ওরাও বিশ্বাসে উল্কি ও সিঁদুর
চামড়ায় ভাঁজ পড়া এক বৃদ্ধা পাটি বুনছে আপন মনে। বয়স নেহাত কম হবে না। একশ কিংবা তারও বেশি। কোন সাড়াশব্দ নেই তার। দশ বারো বছরের এক শিশু বাড়ির উঠানে তুলসী দেবতাকে ভক্তি দিচ্ছে ফুল ছিটিয়ে। সে জানালো বৃদ্ধা ‘নিপাকে নানী’। রংপুর থেকে বেড়াতে এসেছেন মেয়ের বাড়িতে। আমরা কাছে এগোই। তবুও যেন বৃদ্ধার দৃষ্টি পড়ে না আমাদের ওপর। আনমনে পাটিই বুনে যাচ্ছেন তিনি।
পেছন থেকে জোহার বলে আমাদের বসতে বলে বৃদ্ধার মেয়ে শুকুমনি টিগ্গা। মেয়ের কণ্ঠে বৃদ্ধা মুখ তোলে। আমাদের দেখে একচিলতে হাসি যেন ছুঁয়ে যায় মুখে। শুকুমনি জানাল তার মায়ের নাম ‘পারলো টিগ্গা’।
এ গ্রামটি দিনাজপুরের একেবারে সীমান্তবর্তী। গ্রামের নাম বহবলদিঘী। বহবলদিঘীর ওরাও পাড়াতেই পারলো বিয়ে দিয়েছে তার মেয়েকে। মা ও মেয়ের গলায় চামড়ার ওপর কালো রঙের দাগ আমাদের দৃষ্টি এড়ায় না। দাগগুলো প্রায় একই ধরনের। গলায় কিসের দাগ? প্রশ্ন করতেই কাপা কাপা গলায় পারলোর উত্তর। এটি ‘উল্কি’।
প্রকৃতজনেরা কখনো বয়সের ভারে কাবু হয় না। এ কারণেই পারলো বেশ কর্মঠ ও প্রাণবন্ত। সে জানাল ওরাওদের উল্কি তৈরির নিয়ম এবং উল্কি নিয়ে নানা বিশ্বাসের কথা।
ওরাও সম্প্রদায়ে বারো-চৌদ্দ বয়সে নিয়মানুসারে শরীরে উল্কি আঁকতে হয়। একপ্রকার লতা বেটে তার সাথে মাটির পাতিলের নিচে পোড়া কালি আর দুধ মিশিয়ে মিশ্রণ তৈরি করা হয়। অতঃপর এক জোড়া সুচ আগুনে পুড়িয়ে দেহের যেখানে যেখানে উল্কি আঁকতে হবে সেখানে দ্রুত স্পর্শ করে আঁকা হয় নানা চিত্র। এরপর সে জায়গায় লতাবাটা, কালি আর দুধ মিশ্রণ লাগিয়ে দেয়া হয়। ঘা শুকালে কালো রঙের চিরস্থায়ী উল্কির আকার চামড়ার মধ্যে ভেসে ওঠে। এ রঙ সারা জীবনে একটুকুও পাল্টায় না।
কবে এবং কেন ওরাও সম্প্রদায়ের আদিবাসীদের মাঝে উল্কির প্রচলন হলো? এ নিয়ে অন্যান্য সম্প্রদায়ের মতো ওরাওদের বিশ্বাসে বদ্ধমূল হয়ে আছে প্রাচীন এক কাহিনী। পারলো টিগ্গা থেমে থেমে বলতে থাকে কাহিনীটি :
পৃথিবী সৃষ্টির শুরুতে মানুষ ছিল এক জাতের। কারো কোনো পেশা ছিল না। পেশা না থাকায় ছিল না জাতও। পেশা গ্রহণের জন্য ধরমেশ সবাইকে ডেকে পাঠালেন। সবাই উপস্থিত হলো।
ধরমেশ একজনকে দিলেন লাঙ্গল। তখন সে হলো চাষি। আরেকজনকে দিলেন কুঠার। সে হয়ে গেল কাঠুরে। একজনকে দিলেন মাছ ধরার জাল। সে হলো জেলে। একজনকে দিলেন কাপড় বোনার সুতা। সে হয়ে গেল তাঁতি।
সবাই সব কিছু পেল। অবশিষ্ট থাকল একটি দোতারা। শেষে এক ব্যক্তি পেল সেটি। সে ব্যক্তি দোতারা নিয়ে বাড়ি বাড়ি ঘুরে গান গায়। ফলে সমাজে তার সম্মান বেড়ে যায়।
একদিন সে বাড়ি ফিরে রান্না ভাল না হওয়ায় স্ত্রীকে মেরে বাড়ি থেকে বের করে দেন। মনের দুঃখে কাঁদতে কাঁদতে স্ত্রী বনে চলে যায়। বনের মধ্যে ছিল এক দেবতা। তার দয়া হলো। তিনি তার কান্না থামালেন আর বললেন, ‘আমি তোমাকে এমন কাজ দেব যে কাজের জন্য সবাই তোমাকে আদর করবে’।
