তেঁতুলিয়ার চা বাগানে
‘বাগানের মধ্যে ছায়াতরু বা শেড ট্রি হিসেবে লাগানো হয়েছে অনেক ঔষধি গাছ। আমরা বাগানের ভেতরে চলে আসি। এবার সবুজের বন্যায় ভেসে যাওয়ার দশা। হঠাৎ চাগাছের ঝোপে কি যেন নড়ে উঠল। ভয়ে আমরা থমকে দাঁড়াই। হিস হিস শব্দ করতেই দেখি আরেক দৃশ্য। ছুটে পালাল ১০-১৫টি খরগোশ। সাদা, কালো, বাদামি রঙের খরগোশ। খরগোশদের অসুবিধা হবে ভেবে আমরা আর এগোইনি।’
সুন্দর পাকা রাস্তা। যত এগোচ্ছি সবুজ আমাদের জড়িয়ে ধরছে। সীমান্তের কাঁটাতারও ঢাকা পড়েছে সবুজে। ওপার থেকে একটি খাল নির্দ্বিধায় ঢুকে পড়েছে আমাদের সীমানার ভেতরে। খালটির দুই পাশের শস্যরাশি মায়া ছড়াচ্ছে। এ এক অন্য রকম ভালোলাগার রাজ্য।
পঞ্চগড় ছাড়া এ রকম দৃশ্য দেশের আর কোথায় আছে জানি না। চা বাগানের কথা উঠলেই মনে হয় সিলেট বা শ্রীমঙ্গলের কথা। কিন্তু সমতল ভূমি পঞ্চগড়েও গড়ে উঠেছে অর্গানিক চায়ের প্রাণজুড়ানো সবুজ বাগান। কজন তার খবর রাখে! সমতলের চা বাগান দেখতে পঞ্চগড়ে এসেছি আমরা চার বন্ধু। ভ্রমণপাগল অরণ্যের মামাবাড়ি পঞ্চগড় শহরে। সেই সুবাদে এর আগে একবার চা বাগান দেখে গেছে অরণ্য। তার উৎসাহেই পঞ্চগড়ের উদ্দেশে রওনা হই মৃদুল, বাবলাসহ আমরা চার বন্ধু।
আসাদগেট থেকে এক রাতে শ্যামলী পরিবহনের গাড়িতে চড়ে সকাল ৮টার মধ্যে পৌঁছে যাই দেশের শেষ প্রান্তের জেলা শহর পঞ্চগড়ে। অরণ্যের মামাবাড়িতে খানিক বিশ্রাম নিয়ে দুপুরের দিকে মাইক্রোবাসে চড়ে রওনা হই তেঁতুলিয়ার দিকে।
চা বাগান দেখব আর মহানন্দা তীরের ডাকবাংলোয় রাত কাটাব-পরিকল্পনা সে রকমই। পঞ্চগড় থেকে তেঁতুলিয়ার দূরত্ব ৩৫ কিলোমিটারের মতো। পঞ্চগড়ের অধিকাংশ চা বাগান এই তেঁতুলিয়াতেই। যেতে যেতে অরণ্য চা বাগানের নানা তথ্য দেয়। এ দেশে চা চাষ শুরু হয়েছিল ১৮৪০ সালে। সিলেটে নয়, চট্টগ্রামের ক্লাব প্রাঙ্গণে। সিলেটে উৎপাদন শুরু হয় ১৮৫৪ সালে। আর পঞ্চগড়ে ১৯৯৮-তে, প্রায় ১৫০ বছর পর। পঞ্চগড়ের অধিকাংশ জমিই একসময় অলস পড়ে থাকত। সে সময় শিল্পপতি কাজী শাহেদ আহমদ পঞ্চগড় অঞ্চলের নো-ম্যান্স ল্যান্ডে ভারতের চা বাগান দেখে অনুপ্রাণিত হন। তিনি তেঁতুলিয়ায় কিছু জমি কিনে অর্গানিক পদ্ধতিতে চা চাষ শুরু করেন। এ অঞ্চলে চা চাষের ক্ষেত্রে কাজী টি এস্টেটই অগ্রপথিক।
