রক্ত পিয়াসী খুনিয়া দিঘি
১৯৭১ সালে স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় হানাদার পাক বাহিনী কয়েক হাজার বাঙালিকে হত্যা করে এই দিঘিটিতে ফেলে রাখে। স্বাধীনের পর এই দিঘির উত্তর দিকে পাওয়া যায় হাজার হাজার মানুষের মাথার খুলি ও হাড়গোড়। মানুষের রক্তে দিঘির পানির রং হয়ে যায় ঘন খয়েরি। জানা যায় ১৯৭১ এ রানীশংকৈলসহ হরিপুর, বালিয়াডাঙ্গি ও পীরগঞ্জ উপজেলা থেকে প্রতিদিন শত শত মুক্তিযোদ্ধা ও মুক্তিযুদ্ধের আদর্শের লোকদের ধরে আনা হতো রানীশংকৈল আর্মি ক্যাম্পে। সেখানে টর্চারের পর তাদের হত্যা করে ফেলে দেয়া হতো খুনিয়া দিঘিতে।
১৯৭১ সাল। সারাদেশে চলছে পাকিস্তানি আর্মির অত্যাচার। কিন্ত রানীশংকৈল উপজেলার নেকমরদ ইউনিয়নের লোকেরা তখনো বেশ শান্তিতেই দিন কাটাচ্ছিল। ডা. আব্দুর রহমান এ ইউনিয়নের চেয়ারম্যান। ন্যায়-নীতি আর আদর্শ রক্ষার মানুষ তিনি। তাই গ্রামের সকলেই তাঁকে শ্রদ্ধা করে। নেকমরদ বাজারেই ছিল রহমান চেয়ারম্যানের একটি ওষুধের দোকান। পাশের আরেকটি দোকানে ব্যবসা করত তারই আদরের ছোটভাই সহমান। সন্ধ্যা হলেই রহমানের দোকানে চলত মুক্তিযোদ্ধা আর মুজিব আদর্শের লোকদের আনাগোনা। চলত আর্মি আর রাজাকার ঠেকানোর নানা পরিকল্পনা। চারদিকে তখন পুরোদমে চলছে মুক্তিযুদ্ধ। চলছে রাজাকার, আলবদর আর আলশামস বাহিনীর হত্যা, লুটতরাজ। আশপাশের গ্রামগুলোতে প্রতি রাতেই নির্র্বিচারে চলত হত্যা উৎসব। নেকমরদ ইউনিয়নে আর্মি ঢুকলেই গ্রামের চেয়ারম্যান হিসেবে সেখানে উপস্থিত হতেন আব্দুর রহমান। রক্ষা করতেন গ্রামের নিরীহ জনগণকে। এ নিয়ে দিন দিন রাজাকার, আলবদরের লোকেরা তার ওপর বেশ নাখোশ হতে থাকে। এরা চেয়ারম্যানের বিরুদ্ধে ক্ষেপিয়ে দেয় পাকিস্তান আর্মিদের।
নবেম্বর মাসের শেষের দিকের ঘটনা। হঠাৎ পাকিস্তানি আর্মি এসে নেকমরদ বাজারের দোকান থেকে তুলে নিয়ে যায় চেয়ারম্যান আব্দুর রহমানকে। খবর পেয়ে ছোটভাই সহমান তখন ছুটে আসে। বড় ভাইকে মুক্ত করতে বাধা দেয় পাকিস্তান আর্মিদের। গর্জে ওঠে আর্মির মেজর। চিৎকার করে বলতে থাকে, ‘উসকো বি লে লো’। বড় ভাইয়ের সঙ্গে সহমানকেও তুলে নেয় আর্মিরা। রানীশংকৈল ক্যাম্পে রেখে চালাতে থাকে পাশবিক নির্যাতন।