দেবতা তাকে উল্কি আঁকার সব পন্থা শিখিয়ে দিল। সে থেকেই পৃথিবীতে উল্কির প্রচলন হয়। শুধু উল্কি চিহ্ন নয়, উল্কি শিল্পীও ওরাওদের কাছে পবিত্রতার প্রতীক হিসেবে বিবেচিত হয়।
আদিবাসী সমাজে উল্কি ধর্মীয় ও সামাজিক উভয় ক্ষেত্রেই প্রচীনতম নির্দশন। আদি পর্যায়ে কোন ব্যক্তি বা গোষ্ঠীকে শনাক্তকরণের একমাত্র চিহ্ন ছিল এই উল্কি। ওরাও সমাজে এ রীতির প্রচলন অধিক মাত্রায়। এরা উল্কি অঙ্কনের পূর্বে পূজা দেয় এবং তাতে বলির ব্যবস্থা থাকে। উল্কি যেন ভালোভাবে আঁকা হয়, ঘা যেন তাড়াতাড়ি শুকায় আর অপদেবতাদের দৃষ্টি যেন কোনোভাবেই না পরে সেটিই থাকে পূজার উদ্দেশ্য।
তাই মেয়ে ও ছেলে সবাই শরীরের বিভিন্ন স্থানে উল্কি আঁকে। সাধারণত উল্কির স্থান হাতের তালু, হাতের এপিঠ ওপিঠ, বুক এমনকি গণ্ডদেশ। উল্কি হিসেবে আঁকা হয় লতাপাতা, গোল চক্র, পশুপাখি, সূর্য, চন্দ্র, তারা প্রভৃতি। আদিবাসী ওরাওরা বিশ্বাস করে উল্কি ছাড়া কোন ধুমকুরিয়ায় যেতে পারে না। একইভাবে কোনো নারী বা পুরুষ যদি উল্কিবিহীন মারা যায় তবে যমরাজা তাকে মানব রূপে গ্রহণ করে না। ফলে অনন্তকাল তাকে নরকে থাকতে হয়। এ কারণে ওরাও সম্প্রদায়ে কারো শরীরে উল্কি না থাকলে মৃত্যুর পরে দাহর আগে তার শরীরে উল্কি একে দেয়ার রীতি চালু আছে।
উল্কি নিয়ে যখন নানা আলাপ চলছে তখনই সেখানে উপস্থিত হয় পাশের বাড়ির দুলালী টপপো। তার চুলের সিতা বরাবর ভরাট সিঁদুর দেয়া। সাজগোজ বেশ পরিপাটি। বোঝা যায় কয়েকদিন আগেই বিয়ে হয়েছে তার। দুলালীর সঙ্গে কথা বলতে বলতেই সেখানে চলে আসেন গোত্রের মহত টেম্পু টিগ্গা। টেম্পু জানল সিঁদুর নিয়ে ওরাওদের বিশ্বাসের নানা কাহিনীগুলো।
আদিবাসীরাই প্রথম সিঁদুরের প্রচলন শুরু করে। তারা মনে করে লাল রং ভগবানের পছন্দের। তাই বিয়ে ও পূজার আনুষ্ঠানিকতাসহ নানারীতিতেই ব্যবহার করা হয় সিঁদুরকে। বিয়েতে মেয়েদের নতুন জীবনের সূচনাক্ষণে হয় সিঁদুর দান পর্বটি। অন্যান্য আদিবাসী সম্প্রদায়ের মতো ওরাওরা বিশ্বাস করে লাল রঙে আছে অতিমাত্রায় জীবনসার। তাই লাল রং তাদের কাছে যৌন চিহ্ন ও বিজয়ের বার্তা ঘোষক হিসেবে বিবেচিত হয়। সিঁদুর নিয়ে ওরাওদের মধ্যে প্রচলিত কাহিনীটি শুনি মহতের জবানিতে :
চার বন্ধু কোন এক কাজে অন্য দেশে রওনা হলো। যেতে যেতে তারা পৌঁছলো এক জঙ্গলের কাছে। ঠিক তখনই রাত নেমে আসল। তখন কি আর করা, সবাই সিদ্ধান্ত নিলো জঙ্গলের মধ্যেই রাত্রিযাপনের। বিপদ এড়াতে পালাক্রমে একজন একজন জেগে থেকে পাড় করে দেবে রাত্রিটি। সে রকমই পরিকল্পনা।
চারবন্ধুর মধ্যে একজন কাঠুরে, একজন স্বর্ণকার, একজন তাঁতি এবং চতুর্থজন ছিল সিঁদুর বিক্রেতা। প্রথমে কাঠুরে জেগে থাকল আর বাকি তিনজন ঘুমিয়ে পড়ল। কাঠুরে জেগে জেগে কি করবে? সে একটি কাঠ কেটে এনে তা থেকে গড়ল অপরূপ সুন্দরী এক নারী মূর্তি। মূর্তি তৈরি করেই স্বর্ণকার বন্ধুটিকে জাগিয়ে দিয়ে সে ঘুমিয়ে পড়ল।
