উৎসবগুলো আদিবাসীদের
উৎসববিহীন কোনো আদিবাসী সম্প্রদায়ের খোঁজ মেলেনি এখনও। আদিবাসীদের জীবন ও সংস্কৃতির সঙ্গে মিশে আছে নানা ধরনের উৎসব। অধিকাংশ উৎসবই তাদের সনাতন ধর্ম বিশ্বাসকে ঘিরে। এই উৎসবগুলোর পেছনে লুকিয়ে আছে এক একটি ঘটনা। এক একটি মিথ। যুগ যুগ ধরে এই উৎসব আর মিথগুলোই তাদের ধর্ম বিশ্বাসকে আরো সুদৃঢ় করেছে। ঋতু ভেদেও আদিবাসীরা পালন করে নানা ধরনের উৎসব ও অনুষ্ঠান। ফলে আদি উৎসবগুলো আদিবাসী সংস্কৃতিকে করে তুলছে সমৃদ্ধময়।
এদেশে আদিবাসীরা অধিকাংশই হতদরিদ্র। এছাড়া নানা বিষয়ে অবহেলা আর বঞ্চনার কষাঘাত তো রয়েছেই। তবুও এই উৎসবগুলোতে তাদের প্রাণছোঁয়া আনন্দ সত্যি অনুকরণীয়। ধার করে আনা কোনো গান বা নৃত্য নয়। পূর্বপুরুষদের মুখে মুখে শোনা গান। মাদলের তালে তালে নৃত্য। একক গান কিংবা নাচ নয়। সবই দলীয়। হিংসা-বিদ্বেষের বিভেদ ভুলে হাত ধরাধরি করে নাচে আদিবাসীরা।
একবার দিনাজপুরের কড়াপাড়ায় গিয়েছিলাম কারমা পূজার উৎসবে। এদেশে টিকে থাকা এই সম্প্রদায়টির একমাত্র পাড়া এটি। মাটি আর ছনে ঢাকা ছোট ছোট ঘর। উঠানে আয়োজন চলছে পূজার। গোত্রের মাহাতো বা প্রধান সবাইকে নিয়ে অপেক্ষা করছে বাড়ির উঠানে।
কড়াদের সবচেয়ে বড় উৎসব কারমা পূজা। ভাদ্র মাসের পূর্ণিমা চাঁদে আয়োজন চলে এই পূজাটির। মূলত এটি গাছের পূজা। বিশেষ প্রজাতির ‘খিলকদম’ গাছের ডাল কেটে এনে পূজা করে এরা। বিকেলের দিকে তাই জগেনের সঙ্গে সবাই ডালের জন্যই অপেক্ষা করছিল।
কারমা পূজায় খিলকদম গাছের ডাল কাটারও বিশেষ নিয়ম আছে। কড়াদের রীতিতে ডাল কাটা ও তা বিসর্জন দেয়ার যোগ্যতা রাখে শুধুই গোত্রের অবিবাহিত যুবকরা। সে কারণে গোত্রের মাহাতো পূর্ব থেকেই যুবক নির্বাচন করে রাখেন। নিয়ম মেনে সেই যুবকটি প্রথমে স্নান সেরে পবিত্র হয়ে নেয়। অতঃপর কয়েকজনকে সঙ্গে নিয়ে বেরিয়ে পড়ে খিলকদম গাছের খোঁজে।
গাছের কাছে গিয়েও পালন করতে হয় বিশেষ ধরনের আচার। গাছের গোড়ায় ধূপ জ্বালিয়ে, গাছের গুঁড়িতে সিঁদুর ফোঁটা দিয়ে ঝুলিয়ে দেয়া হয় ৩টি তেলের পিঠা। অতঃপর দা দিয়ে ৩ চটে (৩ কোপে) কাটতে হয় গাছটির ডাল। কাটা ডালটিকে আবার মাটিতে ফেলার নিয়ম নেই। মাটি স্পর্শ করার আগেই এটিকে নিয়ে নেয়া হয় ঘাড়ে। এভাবেই ডালটিকে আনা হয় পূজাস্থলে। সেখানে গোত্রের সবাই ঢাক-ঢোল বাজিয়ে ডালটিকে বরণ করে উঠোনের মাটিতে গেড়ে দেয়।
