মুলো ঝুলিয়ে কলা দেখানো
পড়ার টেবিলে পড়ছে পৃথা। বয়স দশ। চতুর্থ শ্রেণীর ছাত্রী। গারোদের পরিচিতি পড়ছে সে। গারোদের ঠোঁট মোটা, গায়ের রঙ ফর্সা, আকৃতিতে খাটো প্রভৃতি। এরপরই আসে সাঁওতাল প্রসঙ্গে। সাঁওতালরা দেখতে কালো, চুল কোঁকড়ানো, ঠোঁট মোটা প্রভৃতি। পৃথার পড়া দেখে ছোটবেলার স্মৃতি মনে ভেসে ওঠে। আদিবাসী সম্পর্কে ছেলেবেলায় প্রথম জানি এভাবেই তাদের শারীরিক আকৃতি, গড়ন আর খাদ্য তালিকা পড়ে। ফলে ছোটবেলা থেকে শিশুমনে ভিন্নরকম চিন্তা জন্ম নেয়। আদিবাসীরা কি বন্য বা হিংস্র? আদিবাসীরা আমাদের থেকে অন্যরকম। আমরা অগ্রসর। আদিবাসীরা পিছিয়ে।
আদিবাসী সম্প্রদায়ের রয়েছে মজার সব লোককথা। আছে আন্দোলন সংগ্রামে নানা বীরের বীরত্বের কাহিনী। আদিবাসী মায়েরা তাদের শিশুদের ছোট ছোট গল্প বলে ঘুম পাড়ায়। সেসব গল্প ঈসপের গল্পকেও হার মানায় । কিন্ত তা না জানিয়ে কেন শুধু আদিবাসীদের দৈহিক পরিচিতি, খাদ্যাভ্যাস আর আবাসের পরিচিতি তুলে ধরা হয় শিশুদের কাছে। কেন আমাদের শিশুদের জানানো হয় না আদিবাসীদের বীরত্বের কাহিনীগুলো। কেনই বা নতুন প্রজন্ম আদিবাসী সম্পর্কে জানতে পারে শুধুই নেতিবাচক সব তথ্যের মাধ্যমে।
ফেইসবুকে এক পাঠকবন্ধুর চিঠি পেয়ে খানিকক্ষণ নীরবে বসে থাকি। সরকার আদিবাসীদের যেভাবে বঞ্চিত করেছে তা নিয়ে যে পরিমাণ লেখালেখি হওয়ার কথা সে পরিমাণ হচ্ছে না। অদ্ভুত এক কারণে দেশের প্রগতিশীল লেখকরা নাকি খানিকটা নীরব। তার মতের সঙ্গে পুরোপুরি একমত না হলেও এটা সত্য এ বিষয়ে যেভাবে প্রতিবাদ বা লেখালেখি করা প্রয়োজন তা হচ্ছে না। আর এ দেশে লিখলে কি হয় তা নিয়েই মনের মধ্যে এক ধরনের প্রশ্ন ঘুরপাক খায়।
আদিবাসীদের নাম নিয়ে সরকার এক ধরনের হীনমানসিকতার প্রকাশ ঘটিয়েছে। আদিবাসী শব্দটি সংস্কৃত শব্দ। আদি অর্থ মূল। বাসী অর্থ অধিবাসী। আদিবাসী বলতে বুঝায় এমন একটি জনগোষ্ঠী যারা মোটামুটিভাবে একটি অঞ্চলে সংগঠিত, যাদের মধ্যে রয়েছে সাংস্কৃতিক ঐক্য এবং যার সদস্যরা মনে করে যে, তারা একই সাংস্কৃতিক এককের অন্তর্ভুক্ত।
১৯৮৯ সালে গৃহীত আন্তর্জাতিক শ্রমসংস্থা (আইএলও) এর ১৬৯ নং কনভেশনের ১নং আর্টিকেলে আদিবাসীদের সম্পর্কে বর্ণনা দেয়া হয়েছে। আন্তর্জাতিক শ্রমসংস্থার সংজ্ঞানুসারে আদিবাসী বা আধা-আদিবাসী হলো তারাই যাদের আর্থ-সামাজিক অবস্থা দেশের অন্যান্য অংশের তুলনায় কম অগ্রসর এবং যাদের জীবনধারা সম্পূর্ণ বা আংশিক পরিচালিত হয় তাদের নিজস্ব প্রথা ও ঐতিহ্য অনুসারে, তাদের নিজেদের অথবা বিশেষ কোনো আইন বা নিয়ম দ্বারা। একটি স্বাধীন দেশের অন্তর্ভুক্ত মানব সম্প্রদায়, যারা বর্তমান রাষ্ট্রসীমা নির্ধারিত হওয়ার পূর্ব থেকে স্থায়িভাবে বসবাস করে আসছে; যাদের নিজেদের সামাজিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য রয়েছে- একটি জনগোষ্ঠী হিসেবে তারা সেদেশে বসবাস করে, অথচ সে দেশের জাতীয় কার্যাবলি পরিচালনাকে নিয়ন্ত্রণ করে না, তারাই হচ্ছে আদিবাসী।
