লাল পাহাড়ের দেশে
‘রেস্ট হাউসের পাশ দিয়ে একটি সিঁড়ি পথ নিচে নেমেছে, নাম পদ্মসিঁড়ি। পাশেই গজারি বন। গাছে গাছে প্রেম ও প্রকৃতিবিষয়ক কবিতামালা ঝুলছে। কাদের কর্ম ঠিক বোঝা গেল না। ওপর থেকে দেখা লেকটির পাড়ে এসে দাঁড়ালাম। লেকের মাঝে একটা দ্বীপ। এর নাম লেকভিউ পেন্টাগন। দ্বীপে যাওয়ার জন্য আছে স্টিলের একটি সেতু। একটি প্যাডেল বোট নিয়ে আমরা পাহাড় ঘেরা লেকের পানিতে ভাসতে থাকি।’
আমাদের আর তর সইছিল না। ওয়াচ টাওয়ারের ওপর গিয়ে পুরোটা দেখে নেওয়ার ইচ্ছা। এর উচ্চতা ৬৪ ফুট। অবশ্য উঠতে উঠতেও বেশ দেখে নেওয়া যায়। যতই উঠছি, ততই সবুজ প্রকৃতি নেমে যাচ্ছে নিচে, পাহাড়গুলোও ছোট হয়ে যাচ্ছে। মেঘ থাকায় মেঘালয়কে ভালো ঠাওর করা যাচ্ছে না, তবে হাতছানি টের পাচ্ছি। পাহাড়ের কোল ঘেঁষে বেড়ে উঠেছে ঘন বন_শাল, সেগুন, মেহগনি, মহুয়া আরো নাম না-জানা অনেক গাছ।
একেবারে উঁচুতে উঠে মন পাগল হয়ে যাওয়ার দশা। শূন্যে ভাসছি যেন। নিচে পাহাড়ের ফাঁকে ফাঁকে ধানক্ষেত। মনে হচ্ছে কে যেন সবুজ আর টিয়া রঙের গালিচা পেতে রেখেছে। ওই যে পাহাড়তলে একটা বটগাছ। দর্শনার্থীরা এর গায়ে হেলান দিয়ে ছবি তুলছে। গাছটা বুঝি একটু দুলে উঠল। এ জীবনে কত ভার যে সয়েছে! বটের কাছেই চমৎকার লেকটি। তিন-তিনটি ময়ূরপঙ্খি নৌকা ভাসছে তাতে। কোনো পাহাড়ি রাজার নৌবিহার চলছে যেন। পাহাড়ের চূড়ায় ঘন বৃক্ষের ফাঁকে ফাঁকে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে ডায়নোসর আর জিরাফের প্রতিকৃতিগুলো। হঠাৎ চোখ পড়লে আঁতকে উঠি। গজনীর গারো পাহাড়ে এমনটি মিলবে কিন্তু। অবাক হওয়ার মতো অনেক কিছুই আছে এখানে।
পুরনো ব্রহ্মপুত্র আর পাহাড়ি নদী ভোগাই, মহারশি, মারিজি, সোমেশ্বর আর মৃগি ঘিরে রেখেছে শেরপুরকে। এক বান্ধবীর বিয়ের অনুষ্ঠানে এসেছি শেরপুর। খাওয়া শেষ হলে আমাদের আর বেঁধে রাখা গেল না। একটি মাইক্রোবাস নিয়ে রওনা দিলাম গজনীর উদ্দেশে। শরতের আকাশে মেঘ উড়ছে। পানি নেমে যাওয়া বিলে মাছ ধরছে জেলে। ঝিনাইগাতি পৌঁছতে বেশি সময় লাগল না। গজনী পাহাড়টি এই উপজেলার সীমান্তবর্তী কাংশ ইউনিয়নে। বিডিআর ক্যাম্প পেরিয়ে লাল মাটির উঁচু-নিচু পাহাড়ি পথ। ড্রাইভার রুস্তম জানাল, মাঝেমধ্যেই নাকি ওপারের পাহাড় থেকে বন্য হাতির দল নেমে আসে। লোপা বলে, ইস, এখন যদি আসত!রাস্তার পাশে অন্যরকম বাড়িগুলোই বলে দেয় এখানে আদিবাসীদের বাস। গারো, হাজং আর কোচরাই বেশি। চলে আসি গজনী অবকাশ কেন্দ্রের প্রবেশ দ্বারে। প্রকৃতির সঙ্গে প্রযুক্তির মেলবন্ধন ঘটেছে এখানে। প্রথমেই পাই একটি মৎস্যকন্যার ভাস্কর্য। মিষ্টি হেসে পর্যটকদের অভ্যর্থনা জানাচ্ছে। এর পরেই আমরা গিয়েছিলাম ওয়াচ টাওয়ারে। ওখান থেকে নেমে চিত্রা হরিণের মিনি চিড়িয়াখানা দেখেছিলাম। এর পাশেই আছে রেস্ট হাউস। কিন্তু জেলা প্রশাসকের অনুমতি ছাড়া মাছিও ঢুকতে পারে না সেখানে। কেয়ারটেকারের ভাবে তাই মনে হলো।
রেস্ট হাউসের পাশ দিয়ে একটি সিঁড়ি পথ নিচে নেমেছে, নাম পদ্মসিঁড়ি। পাশেই গজারি বন। গাছে গাছে প্রেম ও প্রকৃতিবিষয়ক কবিতামালা ঝুলছে। কাদের কর্ম ঠিক বোঝা গেল না। ওপর থেকে দেখা লেকটির পাড়ে এসে দাঁড়ালাম। লেকের মাঝে একটা দ্বীপ। এর নাম লেকভিউ পেন্টাগন। দ্বীপে যাওয়ার জন্য আছে স্টিলের একটি সেতু। একটি প্যাডেল বোট নিয়ে আমরা পাহাড় ঘেরা লেকের পানিতে ভাসতে থাকি।
গজনীর প্রবেশপথের পূর্বদিকের ক্রিসেন্ট লেকের তীর থেকে পশ্চিম পাশের আরেকটি লেকের তীরে যাওয়ার জন্য পাহাড় ও রাস্তার তলদেশ খনন করে তৈরি করা হয়েছে রোমাঞ্চকর সুড়ঙ্গপথ ‘পাতালপুরী’। ক্রিসেন্ট লেকের মাঝখানে তৈরি করা হয়েছে একটি চমৎকার ঝরনা। নাম ‘নির্ঝর’। পশ্চিম পাহাড়ে যেতেই পড়ে বর্ণিল সেতু ‘রংধনু’। আর পূর্ব পাহাড়ে আছে ৩২ ফুট উঁচু জিরাফ আর ডায়নোসরগুলো। ওদের কোলে-কাঁখে চড়ে আমরা ছবি তুলতে থাকি।
টের পাইনি কখন সূর্য পশ্চিমে হেলেছে। অন্ধকার এসে জড়ো হয়। জোনাকিদের আসর জমে। খেঁক শিয়ালের ডাকও শোনা যায়। আমরা পিছু হটি, মানে ঢাকায় ফিরতে থাকি।
লিখাটি প্রকাশিত হয়েছে কালেরকন্ঠে ১১ অক্টোবর ২০১০
© 2011 – 2018, https:.