নৃত্যগুলো আদিবাসীদের
কড়া পাড়ায় কিভাবে যাব? পৌঁছতে হবে সন্ধ্যার আগে। তা নাহলে কারমাপূজার আনুষ্ঠানিকতা দেখাই দায়। কিন্তু মোটরসাইকেলের বেহাল দশা। ঠিক হবে, নাকি কি হবে না? এই ভাবনা যখন মস্তিষ্কে ঘুরপাক খাচ্ছে তখনই দেখা মেলে কাজিম ভাইয়ের। তার মোটরসাইকেলে সওয়ার হয়ে রওনা হই কড়া পাড়ার দিকে। কাজিম ভাইয়ের বাড়ি দিনাজপুরেই। পুরো নাম কাজিম উদ্দিন। পেশায় একজন প্রকৌশলী। কাজের ফাঁকে ফাঁকে তিনিও ঘুরে বেড়ান বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর পাড়াগুলোতে। কারমাপূজার সংবাদ পেয়ে তিনিও যাচ্ছিলেন হালজায়ের কড়া পাড়ার দিকে।
শরতের আকাশ এমনিতেই অন্যরকম। নীল আকাশে যেন সাদা রঙের তুলির আঁচড়। নিচে ধান ক্ষেতের সবুজ জমিন। যেন এক ছবির দেশ। যতই এগোই ততই পাল্টে যায় দৃশ্যগুলো। হালজায় কড়া পাড়াতেও দেখি অন্য দৃশ্য। সবার মুখেই আনন্দের ঢেউ। গোটা পাড়ার বাড়িগুলো একেবারে টানটান পরিষ্কার। মাটিতে লেপে দেয়া হয়েছে বাড়ির আঙ্গিনা। সন্ধ্যার আগেই বাড়ির মহিলারা ¯œান সেরে তৈরি হয়ে নিচ্ছে পূজার জন্য।
আমাদের আগেই সেখানে পৌঁছে গেছে আরডিআরএস নামক এনজিওর দুজন কর্মকর্তা। পরিচয় হয় তাদের সঙ্গে। একজনের নাম সুমনা এবং অন্যজন রেনু হেমব্রম। সুমনা হালুয়াঘাটের গারো এবং রেনু রাজশাহীর সাঁওতাল সম্প্রদায়ের মানুষ। চাকরির সুবাদে কাজ করছেন দিনাজপুরের বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠী নিয়ে। তাদের শিশুদের শিক্ষাদান এবং নানা বিষয়ে সচেতনতা তৈরি করাই এদের কাজ। তারাও তাদেরকে কাছের মানুষ মনে করে। নিজেরা ভিন্ন জাতিগোষ্ঠী হওয়ায় এক ধরনের দরদ দিয়েই স্বগোত্রীয় মানুষদের জন্য কাজ করেন এই দুই নারী। ফলে এ অঞ্চলের ভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর নানা অনুষ্ঠানে একান্ত নিমন্ত্রিত অতিথি এই দুজন।
কড়া পাড়াতে নেই কোনো বিদ্যুৎ। ফলে সূর্যাস্তের পরেই নামে অন্ধকার। কিন্তু আজ তেমনটি ঘটল না। পাড়ার বিভিন্ন পাশে জ্বলে উঠল এনার্জি বাল্ব। আলোকিত হলো গোটা পাড়া। গোত্রের মাহাতো জগেন জানালো পূজার কারণে বাড়ি প্রতি চাঁদা তুলে ভাড়া করে আনা হয়েছে জেনারেটর। এই ইচ্ছে তাদের কয়েক বছর আগের। এ বছর তা পূরণ হলো। এ নিয়ে এক ধরনের ভালোলাগা তাদের চোখেমুখে ফুটে ওঠে।
একটি বাড়ির উঠোনে চলছে ম-প তৈরির কাজ। বাঁশ দিয়ে মাচার মতো তৈরি করে তাতে জুড়ে দেয়া হয়েছে অজস্ত্র শাপলাফুল। মাটি দিয়ে খানিকটা জায়গা লেপে তৈরি করা হয়েছে পূজার স্থান। পাশেই রাখা হয়েছে উপোসের দুটি ডালা। ডালায় গজে উঠেছে অগণিত কালাইয়ের চারা। মাহাতো জানালেন বন থেকে কেটে আনা খিলকদম গাছের ডাল কেটে এনে রাখা হবে বাঁশের মাচার ঠিক মাঝ বরাবরে। এই গাছের ডালকেই কড়ারা পূজা করে কারমাপূজায়। এবার কারমাপূজায় কড়ারা ভাড়া করেছে সাউন্ড সিস্টেমও। সঙ্গে ডেকোরেটরের লাল-নীল চেয়ার। উঠোনের একাংশ ত্রিপল দিয়ে ঢেকে দেয়া হয়েছে। চেয়ারে সাজানো হয়েছে একপাশ। অথচ আগে উন্মুক্ত আকাশের নিচের মাদুর বিছিয়ে আয়োজন চলত পূজার আনুষ্ঠানিকতার। আধুনিকতার ছোঁয়ায় বদলে গিয়েছে কড়াদের পূজার আয়োজনটি।