রাজনটী
সোয়া দুইশত বছর আগের ত্রিপুরার রাজসভার এক বাইজিকে নিয়ে রচিত রাজনটী। লোকপুরাণ মতে, তার নাম নূরজাহান হলেও লেখক তার নাম দিয়েছেন গুলনাহার। মধ্য বয়সে গুলনাহার তার নিজ গ্রামে ফিরে একটি মসজিদ নির্মাণ করেন। কিন্ত মানুষ যখন জানল সে বাইজি, তখন কেউ মসজিদটিতে নামাজ পড়ল না – এই হচ্ছে উপন্যাসটির মূল কাহিনি। ১৭৭৪ এর ভয়াবহ মন্বন্তরের কালে গুলনাহারকে এক গোয়ালার কাছে বিক্রি করে দিয়েছিলে তার মা । সাবালিকা হওয়ার পর গোয়ালা তাকে বিক্রি করে দেয় সাবেরি নামক এক বাইজির কাছে। তার কাছে নাচ-গান রপ্ত করে ত্রিপুরার মহারাজ দ্বিতীয় রাজধর মানিক্যের রাজসভার রাজবাইজির পদাধিকারী হলো গুলনাহার। বহু বছর রাজবাইজি বা রাজনটী হিসেবে থেকে মহারাজের চিত্ত মনোরঞ্জনের পর একদিন তার ভাই কর্তৃক লাজ্ছিত ও মহারাজ কর্তৃক ভতসনার শিকার হয়ে গুলনাহার নীরবে কোঠা ত্যাগ করে চলে আসে নিজ গ্রাম হরিদশ্বে। মাহারাজ পরে নিজের ভুল বুঝতে পেরে গুলনাহারের জন্য বহু ধনরত্ন ও নগদ টাকা পাঠিয়ে দেয়। গুলনাহার অতীত জীবনের পাপের প্রায়শ্চিত্তের জন্য নিজ গ্রামে একটি মসজিদ নির্মাণ করে। গ্রামবাসী তখনো জানত না, গুলনাহার এক বাইজি। কিন্ত মসজিদের কাজ যখন পুরোপুরি শেষ হলো, তখন বিষয়টি আর তাদের কাছে গোপন থাকল না। ফলে কেউ আর বাইজি কর্তৃক নির্মিত মসজিদে নামাজ পড়ল না। সবার কাছে লাঞ্ছিত অপমানিত হয়ে গুলনাহার আবার ফিরে যায় তার পুরোন বাইজি পেশায়।
ইতিহাস, লোকপুরাণ আর কল্পনার ধার ঘেঁষে চলে যাওয়া উপন্যাস রাজনটী। কল্পনা বাদ দিয়ে হুবহু কোনো ঘটনার বিবরণ দেয়া ঐতিহাসিকের কাজ, ঔপন্যাসিকের নয়। কাহিনীতে প্রাচীনত্বের আমেজ আনার স্বার্থে কিছু স্থানের প্রাচীন নাম ও ছদ্মনাম ব্যবহার করা হয়েছে। যেমন ত্রিপুরা রাজ্যকে ‘জাজিনগর’ বলা হয়েছে। উল্লেখ্য, একদা ত্রিপুরার নাম জাজিনগর ছিল বটে। ভারতের প্রাচীন লেখকগণ এ রাজ্যকে ‘জাজনগর’ বা ‘জাজিনগর’ বলে বর্ণনা করেছিলেন। ঐতিহাসিক স্টুয়ার্ড রচিত বাংলার ইতিহাস গ্রন্থে আছে, ‘১২৭৯ খ্রিস্টাব্দে লক্ষ্মণাবতীর নবাব তুগ্রল খাঁ অনেক সৈন্য-সামন্ত নিয়ে জাজিনগর আক্রমণ করেন। তিনি সেখানকার রাজাকে পরাভূত করে সেই রাজ্যে লুণ্ঠন চালান এবং সেখান থেকে প্রভূত সম্পদ ও এক শত হাতি নিয়ে চলে যান।’ (রাজমালা ও আধুনিক ত্রিপুরা : শ্রীপুরঞ্জনপ্রসাদ চক্রবর্তী)। এই জাজিনগরই হচ্ছে বর্তমান ত্রিপুরা।
