নীলসাগরে নীলফামারী যাত্রা
লাহেড়ী মোহন স্টেশন পার হতেই চারপাশের দৃশ্য পাল্টে যেতে থাকে। রেললাইনের পাশে বড় বড় পাকুরগাছ। গাছের ছায়ায় ঘুমিয়ে আছে ক্লান্ত মানুষজন। দূরের মাঠে একদল রাখাল গরু চরাচ্ছে। ছোট্ট একটি খালের ব্রিজ পেরোতেই দেখা মেলে অনেক বক আর পানকৌড়ির।
কু ঝিক ঝিক কু ঝিক ঝিক…ট্রেন চলে। বন-জঙ্গল, মাঠ-ঘাট, হাট-বাজার পেরিয়ে ছোটে ট্রেন। যেতে যেতে থামে, থামতে থামতে যায়। তার জন্য অপেক্ষা করে থাকে অনেক মানুষ। পথের পাঁচালীর অপু-দুর্গার বিস্ময় নিয়ে এখনো অনেক শিশু তাকিয়ে দেখে ট্রেনের চলাচল। তার ভেতরে-বাইরে কত যে গল্প! এসব গল্প নিয়ে জার্নি বাই ট্রেনের এটা তৃতীয় কিস্তি
কোথাও মাঠ, কোথাও নদী, কোথাও সবুজ গ্রাম। কখনো রোদ, কখনো মেঘ, কখনো বা ঝুম বৃষ্টি। এরই মধ্যে ছুটে চলা। দুলে দুলে ছবির মতো বাংলার পথ-প্রান্তর দেখা। এ রকম আনন্দ ভ্রমণ কি ট্রেন ছাড়া সম্ভব!
উত্তরবঙ্গগামী ট্রেনের মধ্যে নীলসাগরের নাম প্রথম সারিতে। নীলফামারী জেলার প্রাচীন এক দিঘির নামে এই আন্তনগর ট্রেনটির নামকরণ। চলে ঢাকা টু নীলফামারী। অনেকের কাছে বহুবার নীলসাগরে ভ্রমণের চমৎকার সব অনুভূতির কথা শুনেছি। আর ভেবেছি কবে চড়ব!
নীলফামারীতে এক বন্ধুর বিয়ের দাওয়াত। আমার তো খুশি ধরে না। নীলসাগরে চড়ার সাধ তাহলে পূর্ণ হবে!
সকাল ৮টায় পৌঁছে যাই ঢাকা ক্যান্টনমেন্ট রেলস্টেশনে। এখান থেকেই নীলসাগর ছাড়ে। বন্ধু সোহরাব আগেই এসে গেছে। ২০ মিনিট পর নীলসাগর যাত্রা শুরু করল। বিমানবন্দর পার হয়ে টঙ্গী স্টেশন ছাড়িয়ে অল্প সময়ের মধ্যেই জয়দেবপুরে এসে থামল। কয়েক ঢোক পানি খেয়ে নেয়। সারা দিনের চালান। গার্ডের সবুজ পতাকা নড়ে ওঠে, সিটি বাজিয়ে আবার পথে নামে ট্রেনটি।
আমাদের পাশের সিটেই বসেছে সাত বছরের এক ছেলে। মা-বাবার সঙ্গে নীলফামারী যাচ্ছে। ট্রেনের জানালা দিয়ে নানা দৃশ্য দেখে আনন্দে চিৎকার করে উঠছে। আমরাও তার সঙ্গে যোগ দিই। মৌচাক স্টেশন পার হতেই নীলসাগর ঢুকে পড়ে প্রকৃতির মাঝে। দুদিকে ঘন সবুজ শালবন। মাঝেমধ্যেই ছোট ছোট ডোবা। তাতে নাক অবধি ডুবে আছে মহিষ দল। দূরে সারি ধরে শত শত খেজুরগাছ। খোলা নীল আকাশের সাদা মেঘ তুলার মতো ভেসে বেড়াচ্ছে। বায়োস্কোপের মতো দৃশ্যগুলো একে একে আসছে-যাচ্ছে। একটি স্কুলের পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় ছাত্রছাত্রীরা হাত নেড়ে আমাদের বিদায় জানায়। ছোট ব্রিজগুলো বিকট শব্দে পার হচ্ছে নীলসাগর। ছাড়িয়ে যাই মির্জাপুর স্টেশন।
