মেঘনায় যায় মেঘনা রাণী
সাদা গাংচিলের দল পিছু নিল আমাদের। শুশুকের ডুবসাঁতারে চোখ ভেসে গেল, প্রাণ জুড়ানো বাতাসে হারিয়ে গেল মন। ঢাকার সদরঘাট থেকে বুড়িগঙ্গা পেরিয়ে ধলেশ্বরী ছাড়িয়ে শীতলক্ষ্যার প্রান্ত ছুঁয়ে লঞ্চটি চলছে মেঘনায়।
বন্ধু সুহান ফোন করেছিল আগের দিন। বলে, চল চাঁদপুর ঘাটে ইলিশ খেয়ে দিনে দিনে ফিরে আসব। রাজি না হয়ে উপায় থাকল না। সকাল সকালই পৌঁছে গিয়েছিলাম সদরঘাট। চার নম্বর গ্যাংওয়েতে গিয়ে মেঘনা রানীকে অপেক্ষা করতে দেখলাম।
৮টা মানে ৮টাই। সাইরেন বাজিয়ে পথে নামে লঞ্চটি। অনেক নৌকা চারধারে-কোনোটায় সবজি, কোনোটায় রুটি-কলা। বুড়িগঙ্গার ওপর নির্মিত বাংলাদেশ-চীন মৈত্রী সেতুর নিচ দিয়ে এগিয়ে চলে লঞ্চটি। ধর্মগঞ্জে এসে বুড়িগঙ্গার নাম ধলেশ্বরী। গতিপথও পাল্টে যায়। কাঠপট্টি যাওয়ার অনেকটা আগে থেকেই সারি সারি ইটভাটা দৃষ্টিপথ আটকে দেয়। ধোঁয়ার কুণ্ডলী আকাশ ঢেকে ফেলেছে। কয়লা আর ইট বোঝাই বাল্কহেড চলছে নদীপথে। তবে মুক্তারপুর ব্রিজ পেরোতেই সবুজে মাখামাখি হয়ে যাই।
নারায়ণগঞ্জ থেকে শীতলক্ষ্যা এসে ধলেশ্বরীর সঙ্গে মিশেছে মুন্সীগঞ্জে। হুইল ঘোরাতে ঘোরাতে লঞ্চের মাস্টার মো. কলিমুল্লাহ তা-ই বললেন। মেঘনার পানিতে রোদ লেগেছে, ঝিকিমিকি দেখা যাচ্ছে দূর পর্যন্ত।
নদীর পানিতে বড় বড় বয়া ভাসছে। মাস্টার বলল, ‘এই বয়া দেইখা বুঝতে পারি, কোনখানে পানি কতখানি।’ বড় একটি লঞ্চ প্রবল গতিতে ছুটে গেল আমাদের উল্টোদিকে। মেঘনা রানী এবার দুলে উঠল। আমাদের দৃষ্টি বিনিময় হলো ওই লঞ্চের অচেনা মানুষগুলোর সঙ্গে। চেনা কাউকে পেলে জোরে চিল্লানি দেওয়া যেত। সুহান দেখাল, দূরে চরঘেঁষা নদীর পানিতে একদল লোক বাঁশ গাড়ায় ব্যস্ত। মাস্টার বললেন, ‘জাগ’ দিচ্ছে। ফাঁদ পেতে বড় বড় মাছ ধরতেই নাকি এ রকম আয়োজন।
এরই মধ্যে মেঘনা রানী চলে আসে গজারিয়ার কাছে। এখানে শীতলক্ষ্যা মিলেছে মেঘনায়। মেঘনা পেয়ে রানী তার গতি দিল বাড়িয়ে। আমরা কেবিনে বসে দিগন্তছোঁয়া মেঘনা দেখি। কেবিন বয়কে ডেকে পাউরুটি আর ডিমভাজা খাই। তারপর চা খেয়ে বের হই লঞ্চে চক্কর দিতে। সিঁড়ি বেয়ে দোতলায় নামতেই দেখি, টিভি চলছে। সহস্র চোখ একবিন্দুতে সমবেত। ডিপজল আর মান্না চিল্লাচিলি্ল করছে … ওই আমারে চিনস… সানডে মানডে ক্লোজ কইরা দিমু। নিচের তলায় চেয়ারে বসা যাত্রীরাও একই কাজে ব্যস্ত। পেছন দিকে ছোট্ট একটি চায়ের দোকান। কয়েকজন পেপারে চোখ রেখে চা খাচ্ছেন। মুন্সীগঞ্জের কৃষ্ণ তার কালিঝুলির বাঙ্ নিয়ে এসেছে। বলে, ‘পালিশ কইরা দেই স্যার।’ আমি ভাবি, এই সুযোগ তো এখন আর বেশি পাওয়া যায় না। জুতা জোড়া খুলে এগিয়ে দিই। সে জুত হয়ে বসে জুতার দাগ মুছে দেয়। কৃষ্ণকে ২০ টাকা দিয়ে চকচকে জুতায় ভর করে ঘুরে বেড়াই। দেখি, হাসি-মশকরা করছে এক দম্পতি।
ভাব জমিয়ে জানতে পারি, তাঁদের বিয়ের বয়স ছয় মাস মোটে। বিয়ের পর এই প্রথম নুর ইসলাম শ্বশুরবাড়ি যাচ্ছে। বেশ একটা ভাব তার মনে। আমরা বেশিক্ষণ কাবাব মে হাড্ডি হয়ে থাকি না। কেবিন-লাগোয়া বারান্দায় বসে মেঘনার পানে চেয়ে থাকি। নদীটা বড্ড বড়, পানিও ধরে প্রচুর। রোদের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চেহারাও বদলে নেয় এখানে-ওখানে। লগিখোঁড়া চরকে পেছনে ফেলতেই চোখের সামনে ভেসে ওঠে চাঁদপুর ঘাট। সাড়ে ১১টায় পৌঁছে যাই চাঁদপুর। মাস্টার বললেন, ‘ঠিক ২টায় কিন্তু ছেড়ে যাব। দেরি করবেন না।’ ঘাট থেকে নেমে রেললাইন ধরে আমরা যাই বড় স্টেশনে। পদ্মা আর ডাকাতিয়া এখানে মেঘনায় পড়েছে। মোহনা দেখার দারুণ আনন্দ এখানটায়। এরপর যাই ইলিশঘাটে। ছোট-বড়, মোটা-চিকন অজস্র ইলিশ এখানে। আকার ধরে কেজিপ্রতি দাম শুরু হয় ২০০ টাকা থেকে। ঘাটপাড়ে অনেক ফিশিং বোট ভিড়ে আছে। কোনো কোনোটি সেই ভোলার মনপুরা থেকে আসা। বেশ প্রমাণ সাইজের কিছু রিটা, আইড় ও পাঙ্গাশ মাছ দেখলাম। এগুলোর অবশ্য দাম আছে। ঘাটের ছোট হোটেলে ৬০০ গ্রাম ওজনের একটি মাছ ভাজিয়ে নিই ১৫০ টাকা দিয়ে। তারপর খাই আর খাই। ২টা বাজলে ফিরতে থাকি।
লিখাটি প্রকাশিত হয়েছে কালেরকন্ঠে, প্রকাশকাল: ২৯ নভেম্বর ২০১০
© 2011 – 2018, https:.
Lekhati jen sesh hoeo hoilona sesh. Bes valo likhechen.Lekhatite meghna nadite tour er bivinno drissso fute tulechen. Thanks.
thanks for reading & visit my site.