অপরদিকে, ত্রিপুরার প্রাচীন রাজধানী উদয়পুরকে ‘জয়গুনপুর’, তৎপরবর্তী রাজধানী আগরতলাকে ‘উদয়াচল’ ছদ্মনামে চিহ্নিত করা হয়েছে। একইভাবে উপন্যাসের কেন্দ্রীয় পটভূমি মাঝিগাছা গ্রামকে ‘হরিদশ্ব’ ছদ্মনাম রাখা হয়েছে। রঙসোনাপুর স¤পূর্ণতই কথকের কল্পনাপ্রসূত এক নগর। আর সুধাবতী যে গোমতীরই কল্পিত নাম¯পাঠক নিশ্চয়ই তা আন্দাজ করতে পেরেছেন। কমলাঙ্ক কুমিল্লারই আদি নাম। চৈনিক পরিব্রাজক ওয়াং চোয়াং সমতট রাজ্য পরিভ্রমণ বৃত্তান্তে কিয়া-মল-ঙ্কিয়া নামক যে জনপদের বর্ণনা দিয়েছেন সেটাই কমলাঙ্ক, যা বর্তমানের কুমিল্লা। আর নটীর মসজিদের প্রতিষ্ঠাতা যে নূরজাহান, তা এ জনপদের সবারই জানা কথা। সচেতনভাবে এ নামটি পরিহার করে উপন্যাসের কেন্দ্রীয় চরিত্রের নাম রাখা হয়েছে গুলনাহার।
রাজনটী
লেখক : স্বকৃত নোমান
। saqritobd@gmail.com
। ০১৮১৮ ২৩৮৩২০
প্রকাশক : ইত্যাদি গ্রন্থ প্রকাশ
। ৩৮/৩ বাংলা বাজার, ঢাকা – ১১০০
। ittadisutrapat@yahoo.com
। ৭১২৪৭৬০, ০১৭১৫ ৪২৮২১০, ০১৭১২ ২৩৫৩৪২
প্রকাশকাল : ফেব্রুয়ারি ২০১১
প্রচ্ছদ : নিয়াজ চোধুরী তুলি
পৃষ্ঠা : ১৭৫
মূল্য : ২০০ টাকালেখক পরিচিতি
স্বকৃত নোমান ১৯৮০ খৃস্টাব্দের ৮ নবেম্বর জন্মগ্রহণ করেন। বাংলাদেশের দক্ষিণ পূর্বাঞ্চলের সাগর-নদী আর পর্বতময় ব্যাপ্ত ভূখন্ডে কেটেছে তার জীবনের পঁচিশ বছর। মুহুরী, কহুয়া, সিলোনিয়া, ছোটফেনী নদীর কূলে কূলে আর বঙ্গোপ সাগরের আদিগন্ত প্রসারিত চরে হাঁটতে হাঁটতে এই জনপদের আদিবাসী, বাঙালি, মুসলমান, বৌদ্ধ, হিন্দু―বিভিন্ন জাতি-গোষ্ঠীভূক্ত মানুষের সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্য দেখতে দেখতে নিজেকে করে তুলেছেন যশস্বী, তার অভিজ্ঞতার ভান্ডার লাভ করেছে বিপুল বিস্তার। বর্তমানে তিনি ঢাকায় দেশের প্রতিষ্ঠিত একটি সংবাদ ম্যাগাজিনে সাংবাদিকতার সঙ্গে যুক্ত। পাশাপাশি নিবিষ্ট পাঠক ও প্রতিশ্রুতিশীল লেখক। এ প্রজন্মের কথাসাহিত্যিকদের মধ্যে স্বকৃত নোমানের অবস্থান এখন পরিষ্কার। নিয়ত অনুসন্ধিৎসু এ তরুণ কোনো তত্ত্বে বিশ্বাসী নন। ধর্মতত্ত্ব সঠিকভাবে জেনে তারপর সচেতনভাবে নিজেকে এর কাছ থেকে দূরে সরিয়ে নিয়েছেন, পাশাপাশি উগ্র নাস্তিকতা থেকেও সমান দূরত্ব বজায় রাখেন। চিরন্তন সত্য বলে পৃথিবীতে কিছু নেই―এই তার আপাত প্রস্তাব।
প্রকাশিত উপন্যাস : নাভি (২০০৮), ধুপকুশী (২০০৯), জলেস্বর (২০১০)। প্রবন্ধ : প্রাচ্যের ভাব আন্দোলনের গতিধারা (২০০৯), খ্যাতিমানদের শৈশব (২০১০)। তিনটি উপন্যাস লেখার অভিজ্ঞতা নিয়ে রাজনটীতে এসে তিনি অনেক বেশি পরিণত। নির্মাণ করেছেন অভিনব আঙ্গিক আর অনবদ্য ভাষা।
© 2011 – 2018, https:.