আদিবাসী

আদিবাসী রূপকথা ও বিচ্ছেদের কাহিনি

শ্রাবণের দুপুর। গরমে চারপাশ ত্রাহি ত্রাহি অবস্থা। পথিকেরা খানিক জিরিয়ে নিচ্ছে গাছের ছায়ায়। মৃদুমন্দ বাতাসের শীতল পরশে প্রাণ জুড়ানো অনুভূতি। কেউ কেউ চালাঘর থেকে বের হয়ে পথিক সেজে বসেছে বড় একটি বটের ছায়ায়। প্রচণ্ড গরম তার ওপর লাগামহীন লোডশেডিং। এই অবস্থায় ঘরে থাকাই যেন দায়।
গ্রামের লোকদের ধারণা, শুধু ভাদ্র মাসে এ রকম গরম পড়ে। সে গরমে নাকি তালও পাকে। ভাদ্রের তালপাকা আগাম গরম এখন শ্রাবণে। আর শ্রাবণ আকাশে কোনো মেঘের দেখা নেই। প্রকৃতির এ এক বেহিসেবি খেয়াল। এ নিয়ম চলছে কয়েক বছর ধরেই। সুনামি আর প্রকৃতি ধ্বংসের একধরনের প্রত্যুত্তর এটি। প্রচণ্ড গরমে গ্রাম্য জীবনযাত্রার নানা দৃশ্য দেখতে দেখতে চলে আসি ছায়াঘেরা একটি সবুজ গ্রামে।
গ্রামের নাম মহেশপুর। দিনাজপুরের অন্যান্য গ্রাম অপেক্ষা এখানে সবুজের আধিক্য বেশি। সবুজ বৃক্ষ এখানকার মানুষদের কাছে দেবতাতুল্য। তাই তা ধ্বংস করে সৃষ্টিকর্তার কৃপা লাভ থেকে এরা বঞ্চিত হতে চায় না। মূলত এটি একটি আদিবাসী গ্রাম। রাস্তার দুই দিকে মাটির দেয়ালে ছন বসানো ছোট্ট ছোট্ট ঘর। ঘরগুলোতে কোনো জানালা নেই। তবু প্রচণ্ড গরমে থাকে শীতল অনুভূতি। এই গ্রামে বিদ্যুৎ নেই। ফলে নেই কোনো লোডশেডিং। এদের নির্ভরতা শুধুই প্রকৃতির ওপর।
আদিবাসী এই গ্রামটিতে মূলত সাঁওতালদেরই বাস। এ গ্রামের প্রধান বাঠু সরেন। বাঠুর মতো অন্যান্য সাঁওতাল বিশ্বাস করে, প্রকৃতির ক্ষতি করলে প্রকৃতি তা নানাভাবে ফিরিয়ে দেয়। তাদের বিশ্বাস, আবহাওয়ার এমন আচরণ মানুষেরই কর্মফল। বাঠুর কথায় আমাদের মাঝে নীরবতা নামে। চোখের সামনে ভেসে ওঠে এ দেশের ভূমিদস্যু আর বনদস্যুদের মুখগুলো।
বাঠু আমাদের নিয়ে আসে গ্রামের ভেতরে ছোট্ট একটি ঘরে। এখানে চলছে আদিবাসী শিশুদের শিক্ষাদান। নিজের মাতৃভাষার পাশাপাশি বাংলা ভাষায় চলে পাঠদান। স্থানীয় এক এনজিওর সহযোগিতায় আদিবাসী শিশুদের পড়ানোর দায়িত্ব পালন করছেন এক সাঁওতাল যুবক। নাম সানজিলা হাজদা। সানজিলা শিশুদের শোনাচ্ছে আদিবাসীদের একটি রূপকথা। ভরাট কণ্ঠে নানা অঙ্গভঙ্গিতে। আমাদের দেখে গল্প বলায় খানিকটা ছন্দপতন ঘটে। তারপর আবারও শুরু করে রূপকথার গল্প। গল্পটির নাম গরুড় পাখি। সানজিলার মুখে শোনা গল্পটির ভাবার্থ অনেকটা এ রকম:

