদিঘীতে তৈরি করা হবে ১৬টি গরু নিয়ে একটি ডেইরি প্রকল্প। প্রকল্পটি পরিচালনা করবে হামরা দিনাজপুরিয়া আদিবাসী সমবায় সমিতি লিঃ। প্রকল্পটির জন্য ইতোমধ্যে বরাদ্দ করা হয়েছে ১৪ লাখ টাকা। তার মধ্যে স্থাপনা ও অন্যান্য খরচ বাদে গরু কেনা হবে সাড়ে চার লাখ টাকায়। প্রকল্পে গরুর বর্জ্য দিয়ে তৈরি করা হবে একটি বায়োগ্যাস প্লান্ট, যা থেকে আদিবাসীরা রান্না ও বিদ্যুতের কাজ চালাতে পারবে। এক বছর পর্যন্ত প্রকল্পের যাবতীয় খরচ বহন করবে সরকার। পরবর্তীতে আদিবাসী সমিতিটিকে প্রকল্পের আয় থেকে কিস্তিতে শুধু গরু কেনার সাড়ে চার লাখ টাকা পরিশোধ করতে হবে। এই টাকা দিয়ে আবার সরকারিভাবে আদিবাসীদের জন্য আরো প্রকল্প গড়ে তোলা হবে। কথাগুলো বলছিলেন বিরল উপজেলার নির্বাহী অফিসার মো. গোলাম রাব্বী।
আদিবাসীদের প্রকল্পের জন্য জায়গা মিল ছিল না বহবলদিঘীতে। এই সময় আদিবাসীদের সাহায্যে এগিয়ে আসে এক সাঁওতালী। তার নাম বাজুন মার্ডি। তিনি আদিবাসীদের ডেইরি প্রকল্পের জন্য জমি দিতে রাজি হন। উপজেলা নির্বাহী অফিসার ও স্থানীয় পত্রিকার সাংবাদিক কুদ্দুসের সঙ্গে আমরা দেখতে আসি আদিবাসীদের ডেইরি প্রকল্পের জায়গাটি।
বাজুন মার্ডি বাড়ির পাশেই আদিবাসীদের একটি কমিউনিটি সেন্টার। এই জায়গাটিও বাজুন মার্ডির দেয়া। কমিউনিটি সেন্টারে বিভিন্ন সম্প্রদায়ের আদিবাসীরা অপেক্ষা করছে। উপজেলা নির্বাহী অফিসার প্রকল্পের বিষয়ে আগতদের সঙ্গে আলোচনায় বসে। আমরা তখন ওঁরাও পাড়ার নিপেনকে সঙ্গে নিয়ে আলাপ জমাই কয়েকজন আদিবাসীর সঙ্গে।
হালজায় কড়া পাড়া থেকে এসেছে কৃষ্ণ কড়া। হালজায়র কড়া পাড়াটি সকলের অতি পরিচিত। সেটি হওয়াও স্বাভাবিক। এদেশে টিকে থাকা কড়া সম্প্রদায়ের ১৯টি আদিবাসী পরিবারের মধ্যে এখানে রয়েছে ১৬টি পরিবার। সে হিসেবে এটিই আদিবাসী কড়াদের একমাত্র পাড়া।
অন্যান্য সম্প্রদায়ের আদিবাসীদের মতো দরিদ্রতা আর অবহেলা থাকলেও কড়ারা আজ জেগে উঠেছে ভিন্নভাবে। কড়া পাড়ার শিক্ষিত যুবক এই কৃষ্ণ। সে জানাল নিজের কথাগুলো।
শিতা কড়া আর কোলো কড়ার আদরের সন্তান কৃষ্ণ কড়া। কৃষ্ণ একটু বড় হতেই সন্তানকে নিয়ে বাবার স্বপ্ন বেড়ে যায়। ছেলে বাবার সঙ্গে কাজে যাবে, পরিবারের আয় বাড়বে। সবাই ভালো থাকবে। কিন্ত বাবার স্বপ্নকে দুঃস্বপ্ন করে মা কোলো কড়া কৃষ্ণকে পাঠায় স্কুলে। ছেলে শিক্ষিত হলে কড়াদের কেউ ঠকাতে পারবে না। শিক্ষার আলোয় আলোকিত হবে আদিবাসীরা। ছেলেকে নিয়ে কোলোর স্বপ্ন ছিল তেমনটাই।