হিন্দি গান বাজছে উচ্চ শব্দে : ‘বাল্লে বাল্লে……’। গানের তালে তালে ম-প সাজাচ্ছে সবাই। হিন্দি গানের সুরে যুবক বয়সীদের চোখেমুখে যেন গর্বের ছাপ। আমরা খানিকটা নীরব হয়ে যাই। হিন্দি সংস্কৃতি যে শুধু বাঙালি ছাড়াও অন্য জাতিগোষ্ঠীর সংস্কৃতিকেও গ্রাস করেছে, তাই দেখি অবাক হয়ে।
এরই মধ্যে খিলকদম গাছের ডাল কেটে আনে সুজন কড়া ও বাবু কড়া। গাছের ডাল আসতেই শুরু হয় বলি পর্ব। মাহাতো ম-পের চারপাশ সাতপাক ঘুরে দুটি মুরগি বলি দেয় সৃষ্টিকর্তার সন্তুষ্টির ইচ্ছা নিয়ে। অতঃপর শুরু হয় পূজার আনুষ্ঠানিকতা। গোত্রের সাতান কড়া গল্পের মতো করে সবার উদ্দেশে বলতে থাকেন কারমা পূজার মিথটি। কড়া নারীরা ম-পের চারপাশে বসে তা শোনেন এবং মাঝে মাঝে ম-পের দিকে ছুড়ে দেন দু’একটি ফুল। অতঃপর ধূপ জ্বালিয়ে একে একে পূজা দেন সবাই।
পূজা শেষে শুরু হয় নৃত্য। কড়াদের ভাষায় ঝুমটা নাচ। দলবেঁধে ঘুরে ঘুরে নাচে কড়া নারীরা। মাদলের শব্দে মাতাল করা সে নৃত্য। কাজিম ভাই ব্যস্ত হয়ে পড়েন ছবি তোলায়। একপাশে বসে আমরা দেখছিলাম সবকিছু। কথায় কথায় সুমনা ও রেনুর সঙ্গে আলাপ হয় বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর নৃত্য নিয়ে।
সুমনা বলেন গারোদের নৃত্যের নানা কথা। গারোদের বেশির ভাগ নৃত্য অনুষ্ঠিত হয় জুম চাষকে কেন্দ্র করে। এদের বছর গণনার হিসাব খানিকটা ভিন্ন। গালমাকজা বা ফেব্রুয়ারি মাস থেকে ওয়াচেংজা বা জানুয়ারি পর্যন্ত সময়কে এরা এক বছর হিসেবে গণনা করে। প্রায় প্রতি মাসেই গারোদের দু’একটি নৃত্যের আয়োজন চলে। গারোদের নৃত্যের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ঘোরির আ, মংসি আ, গিন্দেগালা, কিলপুআ, আমব্রে রুরু আ, দুকরু সুআ প্রভৃতি। বিভিন্ন অনুষ্ঠানকে কেন্দ্র করে গারোদের নৃত্যের অবতারণা ঘটে। নৃত্যের ভাব-বিভাবের মধ্যে দেহবিক্ষেপ ও অঙ্গ সঞ্চালনই প্রধান। এর মাধ্যমে গারোরা পশুপাখির অনুকৃতমণিপুরীদের কথা। মণিপুরীরা বিশ্বাস করে পৃথিবী সৃষ্টির মূলে রয়েছে নৃত্য। নয়জন দেবতা ও সাতজন দেবীর মিলিত প্রচেষ্টায় তৈরি হয়েছে পৃথিবী। অন্য জাতিগোষ্ঠীর মানুষদের মতো মণিপুরীরাও বিশ্বাস করে পৃথিবী সৃষ্টির পূর্বে চারদিকে ছিল শুধুই পানি। কোথাও স্থলের চিহ্নমাত্র ছিল না। ঈশ্বর চিন্তা করলেন পৃথিবী সৃষ্টি করবেন। ঈশ্বরের ইচ্ছার কথা জানতেই সাত দেবী (মণিপুরী ভাষায় লাইনুরা) পানির উপর নৃত্য শুরু করল। তাদের নৃত্যের তালে মুগ্ধ হয় হয় দেবতা (মণিপুরী ভাষায় লাইবংথু)। তারা স্বর্গ থেকে নৃত্যের তালে তালে ঢিল ছুড়তে থাকে। সেই ঢিলের মাটি জড়ো হয়ে এক সময় সৃষ্টি হয় পৃথিবী। সে কারণেই নৃত্য মণিপুরীদের কাছে অতি পবিত্র।
