ডিসেম্বরের চৌদ্দ তারিখ। দিনাজপুরের সীমান্তবর্তী উপজেলা বিরল। সারাদেশের মতো এখানেও চলছে বিজয় উদ্যাপনের প্রস্তুতি। নানা স্লোগানের রঙচঙ্গা ব্যানার ঝুলছে সবখানে। রাস্তায় চলছে ধান বোঝাই বড় লরি আর ছোট ভটভটি। সেগুলোতে পত্ পত্ করে উড়ছে লাল-সবুজের পতাকা। ডিসেম্বর তাই পতাকা ওড়ানোর মাস। গ্রামের হোটেলগুলোতে অবিরতভাবে বাজছে ‘জয় বাংলা বাংলার জয়’-এর মতো মুক্তিযুদ্ধের গান। অথচ অন্য সময়ে এখানে শোনা যেত হিন্দি গানের সুর ‘তু চিজ বারী হে মাস্তে মাস্তে’। হোটেলের মধ্যে চা বানাতে বানাতে মাঝ বয়সী আরিফুল জানাল আজ ‘বিরল মুক্ত দিবস’। দিবসটি উপলক্ষে এবারই প্রথম সরকারিভাবে আয়োজন করা হয়েছে নানা অনুষ্ঠানের। পাঁচদিনব্যাপী বিজয় মেলার পাশাপাশি মুক্তিযোদ্ধাদের সংবর্ধনার জন্য তৈরি হয়েছে বিজয় মঞ্চ। স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধাদের শ্রদ্ধা জানাবে সংসদ সদস্যসহ স্থানীয় সুধী সমাজ। মুক্তিযুদ্ধের নানা কাহিনী, মুক্তিযোদ্ধাদের নানা দাবিসহ মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে সরকারের নানা পরিকল্পনার কথা জানবে বিরলবাসী।
চায়ে চুমুক দিয়ে সকল মুক্তিযোদ্ধা উপস্থিত থাকবে কিনা জানতে চাইলে চা খেতে আসা এক ভদ্রলোক পাশ থেকে উত্তর দেন, ‘অনেক অমুক্তিযোদ্ধাও উপস্থিত থাকবেন’। লোকটির কথায় অবাক হলাম। পরিচয় জানতেই মুচকি হেসে নিজেকে পরিচিত করলেন একজন মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে।
লোকটি ৭নং সেক্টরের যোদ্ধা ছিলেন। নাম রবাট আর এন দাস। পরিবারের পাঁচ ভাইয়ের মধ্যে সবাই মুক্তিযোদ্ধা। বড় ভাই জর্জ জে এম দাস শিববাড়ী ইয়ুথ ক্যাম্পের দায়িত্বে ছিলেন। সকলের কাছে তিনি জর্জভাই নামে পরিচিত। রবাট জানাল, ‘বাঁচার পথ’ নামক একটি প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে তিনি এই অঞ্চলের আদিবাসীদের ভাগ্য উন্নয়নের জন্য কাজ করছেন। নানা কথার ফাঁকে তার কাছ থেকে জানতে পারি নিভৃত ও বঞ্চিত এক মুক্তিযোদ্ধা আদিবাসীর কথা। যিনি শিববাড়ী ইয়ুথ ক্যাম্পে জর্জ জে এম দাসের কাছ থেকে প্রশিক্ষণ নিয়ে হিলিসহ রামসাগর এলাকায় যুদ্ধ করেছেন। স্বাধীনতার ৩৮ বছর পরেও যিনি পাননি মুক্তিযোদ্ধার কাগুজে সনদ।