স্বর্ণকার বন্ধুটি ঘুম থেকে জেগেই নারী মুর্তিটিকে দেখে তো অবাক! সে জেগে আর কি করবে? গয়না তৈরি করে সাজালো মূর্তিটিকে। অতঃপর সে তাঁতি বন্ধুটিকে জাগিয়ে নাক ডেকে ঘুমাতে থাকল।
তাঁতি জেগে জেগে কি করবে? সে কাপড় তৈরি করে মূর্তিটিকে সুন্দর করে জড়াল। অতঃপর সে সিঁদুর বিক্রেতা বন্ধুটিকে জাগিয়ে নিজে ঘুমিয়ে পড়ল।
সিঁদুর বিক্রেতা নারী মূর্তি দেখে তো অবাক। দুপুর রাত্রে এমন সুন্দরী নারী মূর্তি কোথা থেকে এলো? সে আর কি করবে। সিঁদুর পরিয়ে দিল মুর্তিটিকে। আর অমনি নারীমূর্তিটি প্রাণ পেয়ে কথা বলতে থাকল।
শব্দ পেয়ে অন্য বন্ধুদের ঘুম ভাঙল। সবাই তো অবাক। মূর্তি হয়ে গেছে সুন্দরী রমণী। কাঠুরে বলে, ‘ও আমার’। কারণ আমিই ওকে প্রথম গড়েছি। স্বর্ণকার বলে, ‘আমি ওকে সাজিয়েছি। তাই ও আমার’। তাঁতি বলে, ‘আমি ওর লজ্জা ঢেকেছি। সুতরাং ও আমারই হবে’। সিদুর বিক্রেতা বলে ‘ আমার সিঁদুরে ও প্রাণ পেয়েছে। তাই ও আমার।’ এ নিয়ে চারবন্ধুর মধ্যে তুমুল ঝগড়া শুরু হয়।
ঝগড়া দেখে সেখানে উপস্থিত হয় এক দেবতা। চার বন্ধুই দেবতাকে সব কথা খুলে বলে এবং সুন্দরী রমণীকে তাদের দাবি করে। সব শুনে দেবতা খানিক হাসেন।
অতঃপর দেবতা রায় দেন, ‘যে কাঠ দিয়ে মূর্তি গড়ল সে ওর বাবা। যে অলঙ্কার তৈরি করে সাজিয়েছে সে ওর মামা। যে কাপড় পরিয়েছে সে ওর ভাই। আর যে সিঁদুর দান করে ওর প্রাণ দিয়েছে সে ওর স্বামী’। দেবতার রায় মেনে নিয়ে চারবন্ধুই বাড়ি ফিরে আসে’।
সিঁদুর দান থেকে এভাবেই একটি সুখী পরিবার তৈরি হয়।
বাঙালি হিন্দু সমাজে সিঁদুরের ব্যবহারটি এসেছে আদিবাসী সমাজ থেকেই। হিন্দুদের শাস্ত্রীয় গ্রন্থ পুরাণ, ভবিষ্যৎ পুরাণ প্রভৃতিতে ঘট স্থাপনের কথা বলা হলেও কোথাও সিঁদুরের উল্লেখ নেই। বাংলার ভট্টভবদেব এবং পশুপতি পণ্ডিতসহ অনেকেই সিঁদুর দানের বিষয়ে পৌরাণিক কোনো শাস্ত্র খুঁজে পাননি। ফলে সর্বপ্রথম পালযুগে ভট্টভবদেব এবং পশুপতি ভদ্র হিন্দু সমাজে প্রচলিত প্রথানুসারে ‘শিষ্ট সমাচারাৎ’ মারফত সিঁদুর দানের স্বীকৃতি দেন। অথচ তারও বহুপূর্ব থেকে ব্রাক্ষণ স্বীকৃতি ছাড়াই হিন্দুদের মাঝে সিঁদুর জনপ্রিয় ছিল।
নানা অভাব-অনটনের কারণে ধীরে ধীরে হারিয়ে যাচ্ছে ওরাওদের ধর্মকেন্দ্রিক আচারগুলো। ধর্মান্তরিত হওয়া ওরাওদের কাছে পূর্বপুরুষদের আমলের প্রথাগুলো আজ কেবলই কুসংস্কার। ফলে ধীরে ধীরে হারিয়ে যাচ্ছে উল্কি আঁকার রেওয়াজটিও। কিন্ত পূজা, উল্কি, সিঁদুরকেন্দ্রিক কাহিনগুলো কি হারাতে পারে কখনো? বরং তাদের কাহিনীগুলো যুগে যুগে সমৃদ্ধ করবে আদিবাসী সাহিত্যকে। একইভাবে কাহিনীগুলো বেঁচে থাকবে বিশ্ব সাহিত্যের মাঝে।
লিখাটি প্রকাশিত হয়েছে সাপ্তাহিকে ১২ আগষ্ট ২০১০
© 2011 – 2018, https:.