‘অনেক অনেক আগের কথা। এক গাঁয়ে বাস করত সাত ভাই। তারা খুব শিকারপ্রিয় ছিল। একদিন তারা দূরদেশের এক পাহাড়ে গেল শিকার করতে। সে পাহাড়ে ছিল বিরাট আকারের একটি হিংস্র পাখি। পাখিটির নাম ‘গরুড় পাখি’। পাখিটি শিকারিদের দেখেই ক্ষিপ্ত ও হিংস্র হয়ে উঠল। শিকারের আগেই সে সাত ভাইকে আক্রমণ করে একে একে মেরে ফেলল। ফলে কেউ আর সাত ভাইয়ের সন্ধান পেল না।
সাত ভাইয়ের মধ্যে সংসারী ছিল শুধু বড় ভাই। তার ছিল এক পুত্রসন্তান। দিনে দিনে সে বড় হয়ে উঠল। বড় হয়ে সে তার মাকে জিজ্ঞেস করল তার বাবা আর চাচাদের কথা। মা জানাল, তারা শিকারে গিয়ে আর ফিরে আসেনি। শুনেছে, বিরাট গরুড় পাখি তাদের আক্রমণ করেছিল। তারা বেঁচে আছে নাকি মরে গেছে, আজও কেউ জানে না।
এ কথা শুনেই ছেলেটি মনে মনে শপথ নিল। তার বাবা-চাচার হত্যাকারী হিংস্র পাখিটিকে যে করেই হোক হত্যা করতে হবে। ছেলেটি তখন তীর-ধনুক নিয়ে রওনা হলো দূরদেশের সেই পাহাড়ের দিকে। কয়েক দিন পথ চলতে চলতে সে চলে এল পাহাড়ের সেই স্থানে। যেখানে তার বাবা-চাচাদের হত্যা করা হয়েছিল। তাকে দেখেই হিংস্র গরুড় পাখিটি রাগে টগবগ করতে লাগল। ছেলেটি হঠাৎ দেখল, তার দিকে ধেয়ে আসছে বড় আকারের পাখিটি। সে তখনই তীর-ধনুক নিয়ে প্রস্তুত হয়ে নিল। পাখিটি কাছে আসতেই সে তার বুকে তীর বিদ্ধ করল। তীরের আঘাতে পাখিটি হুমড়ি খেয়ে পড়ে মারা গেল।পাখিটি মরে গেলে ছেলেটি সেখানে সাতটি নরকঙ্কাল দেখতে পেল। সেগুলো দেখেই সে বুঝে গেল, এগুলো তার বাবা আর চাচাদের কঙ্কাল। তা দেখে আবেগে সে কান্নায় ভেঙে পড়ল। তার কান্নায় সেখানে সন্ন্যাসীর বেশে চলে এল দেবতা মারাংবুরু। দেবতা ছেলেটিকে শান্ত করে সব কথা শুনল। অতঃপর ছেলেটির হাতে একটি জলভর্তি ঘটি আর কিছু নির্দেশনা দিয়েই সে চলে গেল। সন্ন্যাসী চলে গেলে ছেলেটি কঙ্কালগুলোকে কাপড়ে ঢেকে তাতে পানি ছিটিয়ে দিল। আর অমনি কঙ্কালগুলো জীবিত হয়ে মানুষের রূপ নিল। তারা সবাই আড়মোড়া দিয়ে বলল, ‘অনেকক্ষণ খুব খারাপ ঘুম ঘুমালাম।’ যুবক ছেলেটিকে দেখে তারা অবাক হলো। তার পরিচয় পেয়ে আর সব ঘটনা শুনে সবাই তো খুশিতে আত্মহারা। বাবা ও চাচাদের নিয়ে যুবক ছেলেটি তখন বীরের বেশে বাড়ি ফিরল। ভালোবাসা আর সাহসের কারণেই ছেলেটি ফিরে পেল তার বাবা আর চাচাদের।’