আদিবাসী এই মুক্তিযোদ্ধার নাম থোপাল কড়া। সম্প্রদায়ের রীতি অনুসারেই নিজ নাম থোপাল এর শেষে সম্প্রদায়ের নাম ‘কড়া’। রবাটের মুখে অভিমানী এই মুক্তিযোদ্ধার কথা শুনে আমাদের আগ্রহ বেড়ে যায়। তাই তার সঙ্গে দেখা করতে রওনা হই বিরলের সীমান্তবর্তী হালজার গ্রামের দিকে। মূলত এ গ্রামটিতে নানা আদিবাসী সম্প্রদায়ের বাস। চলার পথেই নানা ভাষাভাষির লোক দেখে তা বেশ টের পাওয়া যায়। গ্রামটিতে সাঁওতালদের আধিক্য থাকলেও আছে ওরাঁও, ভুনজার, মু-া পাহানসহ অন্যান্য আদিবাসী সম্প্রদায়। রবাট জানাল, এক সময় এ গ্রামে কড়া সম্প্রদায়ের দু’শটি পরিবারের বসবাস ছিল। অথচ এখন গোটা বাংলাদেশের মধ্যে টিকে আছে মাত্র ১৯টি পরিবার। এ গ্রামেই বাস করছে ১৬টি পরিবার। ভূমি সংক্রান্ত বিরোধের কারণেই স্বতন্ত্র ধর্ম ও ভাষাভাষির এ সম্প্রদায়টির অধিকাংশ লোকই চলে গেছে ভারতে।
পাকা রাস্তা পার হয়ে আমরা নেমে পড়লাম গ্রাম্য পথে। এ রাস্তাটি বেশ অপ্রশস্ত ও ভাঙ্গাচোড়া। রাস্তার দুদিকে তুঁতগাছের সারি শেষ হতেই পাড়া আকৃতির একটি ছোট গ্রাম। বিধ্বস্ত কিছু বাড়ি চোখে পড়ল এখানে। এনজিওদের দেয়া একটি পাকা ল্যাট্রিন আর একটি টিউবওয়েলই গ্রামটিতে আধুনিকতার একমাত্র চিহ্ন। এটিই মুক্তিযোদ্ধা থোপালের ‘কড়া’ গ্রাম। গোত্রের মাহাতো জগেন কড়ার সঙ্গে আমার পৌঁছে যাই থোপালের বাড়িতে। ভাঙ্গাচোরা একটি মাটির ঘর থেকে বের হলো তার স্ত্রী তুলো কড়া। সঙ্গে তিন সন্তান রাকি কড়া, সুমন কড়া আর মুক্তা কড়া। তুলো আমাদের দেখেই কড়া ভাষায় বলে ‘জোহার’ (নমস্কার)। বসতে দেয়ার মতো তেমন কিছু না পেয়ে লজ্জিত ভঙ্গিতে তুলো ঘরে চলে যায়। খানিক পরেই ধরে ধরে নিয়ে আসে মুক্তিযোদ্ধা থোপাল কড়াকে। তুলো জানাল দুই দিন ধরে জ্বরের সঙ্গে যুদ্ধ করছে সে।
কারিতাস থেকে ৪০০০ টাকা ঋণ নিয়ে কেনা ভ্যান গাড়িটিই এ পরিবারটির আয়ের একমাত্র পথ। প্রতিদিন ৮০ থেকে ১০০ টাকা আয় করে তা দিয়েই চলে সংসার। জ্বরের কারণে দুই দিন ভ্যান চালাতে পারেনি মুক্তিযোদ্ধ থোপাল। তাই কুিড়য়ে আনা কচু শাক দিয়েই চলছে তিন বেলা।
২০০১ সালে থোপালের পরিবারের সঙ্গে জমিজমা নিয়ে বিরোধ হয় স্থানীয়দের। হুমকির ভয়ে পরিবারের অন্য ভাই-বোনেরা সে সময় পালিয়ে যায় ভারতের কুসম-ি থানার জামবাড়ী গ্রামে। কিন্তু নানা হুমকিতেও মুক্তিযোদ্ধা থোপাল দেশ ছাড়ে না। একইভাবে নিজেকে মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে পরিচয় দিতেও ততটা আগ্রহী নন তিনি। তবুও আমাদের অনুরোধের চাপে মলিন মুখে বলতে থাকেন মুক্তিযুদ্ধের সময়কার নানা স্মৃতি।
