ভ্রমণকথা

জল প্রবালের রাজ্যে

সূর্য ওঠার সাথে সাথেই তিন বন্ধু তৈরী হয়ে নেই। অরণ্য তখনও বিছানায়। ছেঁড়াদ্বীপে যাওয়ার বিন্দুমাত্র আগ্রহ নেই তার। সবাই অরণ্যের ওপর মহাবিরক্ত হয়। সেন্টমার্টিনস এসেছি অথচ ছেড়াদ্বীপ যাব না! তাই কি হয়।ছেঁড়াদ্বীপ নিয়ে কত কথাই না শুনে এসেছি। সেন্টমার্টিনসের আসল সৌন্দর্য নাকি সেখানেই। বড় বড় জল প্রবালের রাজ্য সেটি। আছে জীবিত ও মৃত প্রবাল। বড় বড় প্রবালের পরতে পরতেই সৌন্দর্য লুকানো। নীল আকাশের নিচে নীল সাগরের মাতামাতি।  দূর প্রান্তর থেকে সাগরের নীলাভ ঢেউ নাকি আছরে পড়ে দুধ রঙ হয়ে। আরও কত কি! অরণ্যকে কটেজে রেখেই আমরা বেড়িয়ে পড়ি।
পেট বাবা তো একেবারে খালি! তাকে ঠান্ডা করতে ঘাটের কাছের দারুচিনি দ্বীপ হোটেলে বসে পড়ি আমরা। ভাজি আর অমলেটের সাথে গোটা তিনেক পরটা চালান করে দেই পেটের মধ্যে। বিল মিটিয়ে জেটির দিকে এগোবো, এমন সময় দেখি রাস্তার পাশে ছোট্ট একটা চায়ের দোকান। ছোট ছোট সব গ্লাস সাজানো। পাম্প চুলায় শোঁ শোঁ করে আগুন জ্বলছে। গলগলিয়ে ধোঁয়া বেরোচ্ছে কেঁটলির নল দিয়ে। এমন দৃশ্য দেখলেই তো চা খাওয়ার তৃষ্ণাটা আরো বেড়ে যায়। আমি, মনির আর মৃদুল বসে গেলাম ঝটপট। এক গ্লাস গরম চা খেয়ে চাঙ্গা হয়ে নিলাম আমরা।
সেন্ট মার্টিনস থেকে ছেঁড়াদ্বীপ ৫ কিলোমিটার দক্ষিণে। যেতে হবে ভাটার হিসাব কষে। নইলে আসল প্রবালের সৌন্দর্য দেখা হবে না। সে খবর নিয়েই আমরা রওনা হয়েছি। জেটি থেকে ঘন্টায় ঘন্টায় বড় বড় ট্রলার ছেড়ে যায় ছেড়াদ্বীপের উদ্দেশ্যে। কিন্ত সাগরে নিজেদের ইচ্ছে মতো ঘুরাঘুরি করতে কার না ভালো লাগে। আমরা তাই একটা ট্রলার নিয়ে নেই। ভাড়া ঠিক হয় আটশ টাকা।
আমাদের ট্রলারটি যখন ছাড়ে তখন ঘড়ির কাটায় সকাল ৮ টা। এদিককার ট্রলারগুলো বেশ অন্যরকম। দুইদিকে অনেক উঁচু। সমুদ্রের ঢেউ কাটাতেই এ ব্যবস্থা। ট্রলারের এক কোনে পত পত করে উড়ছে লাল সবুজের পতাকা। নীল সমুদ্রে ভেসে চলে  ট্রলারটি। মনে হচ্ছিল সাগরের মাঝে অজানা কোন দ্বীপ জয়ে বেড়িয়েছি আমরা।