মণিপুরীদের নৃত্যগুলোর মধ্যে লাই হারা-উবা, লাই-একাউবা, লাই-থেম্বা, লাই-পৌ, রাস, থাবল চোংবি, খুবাক ইশে প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য। ‘লাই’ অর্থ দেবতা, ‘হারা উবা’ অর্থ আনন্দ। দেবতাদের আনন্দ দানের উদ্দেশ্যে বৈশাখ মাসে এক পক্ষকাল এই নৃত্যের আয়োজন করে মণিপুরীরা। আবার দৈবশক্তির আহ্বানে লাই-একাউবা এবং বৃষ্টির জন্য প্রার্থনায় লাই-থেম্বা নৃত্যের আয়োজন করা হয়।
সুমনা থামতেই পাশ থেকে আগ্রহ নিয়ে সাঁওতালদের নানা ধরনের নৃত্যের কথা বলেন রেনু হেমব্রম। সাঁওতালরা বিশ্বাস করে নৃত্য ঐশ্বরিক দান এবং দেবতাদের সহায়তায়ই তা মানুষের সমাজে বিস্তার ঘটেছে। রেনু জানালেন সাঁওতাল সমাজে রয়েছে নানা ধরনের নৃত্য। একে একে বলতে থাকেন নৃত্যগুলোর কথা। বৃষ্টির জন্য পূর্ণিমা রাত্রে সাঁওতালরা যে নৃত্যের আয়োজন করে সাঁওতাল ভাষায় তা ‘লাগরেঞ’। ২০ থেকে ৩০ জন অবিবাহিত যুবক-যুবতী বৃত্তাকারে এ নৃত্যে অংশ নেয়। সাঁওতালদের বিবাহ অনুষ্ঠানের নৃত্যকে বলা হয় ‘দোন’। এ নৃত্যে মেয়েরা দলবেঁধে নাচে আর পুরুষরা মাঝখানে বসে মাদল ও বাঁশি বাজায়। এছাড়া সাঁওতালদের বিয়ে অনুষ্ঠানে দুপক্ষের মাঝে চলে প্রশ্নোত্তর পর্ব। এ পর্বে বিশেষ ধরনের নাচের আয়োজন করতে হয়। একে বলা হয় ‘ঝিকা’। সোহরাই ও বাহা অনুষ্ঠানের নাচকে সাঁওতালরা বলে ‘জাতুর’। এছাড়া বৃষ্টির আহ্বান, বীজবোনা, ফসল কাটার সময় সাঁওতালরা আয়োজন করে ‘রিনজা’ নৃত্যের। মাঘ মাসের চন্দ্রোদয় এবং ফাগুন মাসের পূর্ণিমা রাত দাহার নৃত্যের জন্য নির্দিষ্ট থাকে।
কথায় কথায় কড়া পাড়ায় ঝুমটা নাচের আসর জমে ওঠে। রেনু জানালেন কড়াদের ঝুমটা নাচটি অনেকটাই সাঁওতালদের ঝুমুর নাচের মতো। বছরের যে কোনো সময় যে কোনো স্থানে সাঁওতালদের ঝুমুর নাচ অনুষ্ঠিত হতে পারে। পায়ে ঘুঙ্গুর বেঁধে গানের তালে তালে এই নাচ করতে হয়। ঝুমুর নাচের আবার রয়েছে রকমফের দাঁড় ঝুমুর, টাঁড় ঝুমুর, ভাদুরিয়া ঝুমুর, কাঠি নাচের ঝুমুর, পাতা নাচের ঝুমুর, নাচনি ঝুমুর ইত্যাদি।
রাত যত বাড়তে থাকে কড়াদের উৎসবও ততই জমে ওঠে। ঘরে ঘরে তৈরি হয় তেলের পিঠা। সে পিঠা বেঁধে দেয়া হয় ম-পের বাঁশের মাচায়। তেলের পিঠা খেতে খেতে আমরাও দেখি কড়াদের ঝুমটা নাচের আসর। সুনিয়া কড়ার নেতৃত্বে দলবেঁধে নাচছে কড়া নারীরা। পায়ে পা মিলিয়ে ম-পের চারপাশে নাচছে এরা। রাতভর চলবে এ নৃত্য। মাদলে তাল তুলতে মত্ত হয়ে উঠে কিনা কড়া। মাদলের তাল আর ঝুমটা নাচের আনন্দে হারিয়ে যায় তাদের না বলা সব কষ্টগুলো।
লিখাটি প্রকাশিত হয়েছে সাপ্তাহিকে ২৯ সেপ্টেম্বর ২০১১ তে
© 2011 – 2018, https:.