কারমা পূজায় কড়াদের ধর্মের পরীক্ষা দিতে হয়। পাঁচদিন পূর্বে বাঁশের টুকরির মধ্যে কালাই বীজ রেখে বালু দিয়ে ঢেকে দেয় এরা। সেদিন থেকেই শুরু হয় উপোস (উপাস) থাকা। উপোস সময়ে রসুন, পেঁয়াজ, গরম ভাত, মাছ ও মাংস খাওয়ার নিয়ম নেই। খেতে হয় শুধুই নিরামিষ। যে কয়জন উপোস থাকে সে কয়টি ছোট কাঠি ডালায় পুঁতে দেয়া হয়। কড়াদের রীতি অনুসারে উপোসকারী পুরুষ হলে কাঠির মাথায় কাজল আর মহিলা হলে সিঁদুর লাগানো হয়। চারদিন পর ডালায় নতুন চারা গজালে এরা উপোস ভাঙ্গে। কড়াদের বিশ্বাস যাদের ধর্মে বিশ্বাস নেই ডালায় তাদের লাগানো কালাই বীজ থেকে চারা গজায় না। চারা গজানোর পর পূজার দিন খিলকদম গাছের ডালের পাশেই রাখা হয় চারার ডালাটিও।
কারমা পূজার শুরুতে ডালের সামনেই কড়ারা একই সঙ্গে দুটি লাল মুরগা (মোরগ) বলি দেয়। সৃষ্টিকর্তার কৃপা লাভই বলির উদ্দেশ্য। এর মাধ্যমেই শুরু হয় কারমা পূজার আনুষ্ঠানিকতা। সারা রাত কড়ারা ডালটির চারপাশে নেচে গেয়ে আনন্দ করে। রাতভর চলে প্রিয় পানীয় হাঁড়িয়া খাওয়া।
ভোর হতেই স্নান সেরে নেয় গোত্রের মাহাতো। নিয়মমতে ভেজা শরীরেই প্রথমে সে এক বাটি দুধ ঢেলে দেয় খিলকদম গাছের ডালের মাথায়। অতঃপর তাকে ভক্তি দিয়ে ফিরে যায় নিজ বাড়িতে। মাহাতোর পরেই অন্যরা পৃথকভাবে একে একে দুধ ঢেলে ভক্তি দেয়। ভক্তি শেষে যে যুবকটি ডাল কেটেছিল সে ডালটির চারদিকে ৩ পাক ঘুরে ডালটিকে টান দিয়ে কাঁধে তুলে নেয়। অন্যরাও তখন তুমুল শব্দে মাদল আর ঢোল বাজাতে থাকে। বাজনার তালে তালে যুবকটি খিলকদম গাছের ডালটিকে বিসর্জন দেয় নিকটবর্তী নদী বা পুকুরে। আর বিসর্জনের মধ্য দিয়েই শেষ হয় কড়াদের কারমা পূজা।
আচারগত কিছুটা ভিন্নতা থাকলেও একইভাবে কারমা পূজা পালন করে ওঁরাও, মুন্ডা, মাহালীসহ অন্যান্য সম্প্রদায়ের আদিবাসীরা। এই পূজাকে অনেক সম্প্রদায়ের আদিবাসীরা করম বা কারাম উৎসবও বলে থাকে। ভাদ্র মাসের অভাবের সময়েই কড়ারা কারমা পূজার উৎসব পালন করে। তাদের বিশ্বাস এটি তাদের অভাবমুক্তি ও সৌভাগ্য লাভের পূজা।