নীল সাগরে ভেসে ভেসে দূর থেকে দেখি সেন্টমার্টিনসের সৌন্দর্য। দেখতে অন্যরকম লাগে। নীল পানিতে ভেসে আছে যেন সবুজ রঙের একটি ব্যাঙাচি। ঘাট বা জেটির দিকটি মাথার অংশ আর লেজের মতো চিকন অংশটি ছেঁড়াদ্বীপ। অস্পষ্টভাবে দূর থেকে ছেঁড়াদ্বীপ দেখেই আমাদের মনে নাচন ওঠে।
কিন্ত ট্রলার চালক এলাহীর মধ্যে কোন উত্তেজনা নেই। সাগর আর ছেঁড়াদ্বীপের সাথে তার জীবনের সম্পর্ক। খাটি চাটগায়ের ভাষায় টেনে টেনে কথা বলে সে। সে জানালো জোয়ারের পানি ছেঁড়াদ্বীপকে বিচ্ছিন্ন করে দেয় সেন্টমার্টিনস থেকে। কিন্ত ভাটার সময়ে বালুময় প্রান্তরে হেটেই যাওয়া যায় ছেঁড়াদ্বীপে। এলাহী দূর থেকে আমাদের দেখায় বাঁয়ে সাগরে ওপারে মায়ানমারের একটি পাহাড়কে। আবছা রেখার মতো দেখতে পাহাড়ের নাম নাকি আকিয়াব।
কথায় কথায় আমরা চলে আসি ছেঁড়াদ্বীপের কাছাকাছি। মৃদুলের এক বন্ধু এলজিইডির ইঞ্জিনিয়ার। ছেঁড়াদ্বীপ নিয়ে তার কাছ থেকে পাওয়া মজার কিছু তথ্য জানায় মৃদুল। ছেঁড়াদ্বীপের ছোট্ট জায়গাটিকে সরকারীভাবে  নানা নামে ভাগ করা হয়েছে। নামগুলোও বেশ। মোরাং, লম্বা ডং, শোনার ডং, বালুর ডং, গর্ত ডং, বড় ডং, প্রথম ছেঁড়া দ্বীপ, দ্বিতীয় ছেঁড়াদ্বীপ প্রভৃতি। লম্বা ডং থেকে শোনার ডং পর্যন্ত ছেঁড়া দ্বীপের সীমানা।

    ছেঁড়াদ্বীপের প্রবালপথ
ছেঁড়াদ্বীপের প্রবালপথ

মিনিট ত্রিশের মধ্যেই আমরা ছেঁড়াদ্বীপের একেবারে কাছে পৌছে যাই। কাছ থেকে দ্বীপটিকে দেখে অবাক হই। চোখের সামনে লক্ষ কোটি প্রবালে ঘেরা জনমানবহীন রহস্যময় এক দ্বীপ যেন। হালকা সবুজের কেয়াগাছ ছাড়া দাড়িয়ে থাকা কোন সবুজের অস্তিত্বই নেই। চারদিকে শুধু বাতাসের শোঁ শোঁ শব্দ আর নীল সাগরের ফেনামাথা ঢেউ। প্রবালের বাধায় আমাদের ট্রলারটি থেমে যায়। আর এগোবে না। সামান্য জলের পথ পার হতে হবে ছোট্ট নৌকায়। নৌকায় পা দিতেই দেখি অন্য দৃশ্য। সাগরের টলটলে স্বচ্ছ জলের নিচে প্রবালের আরেক রাজ্য। খালি চোখেই তা বেশ দেখা যায়। সবুজ, বাদামী, কালো – নানা রঙের প্রবাল। হঠ্যাৎ নাম না জানা এক ঝাঁক মাছ ভেসে যায় প্রবালগুলোর পাশ দিয়ে। তাদের গায়ে নীল আর লালের ডোরাকাটা দাগ। দেখেই ওয়াও! অদ্ভুত! বলে চেচিয়ে ওঠে মনির।
ছেঁড়াদ্বীপে নেমেই আমরা ঘুরে দেখি চারপাশ। চারদিকে বড় বড় প্রবাল থাকলেও ছেঁড়াদ্বীপের মাঝের অংশে শুধুই বালুময় পথ। রূপালী বালুর সাথে মিশে আছে নানা রঙের ছোট ছোট