রাঙ্গন সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে প্রথম দিনেই কৃষ্ণ যেন সাগরে পড়ে। কৃষ্ণ দেখল তার মায়ের কড়া ভাষায় সেখানে কেউ কথা বলে না। বন্ধুরা সকলেই বাঙালি। ফলে জাত যাওয়ার ভয়ে কৃষ্ণকে এড়িয়ে চলে সকলেই। কৃষ্ণ কষ্ট পায়। কিন্তু মায়ের উৎসাহে সাহস হারায় না। ফলে এক বেঞ্চিতে বন্ধুবিহীন একাই কাটিয়ে দেয় সে। অজানা বাংলাভাষা বুঝে পরীক্ষায় পাস করা সে এক দুরূহ ব্যাপার! তাই পাস ফেলের মধ্যেই কেটে যায় ৫টি শ্রেণী।
হালজায় হাইস্কুলে ষষ্ঠ শ্রেণীতে ভর্তি হয় কৃষ্ণ। কয়েকজন বাঙালি ছেলের সঙ্গে বন্ধুত্ব হয় তখন। বন্ধুর সম্পর্ককে জাত-ধর্মের ঊর্ধ্বে রাখে তারা। এভাবে প্রিয় বন্ধু হিনু, সুদেব আর হান্নানের সঙ্গে আনন্দ হাসিতে কেটে যায় কৃষ্ণর দিনগুলো।
ম্যাট্রিক পাস করতে না পারলেও কৃষ্ণর জীবনের কোনো ছন্দপতন ঘটেনি। মায়ের স্বপ্নেও ভাটা পড়তে দেয়নি কৃষ্ণ। কাজের ফাঁকে ফাঁকে নিজ সম্প্রদায়ের শিশুদের অক্ষরজ্ঞান দেয়া শুরু করে সে। ক্রমেই গোত্রের প্রধানসহ সকলেই নানা বিষয় জানতে নির্ভর করে কৃষ্ণর ওপর।
কারো কোনো রোগ হলে ঝাড়ফুঁক নয়, কৃষ্ণ নিয়ে যায় হাসপাতালে। জমি সংক্রান্ত বিরোধে থানা বা প্রশাসনের সঙ্গে কথা বলা, সাংবাদিকদের কাছে খবর পৌঁছানো, শিশুদের অপুষ্টি দূর করতে সচেতনতা আর যে কোনো অন্যায়ে প্রতিবাদ গড়তে কড়াদের সাহস জোগায় কৃষ্ণ।
কৃষ্ণ এখন কড়া পাড়ার মধ্যমণি। নিজ পাড়ার এনজিও স্কুল ছাড়াও পাশের গ্রামের মানিয়ভিটা আদিবাসী স্কুলে শিশুদের পড়ায় সে। কৃষ্ণ জানাল শিক্ষার আলো আদিবাসীদের মধ্যে পৌঁছলেই আদিবাসীরা আর পিছিয়ে থাকবে না। কড়া পাড়ায় এখন শিশুদের সংখ্যা ষোলর মতো। এর মধ্যে সুজন কড়া আর সাপোল কড়া পড়ছে ১০ম শ্রেণীতে। ৭ম শ্রেণীতে বিজন কড়া আর ৬ষ্ঠ শ্রেণীতে কাঞ্চন কড়া ছাড়াও প্রাইমারি শ্রেণীতে পড়ছে আরো ৫ জন। মূলত কৃষ্ণ কড়ার অনুকরণে ও সহযোগিতায় এখানকার আদিবাসীরা আজ শিশুদের স্কুলে পাঠাচ্ছে।
আদিবাসীদের অধিকারের বিষয়ে কৃষ্ণ বেশ ওয়াকিবহাল। আদিবাসী হিসেবে নামকরণ না হওয়ার ক্ষোভ প্রকাশ করে সে। সে মনে করে আদিবাসী এলাকার স্কুলগুলোতে আদিবাসী শিক্ষক নিয়োগ, আদিবাসীদের মায়ের ভাষায় সরকারিভাবে শিক্ষা প্রদানের ব্যবস্থা হলে আদিবাসী শিশুরা আর পিছিয়ে থাকবে না।