গল্প শেষ হতেই হাততালির শব্দ। রূপকথার গল্পে আদিবাসী যুবকের বীরত্ব আর তার প্রিয়জনের প্রতি ভালোবাসা শিশুদের মনে দাগ কাটে। এভাবেই আদিবাসী শিশুরা তাদের পূর্বপুরুষদের নানা কাহিনি জেনে নিজেকে তৈরি করা চেষ্টা করে একজন প্রকৃত আদিবাসী হিসেবে।
এরই মধ্যে বাঠু সরেনকে ডাকতে আসে কয়েকজন সাঁওতাল। গোত্রের প্রধান হওয়ায় প্রতিটি পরিবারের নানা প্রয়োজনে তাকে পাশে থাকতে হয়। বাঠুর সঙ্গে আমরাও চলে আসি গ্রামের ভেতরের এক বাড়িতে।
বাড়িটির উঠান ভর্তি লোক। বাঠুর সঙ্গে আলাপ চলে আরেক গ্রামের প্রধান সুশান্ত হেমব্রমের। সুশান্ত এসেছে তার গোত্রের পরিমল কিসকুর সঙ্গে। প্রায় দুই বছর আগে পরিমল বিয়ে করেছে মহেশপুর গ্রামের মুংলি টিগ্গাকে। প্রথমদিকে তাদের সংসার বেশ ভালোই চলছিল। কিন্তু বছর খানেক ধরে নানা কারণে তাদের স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্কে চিড় ধরে। স্ত্রী রাগ করে চলে এসেছে বাবার বাড়িতে। তাই পরিমল আজ এসেছে সম্পর্ক ছেদ করতে।
প্রথমে দুই পক্ষের গোত্রপ্রধান তাদের সম্পর্কটি ধরে রাখার বিষয়ে নানা আলোচনা করে। আলোচনায় কেউ সম্মত না হওয়ায় সিদ্ধান্ত হয় বিচ্ছেদের। বিচ্ছেদের জন্য উঠানের মধ্যে আয়োজন চলে একধরনের আচারের। উঠানের এক পাশে বসে আমরাও সাক্ষী থাকি বিবাহবিচ্ছেদের।
সাঁওতালদের বিবাহবিচ্ছেদের পদ্ধতি বেশ অন্য রকম। বিবাহবিচ্ছেদের দিন উভয় পক্ষের মহতদের উপস্থিত থাকতে হয়। তাদের সামনেই স্বামী-স্ত্রী প্রথমে কিছু শালপাতা টুকরো টুকরো করে ছিঁড়ে ফেলে। এতে প্রমাণিত হয় তারা তাদের দাম্পত্য জীবনকে শালপাতার মতো ছিন্নভিন্ন করে ফেলেছেন। অতঃপর স্ত্রী পানি ভর্তি একটি কলস উপুড় করে বলে, স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্ক পানির মতো শেষ হলো। আমাদের সামনেই এ পদ্ধতিতেই বিবাহবিচ্ছেদ ঘটল পরিমল আর মুংলির। কোনো কোনো অঞ্চলের সাঁওতালদের বিবাহবিচ্ছেদের আচারটি খানিকটা ভিন্ন। বিবাহবিচ্ছেদের সময় স্বামী স্ত্রীর মাথার সিঁদুর মুছে দেয় এবং হাত থেকে লোহার রয়লা খুলে নেয়। এভাবে বিবাহবিচ্ছেদ ঘটে ওরাঁও সম্প্রদায়ের আদিবাসী সমাজেও।
সাঁওতালদের বিবাহবিচ্ছেদ দেখে মনে পড়ে যায় কর্মকার সম্প্রদায়ের আদিবাসীদের কথা। একবার রাণীপুরের কর্মকারপাড়ায় ঘটেছিল বিচ্ছেদের সেই আচারটি। কর্মকাররা বিবাহবিচ্ছেদের পর্বটিকে বলে ‘ছাডিদেওয়া’। তাদের সম্প্রদায়ে স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে সম্পকের্র অবনতি হলে উভয় পক্ষের গোত্রপ্রধান বা সিকদার আলোচনায় বসে সমাধানের চেষ্টা করে। সমাধান না হলে এরা বিচ্ছেদ পর্বের আয়োজন করে। স্বামী কিংবা স্ত্রী যে কারোর বাড়িতেই বিচ্ছেদ পর্বটি হতে পারে। এ পর্বে দুই পক্ষের আত্মীয়স্বজনের সামনে স্বামী-স্ত্রীকে দাঁড় করানো হয়। তাদের সামনে দেওয়া হয় একটি কাঁসার ঘটি। ঘটিতে থাকে পানি। পানিতে পাতাসহ একটি ছোট আমের ডাল ও তিনটি পান ডুবিয়ে রাখা হয়। ঘটির পাশে রাখা হয় তিনটি সুপারি। স্বামী-স্ত্রী ঘটির পানিতে হাত রাখতেই উভয় পক্ষের সিকদার তাদের আবার প্রশ্ন করে, তারা বিবাহবিচ্ছেদে সম্মত কি না। উভয়েই হ্যাঁ-সূচক জবাব দিতেই ঘটির পানি তাদের দুজনের গায়ে ছিটিয়ে দেওয়া হয়। পানি ছিটানোর পরপরই তাদের বিবাহবিচ্ছেদ ঘটে।
তবে আদিবাসী সমাজে লিখিত রীতিতে বিয়ে না হলেও খুব সহজে এদের বিবাহবিচ্ছেদ ঘটে না। যেসব কারণে আদিবাসীদের বিবাহবিচ্ছেদ ঘটে তার মধ্যে বন্ধ্যাত্ব, ঘন ঘন সন্তানের মৃত্যু, যৌন কর্মে অপারগতা, সম্পত্তির বিনষ্ট সাধন, অযাচিত ঋণকরণ, কলহ-ঝগড়া প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য। এ দেশের আদিবাসী সমাজে বিবাহবিচ্ছেদের প্রচলন থাকলেও বিশ্বের অনেক দেশের আদিবাসী সম্প্রদায়ের মধ্যে এ প্রথা চালু নেই। বিভিন্ন নৃবিজ্ঞানীর গবেষণা থেকে জানা যায়, শ্রীলঙ্কার ভেদ্দা, কঙ্গোর বাহোয়ানা, ব্রাজিলের মাত্তো গ্রোসো, ইন্দো-চীনের লিসু প্রভৃতি আদিবাসীদের মাঝে কোনো বিবাহবিচ্ছেদ ঘটে না। তারা মনেপ্রাণে বিশ্বাস করে, একমাত্র মৃত্যুই স্বামী-স্ত্রীকে বিচ্ছিন্ন করতে পারে, নয়তো নয়।

