ভ্রমণকথা

রাজার খোঁজে রাজবাড়িতে

এক সময় রাজবাড়ির মূল প্রাসাদ ভবনটি তিনটি প্রধান অংশে বিন্যস্ত ছিল। এগুলো আয়না মহল, রানী মহল ও ঠাকুরবাড়ি মহল হিসেবে পরিচিত। পূর্ব ও দক্ষিণে দুটি বড় দীঘি, পরিখা, বাগান, একটি বিলুপ্ত চিড়িয়াখানা, একটি টেনিস কোর্ট, কাচারি ও কুমার হাউসসহ গোটা রাজবাড়িটি প্রায় ১৬.৪১ একর জমিতে বিস্তৃত। মূল মহল ও মহলসংলগ্ন পরিখা অষ্টাদশ শতাব্দীতে নির্মাণ করেন মহারাজা প্রাণনাথ ও তার পোষ্যপুত্র রামনাথ। প্রাসাদটি নির্মিত হয়েছিল ইউরোপীয়, মুসলিম ও হিন্দু রীতির এক অদ্ভুত সংমিশ্রণে।

দিনাজপুর যাওয়ার পরিকল্পনা প্রায় চূড়ান্ত। বাসের টিকিটও কাটা শেষ। এরই মধ্যে বেঁকে বসে বন্ধু আতিক। তার কাছে ভ্রমণ মানেই পাহাড় আর সমুদ্র। ঐতিহাসিক জায়গায় দাঁড়িয়ে অতীত ইতিহাসকে অনুভব করার আনন্দ তার জানা নেই। সবাই বিরক্ত। সবার কথায় চুপসে যায় সে। এতে অন্যরা মুচকি হাসে। চার বন্ধু মিলে রওনা হই দিনাজুপুরে; আমি, আতিক, জুয়েল আর মৃদুল।

রাজবাড়ির ভেতরের একাংশ
রাজবাড়ির ভেতরের একাংশ

চাঁদের আলোতে বাংলার পথঘাট প্রান্তর দেখছি। যমুনা সেতুর কাছে আসতেই ‘থ’ হয়ে যাই। লিয়েন আলোতে শরীর সাজিয়ে ধনুকের মতো বেঁকে বসে আছে সেতুটি। সেতুর আলোতে বড় বড় চোখ করে দুপাশের নদী দেখার চেষ্টা করে আতিক।
দেখতে দেখতে কখন যে চন্দ্রাচ্ছন্ন হয়ে পড়েছি টেরই পাইনি। ভোরের দিকে বাস থামে দিনাজপুরে। ঘুম ঘুম চোখে ঢুলছিলাম তখনও। জুয়েল আর মৃদুল তখনও তন্দ্রা রাজ্যের চূড়ায়। বাস কাউন্টারে অপেক্ষা করছিল কলেজ বন্ধু কাজিম। তার বাড়ি দিনাজপুরে। তার বাড়িতেই আমরা থাকব দিন দুয়েক। ঘুরে দেখব দিনাজপুরের ঐতিহাসিক কীর্তিগুলো।
কাজিমের বাড়িতে নাস্তা সেরেই টানা তিন ঘণ্টা ঘুম। দুপুরের খাবার সেরে ৩টার দিকে আমরা বেরিয়ে পড়ি দিনাজপুর রাজবাড়ির উদ্দেশে।
মালেকের ছোট্ট চায়ের দোকানে চা খেয়ে চাঙা হয়ে নেই আমরা। দিনাজপুরের চিরিরবন্দর মোড়ে দোকানটি। মালাইয়ের চা। যেন অমৃতের স্বাদ।

দিনাজপুরের রাজবাড়ির ভেতর অংশ
দিনাজপুরের রাজবাড়ির ভেতর অংশ

দিনাজপুর শহরের উত্তর-পূর্ব প্রান্তে প্রাচীন এ রাজবাড়িটি। সাদা চুনের আচ্ছাদনে উঁচু গেটের মাঝ বরাবর একটি খিলান পথ। সে পথেই আমরা ভেতরে ঢুকি। সামনে খালি মাঠ। মাঠের বামদিকে ছোট আরেকটি গেট। এটি সিংহ দ্বার। গেটে না ঢুকেই আমাদের ফটোসেশন শুরু হয়। লাল-হলুদের রঙিন গেটের উপরে একটি সিংহ দাঁড়িয়ে। ওমা! সিংহের পায়ের নিচে দেখি ফুটবল। সে আমলে রাজা কী ফুটবলপ্রেমী ছিল? কে জানে। সিংহ দ্বারের পেছনে নীল আকাশ। এভাবে সেটিকে দেখতে বেশ অন্যরকম লাগে। রাজবাড়ির নকশাখচিত গেট দেখেই মজে যায় আতিক। নানা ঢঙে ছবি তুলতেই ব্যস্ত হয়ে পড়ে সে।

