ক্যাটাগরিহীন

আদিবাসী জীবনের বহুমাত্রিকতার সন্ধান

স্বকৃত নোমান

এক বাংলায় পাঁচ কি ছয় হাজার বছর আগ থেকে মানুষ বসবাস করছে বলে প্রত্নতাত্ত্বিক, গবেষক ও ঐতিহাসিকদের ধারণা । তাই যদি হয় হবে এখানে আর্যদের আগমনের আগে কোন না কোন জাতি তো ছিল । থাকলে তারা কারা ? তারা এখানকার ভূমিপুত্র । একদা তারা এ দেশের প্রকৃত অধিকারী । শিক্ষা – দীক্ষা  ও বুদ্ধিমত্তায় আর্যরা জাতি হিসেবে উন্নত ছিল বলে এখানকার অধিবাসীরা পড়ে গেল পেছনে, হয়ে পড়ল সংখ্যালঘু, আর সামনে এগিয়ে গেল আর্যরা । এই পেচনে পড়া আর্যপূর্ব জনগোষ্ঠীর মধ্যে রয়েছে বিভিন্ন সম্প্রদায় : কোল, ভীল, পাহান, সাঁওতাল, মুন্ডা, গারো, কোচ. ত্রিপুরা, চাকমা, মারমা প্রভৃতি । এসব সম্প্রদায় বর্তমান বাংলার উত্তর ও উত্তর-পূর্ব সীমান্তসহ পার্বত্য চট্রগ্রামের বিশাল এলাকায় বসবাস করছে । এরা বাংলার আদিবাসী । কেউ কেউ তাদেরকে ‌‌উপজাতি বলে আখ্যায়িত করে । এ নিয়ে বির্তকেরও অন্ত নেই । তবে আমাদের বিবেক বলে, জাতি তো জাতিই, তার আবার ‌‌’ উপ ‘ কী ।  কোন জাতি কোন রাষ্ট্রে সংখ্যায় কম হলে তারা সংখ্যালঘু জাতিগোষ্ঠী হতে পারে , উপজাতি নয় । এই অভিধার মাধ্যমে মানুষকে খাটো করা হয়, অসম্মান করা হয় । তাই কোন বিবেক-বুদ্ধিসম্পন্ন মানুষ আদিবাসীদেরকে উপজাতি নামক বিদ্রূপাত্মক অভিধায় চিহিৃত করতে পারে না । আগ্রাসী বাঙালিদের দোর্দন্ড প্রতাপে এই দেশের আদিবাসীরা বর্তমানে বিভিন্নভাবে নির্যাতনের শিকার । রাষ্ট্র তাদেরকে পরিপূর্ণ সহযোগিতার কথা বলে, কিন্ত করে বিপরীত । আদিবাসীদের জায়গা-জমি দখল করে নিচ্ছে বাঙালিরা – এমন খবরও মাঝেমধ্যে পত্রিকায় চোখে পড়ে । হারিয়ে যাচ্ছে তাদের ভাষা, হারিয়ে যাচ্ছে সংষ্কৃতি । ভাষা বিবর্তনশীল । পৃথিবীতে বহু ভাষার মৃত্যু হয়েছে । সংষ্কৃতিও তাই ।  কিন্ত এসব ভাষা ও সংষ্কৃতিকে রক্ষণাবেক্ষণ করার দায়িত্ব আদিবাসীদের যেমন আছে, এই দেশের নাগরিক হিসেবে বাঙালিদেরও আছে । গবেষক ও লেখক সালেক খোকন মূলত এই কাজটিই  করেছেন । বাংলাদেশে যেসব আদিবাসী জনগোষ্ঠী রয়েছে, তার  একটা বড় অংশ বাস করে উত্তরবঙ্গে । সালেক খোকনের কাজের ক্ষেত্র তাই ওই এলাকা । পেশাগত জীবনে তিনি একজন সরকারি কর্মকর্তা, কিন্ত্ত নেশা তার গবেষণা । নিয়ত অনুসন্ধিতসু এই গবেষক ঘুরে বেড়ান প্রত্যন্ত অঞ্চলে আদি মানুষদের নানা বিষয়- আশয়ের সন্ধানে । সালেক খোকনের লিখা গতানুগতিক নয় । দৈনিন্দিন জীবনচর্চার মতোই সহজ ও সাবলীল তার লেখার ভাষা ।  গল্পের ছলে কিংবা ভ্রমণকাহিনির ছলে তিনি প্রবন্ধ লিখেন ।  গল্প কি কাহিনির মধ্যে তিনি ফিউশন ঘটান তার বিষয়সংশ্লিষ্ট তথ্যের । আদিবাসী পল্লিতে ঘুরে ঘুরে, আদি মানুষদের সঙ্গে কথা বলে তিনি লিখেন । সরাসরি আশ্রয় নেন না  কোন পুথিঁ- পুস্তকের । যা দেখেন, শোনেন, তা-ই উঠে আসে তার লেখায় একেবারে শতভাগ সত্যতা নিয়ে । ‘ আদিবাসীরা হারিয়ে যাচ্ছে’, ‌’তাদের  ভাষা – সংষ্কৃতি হারাচ্ছে’ – এই সব আবেগী কথাবার্তা নেই তার লেখায । কোনো বিষয়ে তিনি প্রভাবিত হননি । লেখার ক্ষেত্রে একেবারেই নিমোর্হ থেকেছেন । পাঠকই বুঝে নেন, আদিবাসীদের অবস্থাটা আসলে কি । একজন গবেষক ও লেখকের এটিই সবচেয়ে বড় শক্তি । জানামতে, প্রায় চারবছরেরও বেশি সময় ধরে সালেক খোকন আদিবাসী বিষয় নিয়ে লেখালিখি করছেন । চারবছর ধরে তিনি আদিবাসীদের ওপর যে কয়টি মৌলিক লেখা দাঁড় করিয়েছেন, সেগুলোরই সংকলন হলো এবার । অমর একুশে বইমেলা উপলক্ষে প্রকাশিত হলো তার প্রথম বই ‌’ আদিবাসী মিথ এবং অন্যান্য ‘ । এ বছর আদিবাসীদের নিয়ে যে কটি বই প্রকাশিত হয়েছে, সবচেয়ে আলোচিত বইগুলোর মধ্যে তার এই বইটিও রয়েছে ।

