লক্ষণের নির্বাচন ও কড়া নারীদের কথা
রেংটা পাড়ার পাশ দিয়ে চলে গেছে রাস্তাটি। কালো পিচঢালা রাস্তা। দুপাশে বড় বড় সব গাছ। দূর থেকে মনে হয় রাস্তাটি যেন সবুজ টেস্টটিউবের ভেতর চলে গেছে। এই রাস্তাটি কোথায় ঠেকেছে? স্থানীয় এক বৃদ্ধ জানাল এটি চলে গেছে বৈরাগী পাড়ার সীমান্ত অবধি।
দু’দিকে কোনো জনবসতির দেখা নেই। ডানে বাঁয়ে শুধুই সবুজ ধানক্ষেত। সবুজ ক্ষেতের মধ্যে মাঝে মাঝে বসেছে খাম্বা আকৃতির ছোট পিলার বিশেষ। সেগুলোর গায়ে লাল-হলুদ রঙের লেপন। জানা গেল এগুলো বরেন্দ্র প্রকল্পের মাধ্যমে স্থাপিত গভীর নলকূপের এয়ার ভেন্ট। দিনাজপুরের বহু জায়গাই এক সময় পানির অভাবে পড়েছিল পতিত অবস্থায়। পানির লেয়ার অধিক নিচে হওয়ায় কুয়ার মতো সুরঙ্গ করে সেখানে স্যালো ইঞ্জিন বসিয়ে উত্তোলন করা হতো চাষের পানি। যতটুকু পানি মিলত তা দিয়েই চলত চাষবাস। তাছাড়া পানি উত্তোলন ছিল বেশ খরচ সাপেক্ষ। ফলে স্থানীয় বাঙালি আর আদিবাসীদের জমিগুলো পড়ে থাকত অনাবাদি অবস্থায়।
বরেন্দ্র বহুমুখী উন্নয়ন প্রকল্পটি চালু হওয়ায় বদলে যায় গোটা এলাকার চেহারা। ভূগর্ভস্থ পানি কৃষকরা পায় স্বল্পমূল্যে। ফলে ফসলের সময় কৃষকদের মনে আনন্দ দোল খায়। ভূগর্ভস্থ পানির ছোঁয়ায় সবুজ সম্ভাবনায় প্রাণ পায় গোটা এলাকাটি।
গ্রামের নাম বেতুড়া। একেবারে সীমান্তঘেঁষা গ্রাম এটি। এখানে বাস করে প্রায় ২০০ আদিবাসী পরিবার। আছে সাঁওতাল, ওঁরাওসহ অন্যান্য সম্প্রদায়। নিজের ধর্ম আর সংস্কৃতি নিয়ে দরিদ্রতার সঙ্গে সংগ্রাম করে টিকে আছে এখানকার আদিবাসীরা।
বেতুড়ার লক্ষণের বাড়ি আমাদের গন্তব্য। পুরো নাম লক্ষণ হেমব্রম। সাঁওতাল গোত্রের আদিবাসী সে। সাঁওতালদের বলা হয় কৃষি সংস্কৃতির জনক। সে হিসেবেই লক্ষণের পিতা তিলকাই হেমব্রম যুক্ত ছিল চাষাবাদের সঙ্গে। কিন্তু পিতার মতো লক্ষণ রক্ষা করেতে পারেনি পূর্বপুরুষদের কৃষি পেশা। স্থানীয়দের কাছে সে বরিং মিস্ত্রি হিসেবেই অধিক পরিচিত। বরিং করে পানি তুলতে লক্ষণ সিদ্ধহস্ত। ফলে বরেন্দ্রর ঠিকাদার ছাড়াও কয়েক গ্রামের ওপাশ থেকে ডাক আসে লক্ষণের। বরিং করে আর মাঝে মাঝে ভাঙ্গুরার ব্যবসা করে যা পায় তা দিয়ে চলে তার সংসার।