রাজবাড়ির কৃষ্ণ মন্দির
রাজবাড়ির কৃষ্ণ মন্দির

সিংহ দ্বার পেরোলেই প্রাসাদ এলাকা। প্রাচীন এ বাড়ির অধিকাংশই আজ ধ্বংসপ্রাপ্ত। বাম পাশে রয়েছে একটি কৃষ্ণ মন্দির। ডানদিকে প্রাসাদের বহির্বাটির কিছু ধ্বংসাবশেষ। আমরা সেখানে প্রাচীন আমলের ইটগুলো ছুঁয়ে দেখি। ইটসুরকির গন্ধ নিয়ে অপর একটি প্রবেশ পথে চলে আসি বর্গাকার একটি চত্বরে। চত্বরের পূর্বপাশে একটি মন্দির। সমতল ছাদবিশিষ্ট মন্দিরটির চারটি সেমি কোরিনাথিয়ান স্তম্ভের ওপর বারান্দা এবং অপর একসেট কলামের ওপর হল মূল ঘরটি নির্মিত। জানা গেল, বর্তমানে এটিকে দুর্গা মন্দির হিসেবে ব্যবহার করা হয়। আমাদের আগেই দেশী-বিদেশীরা ভিড় জমিয়েছে রাজবাড়িটিতে। তাদের সঙ্গে আমরাও ঘুরে দেখি চারপাশের কীর্তিগুলো। কৃষ্ণ মন্দিরে ঢুকতে গিয়ে নজর কাড়ে গেটের নকশাগুলো। বিশেষ ধরনের প্রাচীন পাথরের মধ্যে কালো নকশাগুলো রাজার আমলকেই মনে করিয়ে দেয়। নকশা দেখে ভেতরে ঢুকবো এমন সময় দুই মহিলার বাধা। খানিক অবাক হই। মন্দিরে ঢুকতে এহেন আচরণ কেন। চোখের সামনে একটি সাইনবোর্ড। জুতা খুলে ভেতরে প্রবেশ। তা দেখে খানিক লজ্জিত হই। মন্দিরের ভেতরে রাধাকৃষ্ণের প্রাচীন মূর্তি আর গা ছমছমে পরিবেশ। বেশ অন্য রকম লাগে। মনে হয় এই বুঝি রাজা এসে পড়বেন পূজো দিতে। ঢাকা থেকে এসেছে এক পরিবার। কলেজপড়-য়া এক মেয়ে তাদের সঙ্গে। মনোযোগ দিয়ে সে মন্দিরের নকশা দেখছে। মাঝে মাঝে তার কণ্ঠে শুনি ‘ওয়াও’, ‘কি সুন্দর’ আর ‘অদ্ভত’ শব্দগুলো।

