আদিবাসীদের তন্ত্রমন্ত্র খেলা
তুমরি ও পাতা খেলার খবরটি পাই এমএ কুদ্দুসের কাছ থেকে। দিনাজপুরের স্থানীয় পত্রিকার সাংবাদিক তিনি। একই সঙ্গে তিনি ‘হামেরা দিনাজপুরিয়া’ সংগঠনের প্রধান উদ্যোক্তা। দরিদ্রতার কারণে আদিবাসীরা যেসব অনুষ্ঠান আয়োজন করতে পারে না, যেসব প্রাচীন খেলা হারিয়ে যাচ্ছে গ্রামবাংলা থেকে, গ্রামীণ সমাজের সে সব অনুষ্ঠান ঘটা করে আয়োজন করে এ সংগঠনটি। সে হিসেবে এ বছর ১৯ আগস্ট শুক্রবার বিকেলে লোহাডাঙ্গার বিষ্ণুপুর গ্রামে অনুষ্ঠিত হয় তুমরি ও পাতা খেলা দুটি। লোহাডাঙ্গায় মূলত আদিবাসী তুরি সম্প্রদায়ের বাস। তুরিরা তাদের নামের শেষে টাইটেল হিসেবে পুরুষদের ক্ষেত্রে শিং আর মেয়েদের ক্ষেত্রে বালা শব্দটি ব্যবহার করে। যুগ যুগ ধরে এখানে এই তুরিরাই আয়োজন করে আসছে তুমরি ও পাতা খেলার। দিনে দিনে বদলে যায় তুরিদের অবস্থা। দরিদ্রতা বাসা বাঁধে তাদের গ্রামে। ফলে প্রায় বন্ধ হয়ে যাচ্ছিল তুমরি ও পাতা খেলার আয়োজনটি। খেলার আয়োজনে তাদের পাশে এসে দাঁড়ায় হামরা দিনাজপুরিয়া সংগঠনটি।
বিভিন্ন তথ্য থেকে জানা যায়, আবহমান গ্রামবাংলার সংস্কৃতির সঙ্গে মিশে থাকা প্রাচীন ও বিলুপ্তপ্রায় খেলাগুলোর মধ্যে তুমরি ও পাতা খেলা অন্যতম। মনসা দেবীর অলৌকিক লীলা থেকেই কালের বিবর্তনে এই খেলা দুটির উৎপত্তি।
মনসা মূলত আদিবাসী দেবতা। এক সময় শুধু নিম্নবর্ণীয় হিন্দুদের মধ্যে তাঁর পূজা প্রচলিত ছিল। পরবর্তীতে উচ্চবর্ণীয় হিন্দুসমাজেও মনসাপূজা প্রচলন লাভ করে। বর্তমানে মনসা আর আদিবাসী দেবতা নন, বরং হিন্দু দেবীতে রূপান্তরিত হয়েছেন। খ্রিষ্টীয় চতুর্দশ শতাব্দী নাগাদ মনসাকে শিবের কন্যারূপে কল্পনা করে তাঁকে শৈবধর্মে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। এই সময় থেকেই প্রজনন ও বিবাহরীতির দেবী হিসেবেও মনসা স্বীকৃতি লাভ করে।
মনসা সনাতন হিন্দু ধর্মানুসারীদের কাছে পদ্মাদেবী। আদিবাসীদের কাছে বিষহরি। কিংবদন্তি আছে শিব বিষপান করলে মনসা তাঁকে রক্ষা করেন। সেই থেকে তিনি বিষহরি।
মনসার পূজকরা শৈবধর্মের প্রতিদ্বন্দ্বিতাতেও অবতীর্ণ হন। শিবের কন্যারূপে মনসার জন্মকাহিনী এরই ফলশ্রুতি। এর পর থেকেই হিন্দুধর্মের ব্রাহ্মণ্যবাদী মূলধারায় মনসা দেবীরূপে স্বীকৃতি লাভ করে।
মনসার জন্মকাহিনী প্রথম উল্লিখিত হয় পুরাণগ্রন্থে। মঙ্গলকাব্যে তাঁকে শিবের কন্যা বলা হলেও, পুরাণ অনুসারে তিনি ঋষি কশ্যপের কন্যা। একদা সর্প ও সরীসৃপগণ পৃথিবীতে কলহ শুরু করলে কশ্যপ তাঁর মন থেকে মনসার জন্ম দেন। ব্রহ্মা তাঁকে সর্প ও সরীসৃপদের দেবী করে দেন। মনসা মন্ত্রবলে বিশ্বের উপর নিজ কর্তৃত্ব স্থাপন করেন। এরপর মনসা শিবের সঙ্গে সন্ধিস্থাপন করেন। শিব তাঁকে কৃষ্ণ আরাধনার উপদেশ দেন। মনসা কৃষ্ণের আরাধনা করলে কৃষ্ণ তুষ্ট হয়ে তাঁকে সিদ্ধি প্রদান করেন এবং প্রথামতে তাঁর পূজা করে মর্ত্যলোকে তাঁর দেবীত্ব প্রতিষ্ঠা করেন।
প্রতি শ্রাবণ-ভাদ্র মাসের তিথি সংক্রান্তিতে আদিবাসী ও সনাতন হিন্দু ধর্মানুসারীরা পদ্মাদেবীর তুষ্টিতে মনসাপূজা করে থাকে। নিয়মানুসারে এ পূজার পরেরদিন থেকেই দেশের বিভিন্ন স্থানে আয়োজন করা হয় মন্ত্রবাণের তুমরি ও পাতা খেলার। প্রাচীন এই খেলা দেখতে আগ্রহী হই আমরা।
রমজান মাস। তবুও খেলা দেখতে মানুষের উপচেপড়া ভিড়। নানা সাজপোশাকে নানা ঢঙের মানুষ। ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সবাই এসেছে খেলা দেখতে। তুমরির টানে ইউএনওসহ এসেছেন সমাজের কর্তাব্যক্তিরাও। বড় একটি মাঠের মধ্যে চলছে খেলাটি। মাঠের চারপাশে বৃত্তাকারে দাঁড়ানো শত শত লোক। মধ্যখানে একটি কলাগাছ। মাটিতে পুঁতে রাখা হয়েছে গাছটিকে। কলাগাছের গোড়ায় পানিভর্তি একটি মাটির ঘটি। তার চারপাশ চুন দিয়ে বৃত্তাকারে ঘিরে দেয়া হয়েছে। বৃত্তাকারে চিহ্নিত করা হয়েছে গোটা মাঠটিকেও।
আমরা যখন পৌঁছি তুমরি খেলা তখন চলছে। মাঠের ভেতর দু’জন বিশেষ ভঙ্গিতে ধীর পায়ে হাঁটছে। জানা গেল এদের একজন তুরি সম্প্রদায়ের রতন শিং ও অন্যজন সাঁওতাল সম্প্রদায়ের শাহা বাছকি। হেঁটে হেঁটে বিড়বিড় করে মন্ত্র পড়ছে তারা। মাঝে মাঝেই হাতের মুঠো থেকে প্রতিপক্ষের দিকে ছুড়ে দিচ্ছেন কিছু একটা। অমনি রতন শিং দূরে হুমড়ি খেয়ে পড়ে। চারপাশে দর্শকদের করতালি। কিন্তু না, রতন পরাস্ত হন না। মাটি থেকে উঠে দাঁড়ান। অতঃপর হাতের মুঠো থেকে তিনি এবার শাহা বাছকির দিকে ছুড়ে দেন কিছু একটা। কিন্তু কি ছুড়ছে তারা? মুখ থেকে এমন প্রশ্ন ফসকে বেরোতেই পাশে বসা এক বৃদ্ধা বললেন, ‘ঠাকুরি কালাই’ অর্থাৎ মাষকালাই।
কথায় কথায় বৃদ্ধার সঙ্গে পরিচয় হয়। বয়স সত্তরের মতো। নাম সবানু শিং। তিনি নাকি তুরি সম্প্রদায়ের এক সময়কার নামকরা তুমরি খেলোয়াড়। খেলার ফাঁকে ফাঁকে তার সঙ্গে চলে খেলা নিয়ে নানা আলাপচারিতা।
তুমরি মানে কি? সবানু বলেন, ‘তুমরি মানে আদিবাসীদের তন্ত্রমন্ত্র খেলা।’ তিনি জানালেন তুমরি খেলায় অংশগ্রহণ নেয় আদিবাসীপাড়ার মাহান বা ওঝারা। শুধু আদিবাসীরাই নয়, কখনও কখনও খেলাটিতে মুসলমান ও হিন্দু ধর্মাবলম্বীদেরও অংশ নিতে দেখা যায়। যেমন পাইকপাড়ার গণক মনসুর ও বীরেনের নাম জানালেন সবানু।
এ খেলা খেলতে প্রথমে মাঠে নামে দু’জন মাহান বা ওঝা। খেলার শুরুতেই তাদের হাতে দেয়া হয় মাষকালাইয়ের ডাল। খেলার সময়ে মন্ত্র পড়ে তারা সেটা ছুড়ে দেন প্রতিপক্ষের দিকে। এটিকে বলে বাণ। প্রতিপক্ষ আবার মন্ত্রের শক্তিতে সেটা থেকে রক্ষা পাওয়ার চেষ্টা করে। এভাবে একজন পরাজিত হলে মাঠে নামে আরেকজন। নির্ধারিত সময়ের মধ্যে যে কমপক্ষে দু’জনকে পরাস্ত করতে পারে সেই হয় জয়ী।