লক্ষণ এবার ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে দাঁড়িয়েছে। ভাণ্ডারা ইউনিয়নের ৭ নং ওয়ার্ডের সাধারণ সদস্য পদপ্রার্থী সে। এই ওয়ার্ডে লক্ষণের প্রতিদ্বন্দ্বী ৫ জন। স্বাধীনের পর এই প্রথম কোনো আদিবাসী ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে দাঁড়াল। তাই লক্ষণের নির্বাচন নিয়ে বেতুড়া ছাড়াও হালজায়, বহবলদিঘী ও কালিয়াগঞ্জ এলাকার আদিবাসীদের মধ্যে টান টান উদ্দীপনা বিরাজ করছে।
গ্রাম্য রাস্তার পাশে বসা এক বৃদ্ধা। বয়স ষাটের মতো। লক্ষণের বাড়ির খোঁজ করতেই সে বলল, ‘কোন লক্ষণ? লক্ষণ রায় নাকি আদিবাসী লক্ষণ’। বৃদ্ধার কথায় মনে ভাবনা আসে। আমাদের সরকার বাহাদুর নানা নামে নামকরণের চেষ্টা করছে আদিবাসীদের। কিন্তু বেতুড়ার বাঙালিরা লক্ষণের মতো আদিবাসীদের চেনে ‘আদিবাসী’ নামেই। তাই আদিবাসী হিসেবে নামকরণ শুধু আদিবাসীদের দাবি নয়। আদিবাসী নামটি যুগ যুগ ধরে বাঙালিদের মনে গেথে থাকা একটি শব্দ। শুধু সরকারি প্রজ্ঞাপন জারি করে কি মুছে ফেলা যায় সে আদিবাসী শব্দটিকে।
লক্ষণের বাড়িতে যখন পৌঁছি তখন তার উঠোন ভর্তি লোকজন। আদিবাসী ছাড়াও আছে বেশ কিছু বাঙালি। কথা হয় রাম বাবুর সঙ্গে। তিনি জানালেন লক্ষণ সাঁওতাল গোত্রের আদিবাসী হলেও স্থানীয় বাঙালিদেরও সমর্থন রয়েছে লক্ষণের প্রতি। তিনি জানালেন এবার নির্বাচনে তার নিজেরই দাঁড়ানোর কথা। লক্ষণ দাঁড়ানোতে তিনি না দাঁড়িয়ে কাজ করছেন লক্ষণের জন্য।
ভিড় কমতেই আলাপ হয় লক্ষণের সঙ্গে। কেন নির্বাচনে দাঁড়ালেন? এমন প্রশ্নে তিনি মুখে হাসি ফুটিয়ে জানালেন, ‘ইউনিয়নের সকল সাহায্য সহযোগিতাই আসে গরিব আর হতদরিদ্রদের জন্য কিন্তু সাহায্য পৌঁছায় না আদিবাসীদের ঘরে। গরিব বাঙালিরা যাও পায় তাও মিলে অর্থের বিনিময়ে। মুচকি হেসে লক্ষণ জানান, টাকার বিনিময়ে যেসব নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি বয়স্কভাতা, বিধবাভাতা আর ভিজিডির মতো সরকারি সেবা প্রদান করেন মানসিকভাবে তারাই সবচেয়ে দরিদ্র। এদের কারণে শুধু আদিবাসীরাই নয় পিছিয়ে পড়ছে হতদরিদ্র বাঙালিরাও। তাই দরকার যোগ্য ব্যক্তি নির্বাচন। গ্রামবাসী সবাই মিলে তাই ইউপি সদস্য হিসেবে দাঁড় করিয়েছে লক্ষণকে। নির্বাচনে জিতলে কী শুধু আদিবাসীদের দিকেই নজর রাখবেন? এমন প্রশ্নে লক্ষণ বেশ গম্ভীরমুখে উদাহরণ দিয়ে বলেন, ‘জনগণের বাগান পাহারা দেয়াই নির্বাচিতদের দায়িত্ব। ছাগল যদি সে বাগান খেতে আসে তবে তো দায়িত্ব ছাগল তাড়ানো। কে ছাগলের মালিক তা দেখার দরকার নেই।’ তৃতীয় শ্রেণী পাস এক সাঁওতালির মুখে জনপ্রতিনিধিদের নিয়ে এমন চিন্তাশীল উদাহরণ শুনে আমরা খানিকটা বিমোহিত হই। মনে মনে ভাবি লক্ষণের কথাগুলো যদি পৌঁছাত দেশের জনপ্রতিনিধিদের কান অবধি।
লক্ষণের নির্বাচনী ব্যয় শুনে অবাক না হয়ে পারলাম না। নির্বাচনী খরচ মাত্র দশ হাজার টাকা। লক্ষণ মনে করেন মানুষ আর আগের মতো নেই। জাল ভোট দেয়ার সুযোগ যেমন নেই, তেমনি ভোটও কেনা যায় না সহজে। সবাই টাকা নেয়। কিন্তু সীল মারে বুঝেশুনে। গ্রামের মানুষের মধ্যে সচেতনতা বেড়েছে। নিজের অধিকারের বিষয়ে সচেতন হয়েছে আদিবাসীরাও। লক্ষণ মনে করেন স্থানীয় মানুষের ভালোবাসার টানেই তিনি জয়ী হবেন। লক্ষণের প্রতি এক ধরনের সমর্থন রেখে আমরা রওনা হই হালজায় কড়া পাড়ার দিকে।
কড়া পাড়ার মাহাতো জগেন বসে আছে গাছের ছায়ায়। কি যেন ভাবছে সে। এবার কাকে ভোট দেবেন এমন প্রশ্নে ঠোঁটে এক চিলতে হাসি মেখে বলে, ‘কাকে দেব, ভোট তো একটাই, সবাই ভালো দেখা যায়’। গতবারের নির্বাচনের কথা বলতে গিয়ে সে জানাল ভোটের আগে প্রার্থীরা বাড়ি বাড়ি গিয়ে নানা প্রতিশ্রুতি দিয়ে ভোট চায়। কিন্তু নির্বাচিত হয়ে তারা সব ভুলে যায়। জগেনের মতে ৯৫% প্রতিশ্রুতিই থাকে অপূর্ণ। জগেনের ভাষায়, ‘ভোট সিরায়া গেলে, দেখা কারলে না আবোথন’ অর্থাৎ ভোটের শেষে কারো দেখা পাওয়া যায় না।
স্থানীয় চেয়ারম্যানের কথা উল্লেখ করে জগেন জানায় কিছুদিন আগের একটি ঘটনা। স্থানীয় বাঙালিরা গোত্রের কৃষ্ণ কড়ার জমির ধান কেটে নিলে চেয়ারম্যানকে লিখিতভাবে জানায় তারা। সালিশ ডাকা হয়। কিন্তু চেয়ারম্যান সাহেব বাঙালিদের পক্ষ নেন। ফলে কড়ারা এক ধরনের কষ্ট বুকে নিয়ে নিশ্চুপ থাকে। জগেন জানায়, জনপ্রতিনিধিরা ভোটে জয়ী হওয়ার পরে ভুলে যায় আদিবাসীদের ভোটগুলোর কথা। পাশের ইউনিয়নে আদিবাসী প্রার্থী লক্ষণের কথা উঠতেই জগেন বলে, ‘লক্ষণ ভোটে দাঁড়ালে তো হামনিকে ভালো লাগো হে’।