গবাদিপশু ও চাষাবাদের যন্ত্রপাতির প্রতি কৃতজ্ঞতা জানাতে পূজার মাধ্যমে এক ধরনের উৎসব পালন করে আদিবাসীরা। দিনাজপুরের বহবলদিঘীর ওঁরাও গ্রামে দেখেছিলাম ওঁরাওদের তেমনি একটি উৎসব। উৎসবটির নাম ‘সাহরাই’ উৎসব। এই উৎসব চলে তিনদিন। প্রতিবছর আশ্বিনের চাঁদের অমাবস্যার পরেরদিন চলে পূজার আনুষ্ঠানিকতা। বাড়ি বাড়ি আলাদাভাবে করতে হয় ‘সাহরাই পূজা’।
সাহরাই উৎসবের প্রথমদিনে আদিবাসীরা ঘরে, উঠানে, জমিতে, গোবর ফেলার জায়গাসহ বিভিন্ন স্থানে প্রদীপ জ্বালিয়ে রাখে। দ্বিতীয়দিন গরু, মহিষ, ছাগল প্রভৃতিকে স্নান করিয়ে তেল ও সিঁদুর মাখানো হয়। লাঙ্গল, জোঁয়ালসহ চাষাবাদের সকল যন্ত্রপাতি পরিষ্কার করে মাখানো হয় সিঁদুরের রঙে।
পূজার দিন নিয়ম অনুসারে গোয়ালঘরে চলে এই পূজা। পূজার আগেই গোয়ালঘর মাটি দিয়ে লেপে পরিষ্কার করা হয়। শালবন থেকে আনা উলুর ঢিবির মাটি এনে তিনভাগে উঁচু করে দেয়া হয় মেঝেতে। একই সঙ্গে সেখানে সিঁদুর, বেলপাতা, কলাপাতা, দুর্বাঘাস, আতপ চাল, জবাফুল ও ধূপ জ্বালিয়ে মুরগি বলি দিয়ে পূজা করে ওঁরাওরা। পূজা শেষে প্রথমেই গরু-ছাগলকে খাওয়ানো হয় লবণ ও হলুদ ছাড়া কালাই। অতঃপর নিয়ম অনুসারে বাড়ির সবাইকে গোয়ালঘরে বসেই সেরে নিতে হয় খাওয়া-দাওয়া। সন্ধ্যা ঘনিয়ে এলেই প্রদীপ জ্বালানো হয় গোয়ালঘরসহ বাড়ির বিভিন্ন স্থানে। সাহরাই উৎসবের রাতে ওঁরাও গ্রামগুলো থাকে আলোকোজ্জ্বল। রাতভর চলে হাঁড়িয়ার সঙ্গে ঝুমের নাচের আসর।
অন্যান্য সম্প্রদায়ের মতো গারোদের জীবনও বেশ উৎসবময়। এরা কৃষি ও জুম চাষকে কেন্দ্র করেই পালন করে নানা উৎসব। গারোদের সর্বাপেক্ষা বৃহৎ উৎসবের নাম ওয়ানগালা। এটি কার্তিক-অগ্রহায়ণে অনুষ্ঠিত হয়। মূলত সৃষ্টিকর্তাকে ধন্যবাদ জানানো হয় এ উৎসবের মাধ্যমে।
হালুয়াঘাটের গারোরা ওয়ানগালার সময় ঝোপঝাড় কেটে তাদের বাড়িসহ গোটা গ্রামটি পরিষ্কার করে নেয়। গ্রামপ্রধানকে গারোরা বলে নকমা। নকমা সকলকে ওয়ানগালার জন্য প্রস্ততি নেয়ার ঘোষণা দেন। ঘোষণার পরই গোটা গ্রামে চালের গুঁড়ো দিয়ে বিশেষ ধরনের মদ তৈরির ধুম পড়ে যায়। উৎসবে যে যত বেশি মদ আনতে পারে তার তত সুনাম হয়। এই উৎসবে প্রতিটি পরিবার জুম থেকে প্রাপ্ত ফসলের কিছু অংশ বাড়ির সামনে কলা পাতায় সাজিয়ে রাখে। সঙ্গে রাখে দ্বিখ-িত চালকুমড়া। এই উৎসব সাধারণত তিনদিন ধরে চলে। প্রথম দুদিনকে বলে ‘চু-রুগালা’ ও ‘গাখাততা’। প্রথম দিনটি নাচগান আর মদপানের পর্ব। গারো মেয়েরা দকমান্দা পরে, মাথায় পাখির পালক গুঁজে দলবেঁধে নাচে। আর পুরুষরা তাল তুলে বাদ্য বাজায়। এদিন গারোরা গরু বা শূকর মেরে কিছু মাংস নিজেদের জন্য রেখে বাকিটা গ্রামের লোকদের বিলিয়ে দেয়। নাচগানের দলটি মদপান করে নাচতে থাকে। এভাবে বাড়ি বাড়ি গিয়ে নেচেগেয়ে তারা এসে থামে গ্রামপ্রধানের বাড়িতে। গ্রামপ্রধানের বাড়িতেই সর্বশেষ খাওয়া-দাওয়া চলে। ওয়ানগালা উৎসবের মাধ্যমেই যুবক-যুবতীর মনে ভালোবাসার রঙ লাগে।
গারোদের মতো মুন্ডা পাহান সম্প্রদায়ের আদিবাসীরা বছরের প্রথম ফসল ঘরে তোলার সময় আয়োজন করে এক ধরনের অনুষ্ঠানের। বাঙালিদের কাছে এটি নবান্ন উৎসব হলেও মুন্ডাসহ অন্য আদিবাসীদের কাছে এটি ‘লবান’।
লবানের দিন বাড়ির পুরুষ উপোস অবস্থায় একটি থালা নিয়ে চলে আসে ধানক্ষেতের পাশে। থালায় থাকে সিঁদুর, পানসুপারি, কলা, ধূপ আর প্রদীপ। অতঃপর ক্ষেতের পাশে একটি জায়গা লেপে পরিষ্কার করা হয়। সেই জায়গায় কলা, পানসুপারি, প্রদীপ, ধূপ, সিঁদুর রেখে পানি ছিটিয়ে ভক্তি করা হয়। ভক্তির পর প্রদীপটি নিয়ে ওই ব্যক্তি ধানক্ষেতে নেমে ৩টি ধানের আগাল (আগা) একত্রে মুঠো করে এর ওপর জ্বালানো প্রদীপটি রেখে প্রথম ধান কাটে। অতঃপর প্রদীপটি জমির পাশেই রেখে দেয়া হয়। ওই ধান কেটে বাড়িতে এনে চাল তৈরি করে রান্না করে উপোস ভাঙ্গে মুন্ডারা। একই সঙ্গে চলে হাঁড়িয়া খাওয়া। এর পরও সুবিধা মতো সময়ে গোত্রের সবাই শূকর বা খাসি জবাই করে সম্মিলিতভাবে আবার পালন করে লবান উৎসবটিকে।
এভাবে সারা বছরই নানা উৎসব চলে আদিবাসী পাড়াগুলোতে। নাচ, গান আর আদি বিশ্বাসের আদি রীতিগুলো টিকে থাকে প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে। দরিদ্রতা, বৈষম্য আর নানা অবহেলায় থাকা আদিবাসীদের কষ্টগুলো ভেসে যায় উৎসবের বাঁধভাঙা আনন্দের স্রোতে।
লিখাটি প্রকাশিত হয়েছে সাপ্তাহিকে ৮ সেপ্টেম্বর ২০১১
© 2011 – 2018, https:.
Thanks.
Ekhane ekta comment korechilam, hariye geche… !!