সবানু জানালেন পাতা খেলার নিয়মটি। এ খেলাটিও তুমরি খেলার মতো। তবে পাতা খেলায় একই সঙ্গে একাধিক মাহান মাঠে নামে। এ খেলায় অংশগ্রহণকারীদের একেকজনকে বলা হয় পাতা। পাতাদের সবাইকে হতে হয় তুলা রাশির। সবাই প্রথমে মাটির ঘটির পানিতে হাত ভিজায়। এটাই নিয়ম। অতঃপর মাঠের বিভিন্ন পাশে তারা অবস্থান নিয়ে মাটিতে হাত রেখে মন্ত্র পড়ে। কেউ মন্ত্র পড়ে হাত চাপড়ে শব্দ করে। কেউ আবার কাঁপতে কাঁপতে চিলের মতো তাও মারে। উদ্দেশ্য প্রতিপক্ষকে মন্ত্রের জালে বন্দি করা। মন্ত্রের শক্তিতে কেউ চিতপটাং হয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়ে। কেউ আবার মাঠের বাইরে চলে যায়।
দশ গ্রামের যে কোনো ধর্মের মাহান বা ওঝারা অংশ নেয় খেলাটিতে। খেলার খবর কীভাবে জানে তারা? সবানু বলেন, ‘হাটে হাটে ঢোল দেই। বলি, যারা যারা মাহান ব্যক্তি আছেন তুমরি খেলতে আসেন।’ কবে থেকে এই খেলা শুরু? সবানু বলেন, ‘তা কে জানে। বাপ-দাদারা খেলাডারে ধরি আইছে হামরাও আছি।’
তুমরি ও পাতা খেলায় কী মন্ত্র পড়তে হয়? এমন প্রশ্নে সবানু মুচকি হেসে উত্তরে বলেন, ‘এই ধরেন- দুই চোখে দেখাদেখি, চার চোখে টানাটানি, সপ্ত চোখে বস। আমারে ছাড়িয়া যদি অন্যদিকে যাস, দোহাই তোর মহাদেব, দোহাই তোর ঈশ্বরের মাথা খাস।’
সবানুর মন্ত্র শুনে আমরাও মজে যাই। তুমরির পরে মাঠে শুরু হয় পাতা খেলা। ৭ জন মাহান বা পাতা মাটিতে হাত রেখে অবস্থান নেয় মাঠের বিভিন্ন স্থানে। সবাই পড়ছে মন্ত্র। সবানু জানালেন মন্ত্রবাণেরও আছে নানা রকম। যেমন : গছুয়া বাণ দিলে প্রতিপক্ষ গাছে চড়ে বসে। তাই এই বাণের এমন নামকরণ। আবার একধরনের মন্ত্রবাণ দিলে প্রতিপক্ষ গোবর খুঁজতে থাকে। একে বলা হয় গোবরি বাণ। আর উড়ালটি বাণ দিলে নাকি প্রতিপক্ষ উড়াল দিতে চায়।
মন্ত্রবাণে মানুষের ক্ষতি হয় না? এমন প্রশ্নে সবানুর উত্তর, ‘এই বাণে কেউ কারো ক্ষতি করতে পারে না। বাণ দিলে ঐ বাণডা আবার ফেরত আনতে হয়। এইডাই নিয়ম। বাণ ফেরত নিতে না পারলে তবে আবার কিসের বাণ?’
এরই মধ্যে জমে ওঠে পাতা খেলা। দর্শকদের মুখে মুখে হাসি। হাতে হাতে করতালি। সবানু জানলেন এক সময় আদিবাসীদের পাড়ায় পাড়ায় আয়োজন চলত তুমরি ও পাতা খেলার। এখন সময় পাল্টে গেছে। আদিবাসী ও গ্রামীণ সমাজে এসেছে সচেতনতা। মন্ত্রের প্রতি আদিবাসীদের বিশ্বাস কমে গেছে। ফলে কমে গেছে মাহান বা ওঝাদের সংখ্যাও। তাই একই সঙ্গে কমে গেছে তুমরি ও পাতা খেলার আয়োজনটাও।
তাহলে কি তুমরি ও পাতা খেলা হারিয়ে যাবে? লম্বা নিঃশ্বাস নিয়ে একধরনের বিশ্বাস আর আশায় বুক বাঁধেন সবানু। অতঃপর স্থানীয় ভাষায় উত্তরে বলেন, ‘মনসার নামে খেলাডা হয়। মনসায় বিশ্বাস থাকলি তুমরি খেলা থাকবি। হামেরা হারেই যাবা দিম নাই। হামরা খেলাটাক ধরি থুমো’।
দর্শকদের হৈ হুল্লোড়ে আমাদের দৃষ্টি ফেরে। পাতা খেলার বিজয়ীকে ঘিরে সবার আনন্দ। আমরা শুধু অবাক হয়ে দেখি, মন্ত্র যুদ্ধের এক অনাবিল আনন্দে মজে গেছে গোটা গ্রামের সব মানুষ।
লিখাটি প্রকাশিত হযেছে সাপ্তাহিকে ২২ সেপ্টেম্বর ২০১১
© 2011 – 2018, https:.
vALO.
thanks..