জগেনের সঙ্গে কথা বলছি হঠাৎ ঝুম বৃষ্টি। জগেনসহ আমরা আশ্রয় নেই একটি বাড়িতে। বাড়ির উঠানে লাগানো তুলসি গাছ আমাদের নজরে পড়ে। তুলসির পাশেই মাটি দিয়ে তৈরি করা হয়েছে উঁচু ডিবি। এই ডিবিকে কড়ারা বলে পিড়া রাহাতে। কড়া ভাষায় জগেন বলে, যেখনা তুলসি গাছ থাকিবে অখনা হামরা পিড়া রাহাতে’। অন্যান্য সম্প্রদায়ের আদিবাসীরা তুলসি ঠাকুরকে সকাল-সন্ধ্যা ভক্তি দিলেও কড়ারা ভক্তি দেয় শুধু সন্ধ্যায়। কড়া নারীদের দিতে হয় এই ভক্তি। প্রতিদিন সন্ধ্যায় দেহের বা প্রদীপ জ্বালিয়ে এরা তুলসিকে ভক্তি দিয়ে গভীর মনে ভগবানকে স্মরণ করে বলে, ‘দেখিয়া ভগবান, নিকে সুকে রেখিয়া, ভালো ভালো রেখিয়ে, অসুখ বিসুখ নিকে সুখে রেখিয়া ভগবান’। সন্ধ্যা বাতি দেয়াকে কড়া ভাষায় বলে, ‘দেহের বাতি’।
হালজায় পাড়াটি দেশের একমাত্র কড়া পাড়া। এদেশ থেকে প্রায় নিশ্চিহ্ন এই আদিবাসী জাতিটি। আমাদের গলার শব্দে ঘরের ভেতর থেকে বের হয়ে আসে এক যুবতী। নাম জানাল বাবলী কড়া। তার সঙ্গে কথা জমতেই জানি কড়া নারীদের সুখ আর দুঃখগুলো। আদিবাসী সাঁওতাল বা অন্য সম্প্রদায়ের মতো কড়াদের আর্থসামাজিক অবস্থা ততটা উন্নত নয়। ফলে অধিকাংশ সময়েই এদের তিনবেলা খাবার জোটে না। বাবলী জানাল তার পরিবারের সবাই সকালে নাস্তা করে পনতা (পনতা), পেঁয়েজ (পেঁয়াজ), কাঁচ মেরচায় (কাঁচা মরিচ) দিয়ে। দুপুরে কোন খাবার না খেয়ে রাতে খায় দিপাল ভাত ( গরম ভাত) আর এলুয়াকে ঘটো ( আলুর তরকারি)। অনাহারে ও অর্ধাহারে থাকলেও আদিবাসী কড়াদের মনে আনন্দের এতটুকু কমতি নেই। সামনেই করমাপূজা। তাই পূজা নিয়ে নানা প্রস্তুতি বাবলীর মনে। পূজায় কি করবেন? প্রশ্ন করতেই বাবলী বলে, ‘ভালো ভালো লুগা/ ভালো ভালো কুরতা/ পিনেল লাগতে’।
এক সময় কড়া নারীদের পছন্দের পোশাক ছিল ‘পেনছি’। কিন্তু এখন আর কড়া নারীরা পেনছি পড়ে না। বাবলী জানাল শাড়ি সস্তা হওয়ায় তারা আজ সেটিকেই নিজেদের পোশাক হিসেবে বরণ করে নিয়েছে। শাড়ি ছাড়াও গলাকে মালা ও কানসি (কানের জিনিস) কড়া নারীদের অতি পছন্দের। এছাড়া যে কোনো উৎসবে তারা ঝুমকা, ফুটকি (নাকের দুল), ঘড়কে পেনজাল (পায়ের নূপুর) পরে আনন্দের সঙ্গে।
সংসারের নানা কাজ আর স্বামীকে খুশি করা ছাড়াও কড়া নারীরা সন্তানকে বুকে জড়িয়ে মাঠের কাজ করে নিত্যদিন। কিন্তু কড়া রীতিতে নারী হিসেবে মিলে না স্বামী বা পিতার সম্পত্তির উত্তরাধিকার। এ নিয়ে কোনো আক্ষেপ নেই কড়া নারীদের। তাদের দীর্ঘশ্বাসগুলো উবে যায় আপনজনদের শ্রদ্ধা আর ভালোবাসায়।
© 2011 – 2018, https:.