আবার নৃতাত্ত্বিক দৃষ্টিকোণে আদিবাসী পরিচয় নির্ধারণে কারা আদি বাসিন্দা কারা নন এটি বিবেচ্য বিষয় নয়। প্রাক-ঔপনিবেশিক সময় থেকে যারা যে অঞ্চলে বসবাস করছে তারা সে এলাকার আদিবাসী হিসেবে বিবেচিত হবেন এবং যাদের সঙ্গে প্রাকৃতিক সম্পদের সম্পর্ক আছে, যাদের নিজেদের সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক ব্যবস্থা আছে, যাদের নিজেদের ভাষা, সংস্কৃতি ও বিশ্বাস আছে তারাই আদিবাসী। তাই আদিবাসীদের ‘আদিবাসী’ হিসেবে স্বীকার করার অর্থ এই নয় যে, তারাই এই অঞ্চলের আদি বাসিন্দা, বাঙালিরা নয়। এটি এক ধরনের উদ্দেশ্যপ্রণোদিত, বিভ্রান্তিমূলক প্রচারণা।সংবিধানের এবারের সংশোধনীতেও আদিবাসীরা উপেক্ষিত হয়েছে। গত ১২ জুলাই ‘ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান আইন’ জাতীয় সংসদের পাসের মাধ্যমে আদিবাসীদের নামকরণ হয়ে যায় ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী হিসেবে। অথচ ব্রিটিশ, পাকিস্তান এবং বাংলাদেশের বিভিন্ন আইন ও সরকারি দলিলে আদিবাসী শব্দটির ব্যবহার রয়েছে। পার্বত্য চট্টগ্রাম শাসন বিধি ১৯০০, পূর্ববঙ্গ জমিদারি দখল ও প্রজাস্বত্ব আইন ১৯৫০, আয়কর আইনসহ সরকারি বিভিন্ন পরিপত্র, দলিল ও হাইকোর্টের রায়ে আদিবাসী শব্দটির উল্লেখ রয়েছে। ক্ষমতাশীল আওয়ামী লীগ তাদের নির্বাচনী ইশতেহার-২০০৮ এ ১৮(২) ধারায় আদিবাসী শব্দটি ব্যবহার করেছে।
গত ১৯ জুলাই দৈনিক কালের কণ্ঠে প্রকাশিত ইউপিডিএফ-এর প্রধান প্রসিত খিসার এক সাক্ষাৎকারে জানান, ১৯৭২ সালে পাহাড়ি জনগণের একটি প্রতিনিধি দল তাদের অধিকার আদায়ের লক্ষ্যে একটি স্মারকলিপি পেশ করে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কাছে। তৎকালীন সংসদ সদস্য মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমা নেতৃত্ব দেন দলটির। সেদিন বঙ্গবন্ধু স্মারকলিপিটি মানবেন্দ্র লারমার দিকে ছুড়ে দিয়ে বলেছিলেন, ‘না আমরা সবাই বাঙালি, আমাদের দুই ধরনের সরকার ব্যবস্থা থাকতে পারে না। তোমরা তোমাদের জাতীয় পরিচয় ভুলে যাও এবং বাঙালি হয়ে যাও’। এভাবেই ৭২ এর সংবিধানে তাদের অস্তিত্ব স্বীকার করা হয়নি। রক্ষা করা হয়নি তাদের ঐতিহ্য, ভাষা, সংস্কৃতি, আচার-আচরণ। ফলে হারিয়ে যায় তাদের ভিটেমাটি, বসতবাড়ি ও ভূমির অধিকারটুকুও। তাদের প্রতি বিশেষ কোনো দায়িত্বও পালন করেনি তখনকার সরকার। বরং তাদের সবাইকে বাঙালি হিসেবেই চালিয়ে দেয়ার চেষ্টা করা হয়েছে।
এরপরে আসে জিয়াউর রহমানের সরকার। আদিবাসী রূপ নেয় উপজাতিতে। পাহাড়ে বসানো হয় সেটেলার বাঙালিদের। পাকাপোক্তভাবে বসে সেনাবাহিনী। বিভিন্নরূপে নানা নির্যাতন ও পীড়নের শিকার হয় আদিবাসীরা। ফলে এক সময় আদিবাসীরা হাতে অস্ত্র তুলে নেয়। তাদের অধিকারের জন্য লিপ্ত হয় সশস্ত্র সংগ্রামে।