কৃষ্ণ জানাল কড়া ভাষার লিখিত কোনো বর্ণ নেই। অন্যান্য সম্প্রদায়ের ভাষার মতোই তা মৌখিক। কৃষ্ণর মুখে শুনি কড়া ভাষায় বিভিন্ন শব্দরূপগুলো। কড়ারা মানুষকে বলে ‘আদমি’, মাকে ‘মেয়া’, দুলাভাইকে ‘বোহনে’ বললেও বোনকে বলে ‘বেহেইন’। দেবতা কড়াদের ভাষায় বলে ‘ভূত’। তাদের কাছে তীর হচ্ছে ‘বিজার’ আর ধনুক হচ্ছে ‘ধেনি’। বেড়াকে কড়ারা ‘টেটিয়া’ বললেও সূর্যকে বলে ‘বেড়া’। এরা ধানকে ‘ধান’ বললেও আগুনকে বলে ‘আইক’। বন্যাকে কড়া ভাষায় বলে ‘বান’ আর ঝড়কে ‘দুন’। মাছকে ‘মাছরি’ বললেও পাখিকে বলে ‘চেড়ে’। আকাশের তারা কড়া ভাষায় ‘তেরগান’। চোখকে ‘আইয়ক’, হলুদকে ‘হাড়দি’ আর সাদাকে কড়ারা বলে ‘চারাক’।
কৃষ্ণর পাশে বসা এক মহিলা। বয়স ষাটের মতো। খানিকটা চিন্তিত। নাম জানাল খিরো বালা। খিরো এসেছে লোহাডংগা থেকে। তুরি সম্প্রদায়ের আদিবাসী সে। গোত্রের এক মেয়ে তুলো বালা। তার কথা চিন্তা করছিল সে। তুলোর পেটে টিউমার হয়েছে। তার অপারেশন করতে হবে। কিন্তু খিরোর চিন্তা অন্যখানে। সে জানাল একসময় তারা তাদের জমিতে সার হিসেবে শুধুই গোবর সার দিত। আর পোকা দমনে ব্যবহার করত ছাই। ফলে খাদ্য উৎপাদন কম হলেও খাদ্যের গুণাগুণ ও স্বাদ অক্ষুণœ থাকত। খিরো বলে ‘এখন খাদ্যে শুধু বিষ আর বিষ’। অধিক ফলনের আশায় আমরা সব ফসলেই রাসায়নিক সার আর বিষ প্রয়োগ করছি। তাই শরীরের মধ্যে নানা রোগব্যাধি তৈরি হচ্ছে। খিরো বলে ‘এখন তো মাটির হাঁড়িতে কেউ রান্না করে না’। সে জানাল মাটির হাঁড়িতে রান্না হলে গ্যাসটিকের সমস্যা হয় না। চিকিৎসা নিয়ে এক ধরনের আক্ষেপ প্রকাশ করে খিরো বালা। সে বলে, ‘এখন ডাক্তার বেশি তাই রোগবালাইও বেশি’। খিরো জানাল তুরিসহ অন্য আদিবাসীদের ভেষজ চিকিৎসার কথা। সে বলে, ‘সাইতুন গাছের ছাল খাওয়ালে জ্বর বাপ বাপ করে পালাবে’। খিরো বলে আমাদের কথা কেউ শোনে না। সবাই মূর্খ মনে করে। সার দিয়ে ফুলকপিকে বড় বানানো হয়। কিন্তু সেই ফুলকপিতে নাই কোনো ভিটামিন।
খিরো জানাল তার দশ ছেলে মেয়ে। তবু সে বেশ সুস্থ আছে। সে বলে, ‘আমি বিষ খাই না, খাই না বোলডার মুরগি (ফার্মের মুরগি)’।
কড়াদের স্বপ্ন আর তুরিদের কৃষি প্রযুক্তির কথা শুনি বিকেল অবধি। মনে ভাবনা আসে। সরকার চায় আদিবাসীদের ভাগ্যোন্নয়ন। কিন্তু আদিবাসীদের চিরচেনা স্বপগুলোর সঙ্গে মিলবে কি সরকারের উদ্যোগগুলো?
লিখাটি প্রকাশিত হয়েছে সাপ্তাহিকে ৯জুন ২০১১
© 2011 – 2018, https:.