বাবা পোকুয়া কড়া আর মা ফকনি কড়ার ছয় সন্তানের মধ্যে থোপাল কড়া ছিল দ্বিতীয়। রেডিওতে বঙ্গবন্ধুর ভাষণ শুনে বড় ভাই গোপাল কড়ার সঙ্গে তিনিও দেশ স্বাধীন করার জন্য উজ্জীবিত হয়ে ওঠেন। গোপাল ও গোত্রের আরেক যুবক সাতান কড়া গোপনে আদিবাসীদের যুদ্ধে যাওয়ার প্রচারণা চালাতে থাকে, কড়া ভাষায় সকলকে বলতে থাকে, ‘চালা দেশ স্বাধীন কারোওয়ে, সবইন মিলকে দেশ স্বাধীন কারোওয়ে।’
যুদ্ধ শুরুর পর পরই বড় ভাই গোপাল কড়া যুদ্ধে চলে যায়। কিন্তু পরিবারের চাপে তখনো থোপাল যেতে পারে না। দেশের স্বাধীনতার জন্য যুদ্ধে যেতে তাঁর মন আনচান করতে থাকে। যুদ্ধের মাঝামাঝি সময়ে মার কাছে নানিবাড়ি বেড়াতে যাওয়ার নাম করে থোপাল পালিয়ে চলে যায় মুক্তিযুদ্ধে। প্রথমে শিববাড়ী ইয়ুথ ক্যাম্পে ট্রেনিং নেন। ট্রেনিং শেষে ৭ নং সেক্টরের অধীনে কমান্ডার ইদ্রিস আলীর নেতৃত্বে হামজাপুর ক্যাম্প থেকে হিলিসহ নিকটবর্তী গ্রামগুলোকে শত্রুমুক্ত করার জন্য যুদ্ধ করেন।
মুক্তিযুদ্ধের নানা কাহিনী বলতে গিয়ে থোপালের চোখ বার বার ভিজে যাচ্ছিল। দেশের জন্য যুদ্ধ করতে গিয়ে কতদিন না খেয়ে কেটেছে, কতরাত কেটেছে ডোবার পানির মধ্যে, গোরস্তানে। যুদ্ধের সময়ে থোপাল সহযোদ্ধাদের মৃত্যুযন্ত্রণা দেখেছেন কাছ থেকে। যুদ্ধের সময় দূর থেকে হানাদার আর রাজাকার বাহিনীর অত্যাচারের কথা শুনে নিজের পরিবারের চিন্তায় থোপাল আঁতকে উঠতেন। সহযোদ্ধা খলিল, কবির, রফিক, নুয়ন আর নুরু মিলে একটি গ্রামকে শত্রুমুক্ত করার কথা বলতে গিয়ে মুক্তিযোদ্ধা থোপাল কড়া আবেগতাড়িত হয়ে পড়েন। ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর দিনাজপুর স্টেডিয়ামে অস্ত্র জমা দিয়ে থোপাল কড়া ফিরে আসেন নিজেদের কৃষিকাজে।
মুক্তিযুদ্ধের সময় আদিবাসী-বাঙালি একসঙ্গে যুদ্ধ করলেও স্বাধীনের পর পর সবকিছু বদলে যেতে থাকে। থোপাল আক্ষেপ করে বলেন, ‘মুক্তিযুদ্ধ করে দেশ স্বাধীন হলো আর আমরা হয়ে গেলাম সংখ্যালঘু আদিবাসী সম্প্রদায়’। ভূমি নিয়ে চলে নানা ঘটনা। কিছুদিন আগেও গোত্রের অন্ত কড়াকে স্থানীয়দের হুমকির মুখে দেশ ছাড়তে হয়েছে। থোপাল বলে স্বাধীনের পর এ দেশ মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে ‘হামে নাহি খোজেয়ে’।