স্বামীকে বাঁচাতে রহমানের স্ত্রী আয়েশা বানু চার ছেলেমেয়ে নিয়ে ধর্ণা দিতে থাকে আর্মি ক্যাম্পে। মেজরের পায়ে ধরেও মেলে না স্বামীর মুক্তি। রহমান ও সহমানের ওপর ১৩ দিন ধরে চালানো হয় নির্মম টর্চার। প্রতিদিনই আর্মিদের চেষ্টা চলে তাদের মুখ থেকে ‘পাকিস্তান জিন্দাবাদ’ শোনার। কিন্তু ১৩ দিন টর্চার সেলে থাকার পরও তারা বশ্যতা স্বীকার করে না। অবশেষে চোখ বেঁধে তাদের নিয়ে যাওয়া হয় খুনিয়া দিঘি বদ্ধভূমিতে। সেখানে ব্রাশ ফায়ারে রক্তাক্ত হয় রহমান ও সহমানের বুক। দেশের জন্য শহীদ হন দুইভাই। খুনিয়া দিঘি পায় আরো দুটি প্রাণের তাজা রক্তের স্বাদ।
মুক্তিযুদ্ধের এ ঘটনাটি শুনছিলাম শহীদ রহমান ও সহমান এর ভাতিজা ও ঠাকুরগাঁও জেলা আইনজীবী সমিতির সহসভাপতি এ্যাডভোকেট মোঃ আব্দুল করিমের কাছ থেকে। শুনছিলাম ’৭১-এ রক্ত পিয়াসী খুনিয়া দিঘিতে খুন উৎসবের কথা।
ঠাকুরগাঁও জেলা থেকে প্রায় ৪৫ কিলো দূরে রানীশংকৈল উপজেলা। এ জনপদটি এক সময় মালদুয়ার পরগনার অন্তর্গত ছিল। পরে জমিদার বুদ্ধিনাথের ছেলে টংকনাথ ব্রিটিশ সরকারের আস্থা লাভ করতে ‘মালদুয়ার স্টেট’ গঠন করেন। কথিত আছে, টাকার নোট পুরিয়ে জনৈক ব্রিটিশ রাজকর্মচারীকে চা বানিয়ে খাইয়ে টংকনাথ ‘চৌধরী’ উপাধি লাভ করেন। এরপর দিনাজপুরের মহারাজা গিরিজনাথ রায়ের বশ্যতা স্বীকার করে ‘রাজা’ উপাধি পান। তখন থেকে তিনি রাজা টংকনাথ চৌধুরী। রাজা টংকনাথ চৌধুরীর স্ত্রীর নাম জয়রামা শঙ্করী দেবী। ‘রানীশংকরী দেবী’র নামানুসারে মালদুয়ার স্টেট হয়ে যায় ‘রানীশংকৈল’। রাজা টংকনাথের বাড়ি দেখতে এখনো এখানে ভিড় লেগে যায় দূর-দূরান্ত থেকে আসা দর্শনার্থীদের।
উপজেলা সদর থেকে উত্তরদিকের পাকা রাস্তাটি চলে গেছে কাঁঠালডাঙ্গির দিকে। এ পথেই যেতে হয় নয়নাভিরাম রানী পুকুরে। রাস্তার পাশেই প্রাচীন আমলের বড় বড় আম গাছ। গাছগুলোর অবয়ব দেখলে তেমনটিই মনে হয়। দুপাশে বিস্তীর্ণ ফসলের মাঠ। মাঠের মধ্যে বাঁশঝাড়। কিলোখানিক যেতেই রাস্তার পাশের উঁচুতে কালো-সাদা টাইল খচিত একটি স্মৃতিসৌধ নজরে এলো। ছোট্ট সিঁড়ি পেরিয়ে স্মৃতিসৌধের কাছে যেতেই পেছনে ভেসে উঠল বড় একটি দিঘি। কেন দিঘিটির এমন নামকরণ? এ রকম প্রশ্নের উত্তর পাওয়া যায় রানীশংকৈল ডিগ্রি কলেজের সহকারী অধ্যাপক তাজুল ইসলামের কাছ থেকে।