ক্ষুধা লেগে যায়। একটি চিকেন ফ্রাই শেষ করে একটি স্যান্ডউইচও খাই। চিকেন ফ্রাইয়ের দাম নিল ৩৫ আর স্যান্ডউইচ ১২ টাকা। ওহ হো! চা-ও খেয়েছিলাম। টাঙ্গাইলের মহড়া স্টেশনে এসে নীলসাগর হঠাৎই থেমে যায়। ট্রেনের অ্যাটেনড্যান্ট জানান, ‘লাইন ক্লিয়ার নাই।’ এই সুযোগে আমরা ট্রেনের একেবারে পেছনের বগিতে চলে আসি। সেখানে ট্রেনের পরিচালক সিরাজুল ইসলামের সঙ্গে দেখা হয়। তাঁর কাছ থেকে জানলাম, ট্রেনটির চালকের নাম ফজলুল হাসান।
মিনিট দশেকের মধ্যেই আবার ছুটতে থাকে নীলসাগর। সিটে ফিরে আসি। টাঙ্গাইল হয়ে ট্রেনটি যমুনা সেতুর পূর্বপাড়ের স্টেশনে সামান্য বিরতি নেয়। সেতুর ওপর আসতেই ট্রেনটির জানালা আর দরজায় যাত্রীদের জটলা বেড়ে যায়। সবাই সেতু আর যমুনা নদী দেখতে হুমড়ি খেয়ে পড়ে। যদিও এ রকম উঁকিঝুঁকি মারা নিষিদ্ধ।
লাহেড়ী মোহন স্টেশন পার হতেই চারপাশের দৃশ্য পাল্টে যেতে থাকে। রেললাইনের পাশে বড় বড় পাকুরগাছ। গাছের ছায়ায় ঘুমিয়ে আছে ক্লান্ত মানুষজন। দূরের মাঠে একদল রাখাল গরু চরাচ্ছে। ছোট্ট একটি খালের ব্রিজ পেরোতেই দেখা মেলে অনেক বক আর পানকৌড়ির।
একটি স্টেশনের নাম দেখি শরৎ নগর। নামটা মনে ধরল। এই লাইনের স্টেশনের নামগুলো অন্য রকম, যেমন_গুয়েখড়া, চাটমোহর, মুড়াকুলি, আবদুলপুর ইত্যাদি। এগুলো পার হয়ে আমরা চলে আসি নাটোর স্টেশনে। এখান থেকে এক নবদম্পতি ট্রেনে উঠল। আত্মীয়-স্বজন অশ্রুজলে তাঁদের বিদায় দিল।
মাধবনগর, আত্রাই হয়ে সান্তাহার স্টেশনে এসে ট্রেনটি থেমে যায়। এখানকার অব্যবহৃত রেললাইন আর পড়ে থাকা বগিগুলোই বলে দেয় স্টেশনটি ব্রিটিশ আমলের। সান্তাহার থেকে লাইন পরিবর্তন করে নীলসাগর ছুটতে থাকে তিলকপুর, জাফরপুর, আক্কেলপুর হয়ে জয়পুরহাট স্টেশনের দিকে।
সান্তাহারের পরের দৃশ্যপট অন্য রকম। তাল আর কাঁঠালগাছে পূর্ণ এ দিকটা। তালপুকুর দেখে ভাবি, যদি নাইতে পারতাম! পরের দৃশ্যেই ভাবনা চাপা পড়ে যায়। চলতে থাকি।
হিলি স্থলবন্দরের ঠিক সামনে দিয়ে আমরা ছুটে চলি। বিরামপুর ছাড়িয়ে ফুলবাড়ী পার হওয়ার সময় খুব কাছ থেকেই বড়পুকুরিয়ার তাপবিদ্যুৎকেন্দ্রটি দেখলাম। কয়লার স্তূপও দেখলাম বেশ কিছু।
পার্বতীপুর এসে নীলসাগর খানিক থামে। এটি একটি জংশন। চারপাশের লাল দালানগুলো পুরনো দিনের কথা বলে। এখানে ডকইয়ার্ড আছে। ১০ মিনিট বিশ্রাম নিয়ে নীলসাগর আবারও চলতে শুরু করে। সৈয়দপুর হয়ে ঠিক সময়েই পেঁৗছে যায় নীলফামারী। সোহরাব বলে, চল নামি। নেমে এসে বন্ধুর বাড়ির পথ ধরি, কিন্তু আমার মন পড়ে থাকে তালপুকুরে।
লেখাটি প্রকাশিত হয়েছে কালেরকন্ঠে, ২৬ জুলাই ২০১০
© 2011 – 2018, https:.