অসংখ্য ঝিনুক আর শামুক। আমরা পশ্চিমদিকটা খানিকটা ঘুরে দেখি। এ দিকটাতে প্রবালের পথই বেশি। খানিকটা এগোতেই অবাক হই। প্রবাল পথে বড় বড় গর্ত। গর্তে একেবারে স্বচ্ছ পানি। তার ভেতর ঘুরে বেড়াচ্ছে রঙ বেরঙের মাছ। খানিক ওপর থেকে দেখলে পথটি মনে হবে  অন্যরকম। ঠিক যেন নাসার বিজ্ঞানীদের পাঠানো চাঁদের পৃষ্ঠের কোন ছবি। মনিরের ক্যামেরায় ক্লিক ক্লিক শব্দ। অবাক করা নানা আকারের প্রবালের ছবি তুলছে সে।
সমুদ্রের গর্জন ধীরে ধীরে বাড়তে থাকে। জোয়ারের পানি ডুবিয়ে দেয় চারপাশের প্রবালগুলোকে। স্বচ্ছ নীলাভ পানিতে বদলে যায় চারপাশের দৃশ্য। যে সব প্রবাল খানিক আগেও আমরা দেখে এসেছি, এরই মধ্যে সেগুলো সমুদ্রের ভালবাসায় হাবুডুবু খেতে থাকে।
ছেঁড়াদ্বীপের বালুময় পথে ভালবাসায় আকড়ে আছে ঝুপড়ি সাজের কেয়াগাছগুলো । কঁচি কঁচি ডোগা নাচানাচি করছে দমকা বাতাসে। ঝোপেড় ভেতর থেকে উকি দিচ্ছে বড় বড় কেয়াফল। ঠিক যেন আনারসের মতো।
এরই মধ্যে ডাব সাজিয়ে বসেছে একজন দোকানী। নাম জানলাম মহিবর। কাটা ডাবে পাইপ ডুবিয়ে চুমুক দিয়েই মৃদুল বলে, ‘আহ্! এমন সুমিষ্ট পানি’। মহিবর বছরখানেক ধরে সেন্টমার্টিনস থেকে ডাব এনে বিক্রি করে ছেঁড়াদ্বীপে। ডাব খাওয়ার পর আবর্জনাগুলো কোথায় যায়? এমন প্রশ্নে সে নিরব থাকে। ছেঁড়াদ্বীপের পরিবেশ নষ্টকারী একজনের নীরবতায় আমরা শুধুই দীর্ঘশ্বাস ফেলি।
মহিবর জানালো বর্ষা মৌসুমে ছেঁড়াদ্বীপের চারপাশের সাগর আরো উত্তাল থাকে। সে সময়ে একবার সে পশ্চিম সমুদ্রে ডলফিন দেখেছিল। মাঝে মাঝে ¯্রােতের তোরে  প্রবালের মধ্যেই আটকা পড়ে দুএকটা ডলফিন। মহিবরের কথা শুনেই আমাদের আফসোস হয়। ইস, যদি একবার বর্ষায় আসতে পারতাম ছেঁড়াদ্বীপে।
সূর্য তখন মাথার ঠিক ওপরে। এরইমধ্যে ছেঁড়াদ্বীপে বেড়ে যায় পর্যটকদের আনাগোনা। আগত নারীদের অট্টহাসিতে কেপে ওঠে নীল সাগরের বুক। কেউ কেউ প্রবালে ওপর হেটে হেটে খুজছে যেন অজানা কিছু। চারপাশের সৌন্দর্য দেখে কেউ কেউ সামলাতে পারে না নিজেকে। তখনই ঘটে অঘটন। খালি পায়ে হাটতে গিয়েই দু-একজন রক্তাক্ত করে ফেলে পায়ের পাতাদুটোকে। কাটা পায়ে নোনা জলের ছিটায় যন্ত্রণা যেন আরো বেড়ে যায়। আমাদের পাশেই উহ্ করে ওঠে দুএকজন।
ক্যামেরায় নানা ঢঙে ছবি তুলছে এক দম্পতি। তাদের সাথে পরিচিত হই আমরা। জাহিদ ও নিলা থাকেন চট্টগ্রামে। নতুন বিয়ের পর হানিমুনে এসেছেন সেন্টমার্টিনসে। ছেঁড়াদ্বীপে এসে তারা বেশ তৃপ্ত। উদাসী মনে ছেঁড়াদ্বীপে ছুটে বেড়ান দুজনে। প্রবাল রাজ্যে স্মৃতিময় ছবি তুলতে আমরা তাদের সাহায্য করি।
জল প্রবালের রাজ্য ছেড়ে আমরা ফিরতি পথ ধরি। নীল সমুদ্রের স্বচ্ছ জলরাশি বিচ্ছিন্ন করে দেয় ছেঁড়াদ্বীপকে। প্রবালের ভালবাসায় ভেসে থাকে মায়াবী ছেঁড়াদ্বীপ। দূর থেকে অবাক বিস্ময়ে আমরা শুধুই চেয়ে থাকি।