কৃষ্ণ মন্দিরের প্রধান ফটক
কৃষ্ণ মন্দিরের প্রধান ফটক

মন্দিরের ভেতর বসা স্থানীয় এক বৃদ্ধ। নাম পুলকচন্দ্র রায়। বয়স ষাটের অধিক। তার সঙ্গে আলাপ জমতেই জানি রাজবাড়ির নানা তথ্য। এক সময় রাজবাড়ির মূল প্রাসাদ ভবনটি তিনটি প্রধান অংশে বিন্যস্ত ছিল। এগুলো আয়না মহল, রানী মহল ও ঠাকুরবাড়ি মহল হিসেবে পরিচিত। পূর্ব ও দক্ষিণে দুটি বড় দীঘি, পরিখা, বাগান, একটি বিলুপ্ত চিড়িয়াখানা, একটি টেনিস কোর্ট, কাচারি ও কুমার হাউসসহ গোটা রাজবাড়িটি প্রায় ১৬.৪১ একর জমিতে বিস্তৃত। কোন আমলের এটি? জুয়েলের এমন প্রশ্নে বৃদ্ধা জানান, মূল মহল ও মহলসংলগ্ন পরিখা অষ্টাদশ শতাব্দীতে নির্মাণ করেন মহারাজা প্রাণনাথ ও তার পোষ্যপুত্র রামনাথ। প্রাসাদটি নির্মিত হয়েছিল ইউরোপীয়, মুসলিম ও হিন্দু রীতির এক অদ্ভুত সংমিশ্রণে। একসময় নাকি মহলে নানা ধরনের মূল্যবান পাথর ও রত্ন ছিল। এখন সবই সরিয়ে নেয়া হয়েছে। আমরা মন দিয়ে শুনছিলাম বৃদ্ধার কথাগুলো। মনে আসে নানা প্রশ্ন। প্রাচীন এই রাজবাড়িটির দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্তৃপক্ষের কেউ কী এসেছে কখনও? আগতদের জন্য রাজবাড়ির কোথাও কি টানিয়ে রাখা যেত না ইতিহাসের এ তথ্যগুলো। বৃদ্ধার কথামতো আমরা রাজবাড়ির পেছন দিকটা ঘুরে দেখি। এতিমখানা হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে রাজবাড়ির একটি অংশ। পেছনে যেতেই মন জুড়িয়ে যায়। চোখের সামনে ভেসে ওঠে রাজার আমলের বড় একটি দীঘি। দীঘি হলেও রাজার আমল থেকে এটি সুখ সাগর নামে পরিচিত। রানীর সঙ্গে রাজার আনন্দবিহার চলতো এ সাগরে।

হঠ্যাৎ মৃদুল আক্ষেপের সুরে বলে ইস্ রাজার চেহারটি যদি দেখতে পেতাম। মৃদুলের কথায় আমাদেরও আফসোস হয়। সুখ সাগরের পাড়ে মৃদু বাতাসের পরশে আমরা ইতিহাসকে অনুভব করি অন্যভাবে। চোখবুজে দেখি নিজেকে রাজার বেশে। চারদিকে অন্ধকার নামে। আমরা চলি ফিরতি পথে। কালের সাক্ষী হয়ে পেছনে পড়ে থাকে রাজার আমলের কীর্তিগুলো।

লিখাটি প্রকাশিত হয়েছে যুগান্তরে, প্রকাশকাল: ১২ আগষ্ট ২০১১

© 2011 – 2018, https:.

এই ওয়েবসাইটটি কপিরাইট আইনে নিবন্ধিত। নিবন্ধন নং: 14864-copr । সাইটটিতে প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো তথ্য, সংবাদ, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করলে আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।

Show More

Salek Khokon

সালেক খোকনের জন্ম ঢাকায়। পৈতৃক ভিটে ঢাকার বাড্ডা থানাধীন বড় বেরাইদে। কিন্তু তাঁর শৈশব ও কৈশোর কেটেছে ঢাকার কাফরুলে। ঢাকা শহরেই বেড়ে ওঠা, শিক্ষা ও কর্মজীবন। ম্যানেজমেন্টে স্নাতকোত্তর। ছোটবেলা থেকেই ঝোঁক সংস্কৃতির প্রতি। নানা সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠনের সঙ্গে জড়িত। যুক্ত ছিলেন বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র ও থিয়েটারের সঙ্গেও। তাঁর রচিত ‘যুদ্ধদিনের গদ্য ও প্রামাণ্য’ গ্রন্থটি ২০১৫ সালে মুক্তিযুদ্ধ ভিত্তিক মৌলিক গবেষণা গ্রন্থ হিসেবে ‘কালি ও কলম’পুরস্কার লাভ করে। মুক্তিযুদ্ধ, আদিবাসী ও ভ্রমণবিষয়ক লেখায় আগ্রহ বেশি। নিয়মিত লিখছেন দেশের প্রথম সারির দৈনিক, সাপ্তাহিক, ব্লগ এবং অনলাইন পত্রিকায়। লেখার পাশাপাশি আলোকচিত্রে নানা ঘটনা তুলে আনতে ‘পাঠশালা’ ও ‘কাউন্টার ফটো’ থেকে সমাপ্ত করেছেন ফটোগ্রাফির বিশেষ কোর্স। স্বপ্ন দেখেন মুক্তিযুদ্ধ, আদিবাসী এবং দেশের কৃষ্টি নিয়ে ভিন্ন ধরনের তথ্য ও গবেষণামূলক কাজ করার। সহধর্মিণী তানিয়া আক্তার মিমি এবং দুই মেয়ে পৃথা প্রণোদনা ও আদিবা।

2 Comments

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

Back to top button