পরবর্তী সময়ে তেঁতুলিয়া চা করপোরেশন লিমিটেড, স্যালিন্যাল টি এস্টেটসহ বহু প্রতিষ্ঠান এখানে চা চাষ শুরু করে। পঞ্চগড় জেলা পরিষদের তথ্যমতে, বর্তমানে পঞ্চগড়ে দুই শতাধিক বাগানে ২২৫৫ দশমিক ৫৪ একর জমিতে চা চাষ হচ্ছে। ২০০৯ সালে পঞ্চগড় থেকে উৎপাদিত হয়েছে ৬,৫৬,০২৪ কেজি মেড টি।
হঠাৎ আমাদের গাড়ি থেমে যায়। রাস্তার দুই পাশে বিস্তীর্ণ সবুজ। মুহূর্তেই হারিয়ে গেলাম। বাগানের ভেতর ঢুকে দেখি ২০-২৫ জন নারী কাঁধে সাদা ব্যাগ ঝুলিয়ে অবিরাম চা পাতা তুলছেন। নয়নাভিরাম দৃশ্য! পুরোপুরি হারিয়ে যাওয়ার আগে অরণ্য আমাদের ডেকে নিয়ে গাড়িতে তোলে। তারপর ভিতরগড়ের পথ ধরি। সেখানে স্যালিন্যাল টি এস্টেটের চা বাগান।
অমরখানা ইউনিয়নের শেষ প্রান্তে সীমান্তঘেঁষে সুলতান হোসেন শাহ্র আমলের উঁচু গড়। এটিই ঐতিহাসিক ভিতরগড়। গড়ের দুদিকে শুধুই চা বাগান। গাড়ি থামিয়ে উঠে পড়ি গড়ের ওপরে। ইস কী যে অদ্ভুত! চারদিক সুনসান। দূরে ডেকে চলেছে কোনো অজানা পাখি। ঘন সবুজ চাগাছগুলোকে রোদ থেকে আগলে রাখছে ছায়াতরুগুলো। মুগ্ধ হয়ে দেখছিলাম চারপাশ। মৃদুল গান ধরে, ‘কোথাও আমার হারিয়ে যাবার নেই মানা’।
বাগানের মধ্যে ছায়াতরু বা শেড ট্রি হিসেবে লাগানো হয়েছে অনেক ঔষধি গাছ। আমরা বাগানের ভেতরে চলে আসি। এবার সবুজের বন্যায় ভেসে যাওয়ার দশা। হঠাৎ চাগাছের ঝোপে কি যেন নড়ে উঠল। ভয়ে আমরা থমকে দাঁড়াই। হিস হিস শব্দ করতেই দেখি আরেক দৃশ্য। ছুটে পালাল ১০-১৫টি খরগোশ। সাদা, কালো, বাদামি রঙের খরগোশ। খরগোশদের অসুবিধা হবে ভেবে আমরা আর এগোইনি।
এবার গাড়ি যায় তেঁতুলিয়ায়। এখানকার চা বাগান কিন্তু সিলেট বা চট্টগ্রামের মতো উঁচু-নিচু নয়, একেবারেই সমতল, দেখতেও অন্য রকম। তেঁতুলিয়া চা করপোরেশনের বাগানে যখন পৌঁছাই তখন বিকেল। রাস্তার দুই পাশে সবুজ মখমল বিছানো। বাগানের ধার ঘেঁষে অসংখ্য জারুলগাছে বেগুনি ফুল ফুটে আছে। কৃত্রিম উপায়ে চলছে বাগানে পানি দেওয়ার কাজ। পানি দেওয়ার সময় বাগানের আরেক রূপ দেখা যায়।
এই বাগানে মানুষের দেখা মিলছে না, অনেকক্ষণ পর করপোরেশনের কর্মচারী রাশেদকে পেলাম। সে জানায়, এ দেশে অর্গানিক ও দার্জিলিং জাতের চায়ের চাষ হয় একমাত্র তেঁতুলিয়ার বাগানগুলোতে। ইতিমধ্যে এ চা দেশের বাইরেও সুনাম অর্জন করেছে।
সন্ধ্যার পরে চাঁদ আসে। চা পাতায় আলো ফেলে। জোনাকিরা বাগান সাজায়। মনে হচ্ছিল যেন চলে এসেছি অন্য কোনোখানে, রূপকথার দেশে।
লেখাটি প্রকাশিত হয়েছে কালেরকন্ঠে ৭ জুন ২০১০
© 2011 – 2018, https:.
Thanks.