মহানন্দার তীরে
‘কাঁটাতারের ওপাশে ভারতের মুড়িখোয়া বস্তি গ্রাম। গ্রাম ছুঁয়ে পাকা রাস্তাটি সোজা চলে গেছে শিলিগুড়ির দিকে। রাস্তায় বড় বড় লোহার বেইলি ব্রিজ। ব্রিজগুলো রাস্তার সৌন্দর্য বাড়িয়ে দিয়েছে। দূরে দার্জিলিংয়ের পাহাড়গুলো যেন মৌনী সাধু। আকাশের সঙ্গে তাদের জন্ম-জন্মান্তরের মিতালি। এপার থেকে দেখাচ্ছে ছবির মতো।’
এপারে বাংলাদেশ অংশটি আবার অন্যরকম। ইচ্ছেমতো এঁকেবেঁকে চলে গেছে মহানন্দা। নদীতে শত শত লোক। কোমর পানিতে নেমে পাথর তুলছে। সাদা, কালো, বাদামি_নানা রঙের পাথর। সবার হাতের কাছে খুঁটিতে বাঁধা গ্যাসভর্তি বড় বড় টায়ার, তাতে নেট লাগানো। পাথর তুলে নেটে রাখা হয়। নেট ভরে গেলে তীরে নিয়ে আনলোড করে আবার পাথর তুলতে ব্যস্ত হচ্ছে শ্রমিকরা। মহানন্দা তীরের উঁচু টিলার ডাকবাংলোতে বসে মনোমুঙ্কর চারপাশ দেখছি আমরা।
ব্যস্ত জীবন থেকে প্রায়ই ছুটি নিতে মন চায়। ঢাকা থেকে পঞ্চগড়ের উদ্দেশে এক রাতে বাসে উঠে পড়ি। সেখানে বন্ধু মৃদুলের বাড়ি। পরিকল্পনা করি দেশের শেষপ্রান্ত তেঁতুলিয়ায় যাব। হারাব প্রকৃতির মাঝে।
ভোরবেলায় পঞ্চগড় পৌঁছে যাই। মৃদুলের বাড়িতে নাশতা সেরে দুজনই চেপে বসি তেঁতুলিয়াগামী লোকাল বাসে। চওড়া ও মসৃণ রাস্তায় ৩৫ কিলোমিটার দূরত্বের যাত্রাটি শেষ করতে দুই ঘণ্টা লেগে যায়।
যাত্রাপথে উপভোগ করি নানা দৃশ্য। রাস্তার পাশে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে নানা রঙের নানা আকারের পাথর। কোথাও নারী শ্রমিকরা পাথর বাছতে ব্যস্ত। কোথাও মাটি খুঁড়ে পাথর তোলা হচ্ছে।
উপজেলার পাশে সাহেবজত গ্রামের ডাঙ্গিবস্তি নামের স্থানের উঁচু টিলার মধ্যে তেঁতুলিয়া ডাকবাংলো। ডাকবাংলোতে যখন পৌঁছে তখন মধ্যদুপুর। বাংলোর চারপাশে প্রাচীন আমলের বড় বড় গাছ। সেখানে বাসা বেঁধেছে অজানা সব পাখি। পাখিদের গানে ভেসে যাই দূরে। কর্তৃপক্ষের সম্মতিতে ৪০০ টাকার বিনিময়ে অনুমতি মেলে ডাকবাংলোতে এক রাত থাকার।
গেটের পাশেই ১৫০ বছরের পুরনো একটি কড়ই গাছ। গাছটির নিচে তৈরি করা হয়েছে ‘স্বাধীনতার তীর্থস্থান’ নামের স্মারক স্তম্ভ। সেখানে ফলকের মধ্যে শোভা পাচ্ছে শামসুর রাহমানের ‘স্বাধীনতা তুমি’ কবিতাটি।
ডাকবাংলোর কেয়ারটেকার হাবিবুর জানান নানা কথা। এই বাংলোতে এসেছিলেন কবি শামসুর রাহমান। দার্জিলিংয়ের পাহাড়, মহানন্দা আর সীমান্তের সৌন্দর্য দেখে শামসুর রাহমান এখানে দুই দিন কাটিয়েছেন। তেঁতুলিয়া সীমান্তে কোনো সমস্যা দেখা দিলে দুই দেশের উচ্চপর্যায়ের ফ্ল্যাগ মিটিংগুলো এ বাংলোতেই বসে।
বাংলোর পেছন দিকটায় গিয়ে আমরা স্থির হয়ে যাই। দার্জিলিংয়ের পাহাড়গুলো যেন কাছে চলে এসেছে। হাতছানি দিয়ে ডাকছে। তবে সেপ্টেম্বর থেকে নভেম্বর পর্যন্ত শুধু তিন মাসই এখান থেকে পরিষ্কার আকাশে পাহাড় দেখা যায়।
বাংলোয় খানিকটা বিশ্রাম নিয়ে বিকেলের দিকে বেরিয়ে পড়ি। উঁচু টিলা বেয়ে নেমে আসি মহানন্দার তীরে। মহানন্দা থেকে তোলা পাথর প্রতিদিন চলে যায় দেশের বিভিন্ন স্থানে। স্থানীয় ব্যবসায়ী কফিল উদ্দিনের ভাষায় মহানন্দাই এ অঞ্চলের মানুষের জীবন-জীবিকার প্রধান উৎস। মহানন্দা প্রসন্ন হলে টনে টনে পাথর মেলে। পাথর বিক্রি করে এখানকার লোকদের ভাগ্যের পরিবর্তন ঘটেছে।
আমরা নদীর পানে অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকি। কত কাল ধরে বয়ে চলেছে, কত কিছু ধরে রেখেছে! পরশ পাথরের মতো বদলে দিচ্ছে দুই পাড়ের মানুষের জীবন। সন্ধ্যা লাগিয়ে নদীর পাড় ধরে হাঁটতে থাকি। নিঝুম হয়ে আসে চারপাশ। কিছু সময় পর স্নিগ্ধ আলোয় ভরে যায় চারদিক। চাঁদের আলোয় অপরূপা হয়ে ওঠে মহানন্দা। বাংলোয় ফিরে দেখি জোনাকি পোকার আসর বসেছে। শিলিগুড়ি আর দার্জিলিংয়ের বাতিগুলো দেখা যাচ্ছে। মনে হচ্ছিল কোনো স্বপ্নের দেশে আমরা। মৃদুল গান ধরে, ‘আজ জ্যোৎস্না রাতে সবাই গেছে বনে’।
লিখাটি প্রকাশিত হয়েছে কালেরকন্ঠে, ০৩ মে ২০১০
© 2011 – 2018, https:.