সাপ্তাহিক-এর সম্পাদক গোলাম মোর্তোজার শান্তিবাহিনী বইটিতেই পাওয়া যায়, কেন আদিবাসীরা অস্ত্র তুলে নিয়েছিল সে বিষয়ে অজানা সব তথ্য। বাঙালি হিসেবে আমরা আমাদের বুটওয়ালাদের দিয়ে কিভাবে জ্বালিয়ে দিয়েছি আদিবাসীদের গ্রামগুলো। তার সচিত্র প্রতিবেদন পাওয়া যায় বইটিতে। যে বৈষম্য আর অত্যাচারের বিরুদ্ধে এদেশের মানুষ অস্ত্র তুলে নিয়েছিল পাকিস্তানের বিরুদ্ধে। সেই স্বাধীন দেশেই নিজেদের অধিকারের জন্য সংগ্রাম করতে হয় আদিবাসীদের। পাহাড়ে অত্যাচারের এমন সব ঘটনা ঘটতে থাকে যার সংবাদ পৌঁছায় না নগরের মানুষের কাছে। পাহাড়ের সেই সংগ্রাম শান্তিতে রূপ নেয় ১৯৯৭ সালে। বর্তমান প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বে। শান্তি চুক্তি সম্পাদিত হয়। কিন্তু পুরোপুরি বাস্তবায়ন ঘটেনি এখনও। তাই এবারের সংবিধান সংশোধনের সময় বর্তমান প্রধানমন্ত্রীর কাছে ভিন্ন ধরনের প্রত্যাশা ছিল সবার। কিন্তু সব আশার গুড়ে যেন বালি পড়ে। মুলো ঝুলিয়ে কলা দেখানো হয় আদিবাসীদের। চুক্তির বাস্তবায়ন তো দূরের কথা সংবিধানে তাদের স্বীকৃতি মিলে না। মিলে না আদিবাসী হিসেবে তাদের চিরচেনা নামটির স্বীকৃতি পর্যন্তও।
সংশোধিত সংবিধানের ১৫ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, উপজাতি, ক্ষুদ্র জাতিসত্তা, নৃ-গোষ্ঠী ও সম্প্রদায়ের ঐতিহ্য সংরক্ষণ, উন্নয়ন ও বিকাশ নামে ২৩(ক) অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে ‘রাষ্ট্র বিভিন্ন উপজাতি, ক্ষুদ্র জাতিসত্তা, নৃ-গোষ্ঠী ও সম্প্রদায়ের অন্যান্য বৈশিষ্ট্যপূর্ণ আঞ্চলিক সংস্কৃতি এবং ঐতিহ্য সংরক্ষণ, উন্নয়ন ও বিকাশের ব্যবস্থা গ্রহণ করিবে’। আবার ৬ নং অনুচ্ছেদে বাংলাদেশে বাঙালি ছাড়া অন্য সব মানুষের অস্তিত্ব অস্বীকার করা হয়েছে। সেখানে বলা হয়েছে, ‘বাংলাদেশের জনগণ জাতি হিসেবে বাঙালি এবং নাগরিকগণ বাংলাদেশি বলিয়া পরিচিত হইবেন’। ফলে অন্য ভাষাভাষির জনগোষ্ঠীর অস্তিত্ব হুমকির মুখে পড়েছে।
আদিবাসী হিসেবে স্বীকৃতি না দেয়ার কারণ সম্পর্কে তথ্য পাওয়া যায় গত ৭ জুলাই সাপ্তাহিকে প্রকাশিত চাকমা রাজা ব্যারিস্টার দেবাশীষ রায়ের বক্তব্য থেকে। তিনি আদিবাসী হিসেবে স্বীকৃতি না দেবার দুটি কারণ তুলে ধরেন। প্রথমত, আদিবাসী হিসেবে স্বীকৃতি দিলে আন্তর্জাতিক আইন অনুসারে এই জনগোষ্ঠীর জন্য রাষ্ট্রের দায়দায়িত্ব অনেক বেড়ে যায়, যা সরকার বোঝা মনে করে। দ্বিতীয়ত, সাংবিধানিক স্বীকৃতির সঙ্গে আদিবাসীদের ভূমির অধিকারসহ অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা দিতে হবে যা হয়ত সরকার দিতে চায় না। তিনি জানান আদিবাসীদের স্বীকৃতি দেয়ার সঙ্গে সঙ্গে সরকারকে প্রায় অর্ধশতাধিক শর্ত বাস্তবায়ন করতে হবে। যার মধ্যে রয়েছে আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার ও নিজস্ব সংগঠন করার অধিকার।
এদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে আদিবাসীরাও বাঙালিদের সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে মুক্তিযুদ্ধ করেছে। অথচ এই স্বাধীন দেশে তারা পাচ্ছে না নিজেদের স্বীকৃতিটুকু। মুক্তি পাচ্ছে না ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী নামের বৈষম্যমূলক জাঁতাকল থেকে। আমরা চাই না একটি স্বাধীন দেশে অন্য জাতিকে ক্ষুদ্র গোষ্ঠী বলতে, চাই না আদিবাসীদের স্বীকৃতি না দিয়ে হীন মানসিকতার বাঙালি হতে। চাই আদিবাসীদের সঙ্গে হাতে হাত রেখে দেশকে এগিয়ে নিতে।
লিখাটি প্রকাশিত হয়েছে সাপ্তাহিকে ৪ আগষ্ট ২০১১
© 2011 – 2018, https:.