 লিখাটা প্রকাশিত হয়েছে যুগান্তরে ২৪ জুন ২০১১ ও বাংলানিউজ২৪.কম

© 2011 – 2018, https:.

এই ওয়েবসাইটটি কপিরাইট আইনে নিবন্ধিত। নিবন্ধন নং: 14864-copr । সাইটটিতে প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো তথ্য, সংবাদ, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করলে আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।

Show More

Salek Khokon

সালেক খোকনের জন্ম ঢাকায়। পৈতৃক ভিটে ঢাকার বাড্ডা থানাধীন বড় বেরাইদে। কিন্তু তাঁর শৈশব ও কৈশোর কেটেছে ঢাকার কাফরুলে। ঢাকা শহরেই বেড়ে ওঠা, শিক্ষা ও কর্মজীবন। ম্যানেজমেন্টে স্নাতকোত্তর। ছোটবেলা থেকেই ঝোঁক সংস্কৃতির প্রতি। নানা সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠনের সঙ্গে জড়িত। যুক্ত ছিলেন বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র ও থিয়েটারের সঙ্গেও। তাঁর রচিত ‘যুদ্ধদিনের গদ্য ও প্রামাণ্য’ গ্রন্থটি ২০১৫ সালে মুক্তিযুদ্ধ ভিত্তিক মৌলিক গবেষণা গ্রন্থ হিসেবে ‘কালি ও কলম’পুরস্কার লাভ করে। মুক্তিযুদ্ধ, আদিবাসী ও ভ্রমণবিষয়ক লেখায় আগ্রহ বেশি। নিয়মিত লিখছেন দেশের প্রথম সারির দৈনিক, সাপ্তাহিক, ব্লগ এবং অনলাইন পত্রিকায়। লেখার পাশাপাশি আলোকচিত্রে নানা ঘটনা তুলে আনতে ‘পাঠশালা’ ও ‘কাউন্টার ফটো’ থেকে সমাপ্ত করেছেন ফটোগ্রাফির বিশেষ কোর্স। স্বপ্ন দেখেন মুক্তিযুদ্ধ, আদিবাসী এবং দেশের কৃষ্টি নিয়ে ভিন্ন ধরনের তথ্য ও গবেষণামূলক কাজ করার। সহধর্মিণী তানিয়া আক্তার মিমি এবং দুই মেয়ে পৃথা প্রণোদনা ও আদিবা।

2 Comments

  1. Wow….!!! onk shundor hoise lakhata Khokon vai…. Apnar a dhoroner vromon kahini aro lakha uchit….

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

Back to top button