প্রচলিত কাহিনী মতে, প্রায় দুশ বছর আগে স্থানীয় কোনো এক জমিদার খনন করেছিল দিঘিটি। এই এলাকার ব্যবসায়ীরা সে সময় দিঘির পাশ দিয়েই ব্যবসা করতে যেতেন রায়গঞ্জে। তখন দিঘির এলাকাটি বেশ নির্জন ও জঙ্গলাকীর্ণ ছিল। একবার কে বা কারা এখানে এক ব্যবসায়ীকে খুন করে দিঘির পাড়ে ফেলে রেখেছিল। তখন থেকে দিঘির নাম খুনিয়া দিঘি।
১৯৭১ সালে স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় হানাদার পাক বাহিনী কয়েক হাজার বাঙালিকে হত্যা করে এই দিঘিটিতে ফেলে রাখে। স্বাধীনের পর এই দিঘির উত্তর দিকে পাওয়া যায় হাজার হাজার মানুষের মাথার খুলি ও হাড়গোড়। মানুষের রক্তে দিঘির পানির রং হয়ে যায় ঘন খয়েরি। জানা যায় ১৯৭১ এ রানীশংকৈলসহ হরিপুর, বালিয়াডাঙ্গি ও পীরগঞ্জ উপজেলা থেকে প্রতিদিন শত শত মুক্তিযোদ্ধা ও মুক্তিযুদ্ধের আদর্শের লোকদের ধরে আনা হতো রানীশংকৈল আর্মি ক্যাম্পে। সেখানে টর্চারের পর তাদের হত্যা করে ফেলে দেয়া হতো খুনিয়া দিঘিতে। ১৯৭১-এ পাকিস্তানি আর্মি, রাজাকার, আলবদর আর আলশামসের লোকেরা খুনিয়া দিঘি নামটিকে আরো সার্থক করে তোলে। দেশের অন্যতম বৃহৎ বদ্ধভূমি হিসেবে খুনিয়া দিঘি স্থান করে নেয় কান্নাভরা ইতিহাসের পাতায়।
রানীশংকৈলের বর্তমান প্রজন্ম ভালোভাবে জানে না খুনিয়া দিঘির কথা। জানে না শহীদদের আত্মহুতির কাহিনীগুলো। প্রতিবছর স্বাধীনতা দিবস আর বিজয় দিবসে ঘটা করে ফুল দেয়া ছাড়া যেন কিছুই করার নেই আর। বদ্ধভূমির ইতিহাসটি টাঙানো হয়নি স্মৃতিসৌধের কোথাও। দিঘির দুপাশ অনেকখানি ভাঙ্গা। মাটি কেটে নিয়ে যাওয়ার ফলেই দিঘির আকৃতি এমনটি দাঁড়িয়েছে। প্রতিদিন দিঘির পানিতেই গোসল করানো হয় আশপাশের গ্রামবাসীর গরুগুলোকে। গোটা দিঘিটিই পড়ে আছে অরক্ষিত অবস্থায়।
রানীশংকৈলের স্কুল শিক্ষক রুহুল আমিন জানেন না খুনিয়া দিঘির পুরো ইতিহাস। শুধু জানেন কিছু লোককে হত্যা করা হয়েছিল সেখানে। উপজেলার টগবগে যুবক দিপঙ্কর। ডিজিটাল যুগের ছোঁয়ায় সারা পৃথিবী তার হাতের মুঠোয়। কিন্তু নিজের উপজেলার বদ্ধভূমিটি সম্পর্কে তেমন কিছুই জানা নেই তার।
নিরাশার মধ্যেও থাকে আশার আলো। জানা যায় বেসরকারিভাবে শুধুমাত্র প্রগতি ক্লাবটি প্রতিবছর আয়োজন করে মুক্তিযোদ্ধাদের স্মৃতিচারণ অনুষ্ঠানের। অধ্যাপক তাজুল ইসলাম থেকে জানা যায় একবার প্রগতির অনুষ্ঠানে হরিপুর থেকে এসেছিলেন সদ্য প্রয়াত ও খুনিয়া দিঘি থেকে প্রাণে বেঁচে যাওয়া মুক্তিযোদ্ধা সূর্য মোহন। জানিয়েছিলেন বেঁচে যাওয়ার লোমহর্ষক কাহিনীটি। দিঘিরপারে অন্যান্যের সঙ্গে লাইন করে দাঁড় করানো হয় সূর্য মোহনকেও। ব্রাশ ফায়ারের গুলি তার বুকের পাশ দিয়ে বেরিয়ে যায়। দিঘির কচুরিপানার মধ্যে মরার মতো পড়ে থাকেন তিনি। পরে কৌশলে পালিয়ে গিয়ে প্রাণে রক্ষা পান।