বিচ্ছেদের পরই পরিমল তার আত্মীয়স্বজনকে নিয়ে রওনা হয় নিজ গ্রামের দিকে। মুংলিদের বাড়ির ভিড়ও কমতে থাকে। মুংলি ব্যস্ত হয় সংসারের নানা কাজে। হঠাৎ আমাদের চোখ পড়ে মুংলির চোখে। পরিমলের সংসারের স্মৃতিগুলো যেন অশ্র“ হয়ে ঝরে পড়ে মুংলির চোখ বেয়ে। মনে মনে ভাবি, হয়তো এভাবেই আদিবাসী আর বাঙালি নারীদের দুঃখগুলো একই সুতায় বাঁধা পড়ে।

লিখাটি প্রকাশিত হয়েছে সাপ্তাহিক কাগজে  ১১ সেপ্টেম্বর ২০১১

© 2011 – 2018, https:.

এই ওয়েবসাইটটি কপিরাইট আইনে নিবন্ধিত। নিবন্ধন নং: 14864-copr । সাইটটিতে প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো তথ্য, সংবাদ, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করলে আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।

Show More

Salek Khokon

সালেক খোকনের জন্ম ঢাকায়। পৈতৃক ভিটে ঢাকার বাড্ডা থানাধীন বড় বেরাইদে। কিন্তু তাঁর শৈশব ও কৈশোর কেটেছে ঢাকার কাফরুলে। ঢাকা শহরেই বেড়ে ওঠা, শিক্ষা ও কর্মজীবন। ম্যানেজমেন্টে স্নাতকোত্তর। ছোটবেলা থেকেই ঝোঁক সংস্কৃতির প্রতি। নানা সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠনের সঙ্গে জড়িত। যুক্ত ছিলেন বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র ও থিয়েটারের সঙ্গেও। তাঁর রচিত ‘যুদ্ধদিনের গদ্য ও প্রামাণ্য’ গ্রন্থটি ২০১৫ সালে মুক্তিযুদ্ধ ভিত্তিক মৌলিক গবেষণা গ্রন্থ হিসেবে ‘কালি ও কলম’পুরস্কার লাভ করে। মুক্তিযুদ্ধ, আদিবাসী ও ভ্রমণবিষয়ক লেখায় আগ্রহ বেশি। নিয়মিত লিখছেন দেশের প্রথম সারির দৈনিক, সাপ্তাহিক, ব্লগ এবং অনলাইন পত্রিকায়। লেখার পাশাপাশি আলোকচিত্রে নানা ঘটনা তুলে আনতে ‘পাঠশালা’ ও ‘কাউন্টার ফটো’ থেকে সমাপ্ত করেছেন ফটোগ্রাফির বিশেষ কোর্স। স্বপ্ন দেখেন মুক্তিযুদ্ধ, আদিবাসী এবং দেশের কৃষ্টি নিয়ে ভিন্ন ধরনের তথ্য ও গবেষণামূলক কাজ করার। সহধর্মিণী তানিয়া আক্তার মিমি এবং দুই মেয়ে পৃথা প্রণোদনা ও আদিবা।

7 Comments

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

Back to top button