থোপাল জানায়, মুক্তিযুদ্ধের পর যুদ্ধে অংশগ্রহণের যে কাগজপত্র তার ছিল তা দিয়ে পরবর্তীতে মুক্তিযোদ্ধা সনদ গ্রহণের নিয়ম, পদ্ধতি ও সুবিধা লাভের বিষয়টি ছিল তার কাছে বেশ অস্পষ্ট। সীমান্তবর্তী গ্রামের এই মুক্তিযোদ্ধা ভাবতেন, ‘কাগুজে এই সনদ দিয়ে কী হবে’। তাই অযতেœ পড়ে থাকা কাগজগুলো বন্যার পানিতে ভেসে যায়। শুধু মুক্তিযুদ্ধ আর বঙ্গবন্ধু বেঁচে থাকে থোপালের মনে। আজও এই স্বাধীন দেশে প্রতিটি দিনই তার কাটাতে হয় জীবনযাপন আর গোত্র টিকিয়ে রাখার যুদ্ধে। নিজেকে পরিচয় দেন না মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে। মুক্তিযুদ্ধ করার বিপরীতে সুবিধা লাভে তিনি আগ্রহী নন। তিনি বলেন, ‘যুদ্ধ করেছি দেশের জন্য, শুধু চাই স্বাধীন দেশে নিজের অধিকারটুকু নিয়ে বেঁচে থাকতে।’
মুক্তিযোদ্ধা এই আদিবাসীর সঙ্গে যতই কথা বলছিলাম ততই তার প্রতি শ্রদ্ধায় আমাদের মাথা নত হচ্ছিল। কাগুজে সনদ না থাকায় কোন ডিসেম্বরেই থোপালের মতো মুক্তিযোদ্ধারা সম্মানিত হন না। এদেশে প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা তৈরি হয়নি অদ্যাবধি। যার উদ্যোগ নেয়ার প্রয়োজন ছিল যুদ্ধের পর পরই। অথচ অবাক আর লজ্জিত হতে হয় যখন দেখা যায় অমুক্তিযোদ্ধা আর রাজাকারেরাও মুক্তিযোদ্ধা ভাতা নিচ্ছেন, পাচ্ছেন মুক্তিযোদ্ধার সম্মান।
এদেশে সরকার পরিবর্তনের পর পরই পরিবর্তিত হয় মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা। সে সুযোগে মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে সনদপত্র পায় অমুক্তিযোদ্ধা ও রাজাকারেরাও। ফলে স্বাধীনতার পর নানা দলে বিভক্ত হয়ে পড়ছে জাতির সূর্যসন্তানেরা। মুক্তিযুদ্ধের ৩৮ বছর পরেও এদেশে থোপাল কড়ার মতো নিভৃত, বঞ্চিত, ত্যাগী ও অভিমানী মুক্তিযোদ্ধাদের খুঁজে পাওয়া যায়। যাদের কোনো কাগুজে সনদ নেই। আছে দেশের জন্য বুকভরা ভালোবাসা।
তাই দেশের স্বার্থে, জাতির স্বার্থে থোপাল কড়াদের মতো মুক্তিযোদ্ধা, আদিবাসী মুক্তিযোদ্ধাদের খুঁজে বের করা প্রয়োজন। শোনা যাচ্ছে এ সরকার প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা তৈরির উদ্যোগ নেবে। নিয়মনীতির বেড়াজাল ভেঙ্গে থোপাল কড়াদের মতো মুক্তিযোদ্ধা আদিবাসীদের কি ঠাঁই হবে সে তালিকায়? মুক্তিযোদ্ধার কাগুজে সনদ পাওয়া না-পাওয়ার দোলায় এভাবেই হয়ত একদিন নিভে যাবে একজন সূর্যসন্তানের জীবনপ্রদীপ।
লিখাটি প্রকাশিত হয়েছে সাপ্তাহিকে ১৫ এপ্রিল ২০১০
© 2011 – 2018, https:.