তাজুল ইসলাম জানান, ১৯৭১-এ যে খুনিয়া দিঘিতে হত্যা করা হলো হাজার হাজার মানুষ। এখনো যেখানের মাটি খুঁড়লে পাওয়া যায় মাথার খুলি ও হাড়গোড়। সে দিঘিটিকে বদ্ধভূমি হিসেবে সংরক্ষণ না করে একবার মন্ত্রণালয় থেকে ৯৯ বছরের জন্য লিজ দেয়া হয় জনৈক হামিদুর রহমানের নামে। পরবর্তীতে স্থানীয় সুধী সমাজের প্রতিবাদের মুখে তা স্থগিত হয়ে যায়।
কথা হয় রানীশংকৈল উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদের আহ্বায়ক শ্রী বিদেশী চন্দ্র রায়ের সঙ্গে। তিনি জানান, স্বাধীনের পর ১৯৭৩ সালে চার নেতার অন্যতম নেতা কামরুজ্জামান খুনিয়া দিঘি স্মৃতিসৌধটি উদ্বোধন করেন। খুনিয়া দিঘি বদ্ধভূমিটিকে সংরক্ষণ করা, বড় একটি স্মৃতিস্তম্ভ তৈরি, বদ্ধভূমির ইতিহাস ও শহীদদের নামের তালিকা বদ্ধভূমি স্থলে টাঙানো, শহীদ পরিবারগুলোকে সম্মানিত করা এবং নানা উদ্যোগের মাধ্যমে বদ্ধভূমির ইতিহাসকে পরবর্তী প্রজন্মের কাছে পৌঁছে দেয়ার জন্য তিনি জোর দাবি জানান। পাশাপাশি তিনি দাবি জানান, পাকিস্তান সেনাবাহিনীকে যারা সাহায্য করেছিল, যারা এদেশে বদ্ধভূমির রূপকার সে সকল রাজাকার ও যুদ্ধাপরাধীর বিচারের।
মুক্তিযুদ্ধ বাঙালি জাতির রক্তাক্ত ইতিহাস। বাঙালির ত্যাগের ইতিহাস, গর্বের ইতিহাস। দুঃখিত হতে হয় যখন দেখা যায় মুক্তিযুদ্ধের ৩৮ বছর পরেও এদেশের বদ্ধভূমিগুলো অরক্ষিত অবস্থায় পড়ে থাকে। ব্যথিত হতে হয় যখন চোখের সামনে দেখা যায় মুক্তিযোদ্ধা ও শহীদ পরিবারের মলিন মুখগুলো। মুক্তিযুদ্ধ ও মুক্তিযোদ্ধা শব্দ দুটি ছাড়া বাঙালির কি কোনো অস্তিত্ব থাকে?
খুনিয়া দিঘি বদ্ধভূমির ওপারেই লাল সূর্য ডুবে প্রতিদিন। দিঘির পাশেই একটি বড় শিমুল গাছ। অজস্র টকটকে লাল ফুল ফুটে আছে গাছটিতে। বসন্ত বাতাসের জাপটায় চোখের সামনেই কয়েকটি লাল শিমুল ফুল এসে পড়ে খুনিয়া দিঘি স্মৃতিসৌধের বেদিতে।
লিখাটি প্রকাশিত হয়েছেসাপ্তাহিকে ১ এপ্রিল ২০১০
© 2011 – 2018, https:.
সুন্দর লেখা।
ধন্যবাদ মুরাদুল।