‘ আদিবাসী মিথ এবং অন্যান্য ‘ বইটিতে সর্বমোট ২৭ টি প্রবন্ধ স্থান পেয়েছে । প্রতিটি প্রবন্ধের বিষয় আলাদা । আদিবাসীদের বিশ্বাস, তাদের রূপকথা, আদিবাসী ব্যক্তিত্ব, দেব-দেবী, পূজা -পার্বণ, উতসব, জীবন-যাপন, বিনোদন, মিথ ও শিক্ষা – মোটা দাগে এসব বিষয় বিস্তারিত আলোচিত হয়েছে ।

বইটিতে পাঠকদের আকর্ষণ করার মতো একাধিক বিষয় রয়েছে । তন্মধ্যে অন্যতম হচ্ছে আদিবাসীদের মিথগুলো । এগুলো এত সুন্দর ও অভিনব যে, সকল শ্রেণীর পাঠকেরই ভালো লাগবে, জানার ভান্ডার সমৃদ্ধ হবে । উদাহরণ হিসেবে ওরাঁওদের একটি মিথ উল্লেখ করা যেতে পারে । চন্দ্র ও সূর্য সৃষ্টি নিয়ে এদের বিশ্বাসে আছে প্রাচীন এক কাহিনী । তা এরকম : ‘ ধরমেশ যখন পৃথিবী সৃষ্টি করল তখন আকাশ ও মাটি ছিল খুবই কাছাকাছি । মানুষ চলাফেলা করার সময়ই আকাশ মাথায় ঠেকতো । একবার মানুষের কোনো এক অপরাধে আকাশ উপরে উঠে গেল । এতে চলাফেরায় মানুষের সুবিধা হলেও সবকিছু অন্ধকার হয়ে গেল । বনের মধ্যে ছিল এক মহুয়া গাছ । সে গাছে ফুল যতক্ষণ ফুটে থাকত ততক্ষণ পৃথিবী আলোকিত থাকত । আর যখন ফুল শুকিয়ে যেত তখন আবার অন্ধকার নেমে আসতো । সবাই ভাবল, গাছটিই অন্ধকারের মূল কারণ । সিদ্ধান্ত নেয়া হলো, গাছটিতে কেটে ফেলে আলো উদ্ধারের । গাছটি কাটা হলো । কিন্তু তারপরও সেটি মাটিতে পড়ছে না । দৈববাণীর মাধ্যমে জানা গেল, গাছটিতে রয়েছে চিলের বাসা, চিলটিকে না মারলে গাছটি মাটিতে পড়বে না । তা-ই হলো । চিলটিকে মারার পরপরই গাছটি মাটিতে পড়ে গেল। পড়ার শব্দে কেঁপে উঠল গোটা পৃথিবী । সে দেশের রাজা ভাবল, শত্রুরা তার রাজ্য আক্রমণ করেছে । তিনি সৈন্য নিয়ে এসে দেখলেন গাছটি কাটা । রাজা ক্ষিপ্ত হয়ে শাস্তির হুকুম দিলেন । উভয়পক্ষের সাথে চলল রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ । রাজার সৈন্য পরাজিত হলো । অতঃপর গাছটিকে দুই ভাগ করে কাটা হলো। দেখা গেল নিচের দিকে বড় অংশটিতে সূর্য আর উপরের দিকের ছোট অংশটিতে চন্দ্র । কিন্তু তাদের জীবনদান হবে কীভাবে ? আবারও দৈববাণী এলো । এক চাষীর আদরের পুত্রকে চুরি করে এনে হত্যা করে তার রক্ত ঢেলে দেয়া হলো গাছের কাটা অংশে । সঙ্গে সঙ্গে চন্দ্র ও সূর্য জীবিত হয়ে আকাশে উঠে গেল । সে সময় থেকেই ওরাঁওরা মানে করে সূর্য পুরুষ এবং সে বেশি রক্ত পান করেছিল বলে তেজী ও লাল । একইভাবে চন্দ্র নারী এবং সে কম রক্ত পান করেছিল বলে স্নিগ্ধ ও সাদা ।’
এ রকম অনেক মিথ আছে এই বইটিতে । সত্যাসত্যে এইসব মিথকে বিচার করা যাবে না হয়তো । কিন্ত একটা সম্প্রদায় হাজার হাজার বছর ধরে যে বিশ্বাসকে লালন করছে, তা আমাদের মধ্যে কৌতূহল জাগায় বৈকি !
অধিকাংশ লেখার সঙ্গেই ছবি দেয়া হয়েছে । লেখকের নিজের তোলা ছবি। আদিবাসীদের জীবন-যাপনের নানা চিত্র । তবে ভূলও আছে বটে । ১৫ পৃষ্ঠায় একটি ছবি ক্যাপশনে দেখা যায় গৃহের দেবতার উদ্দেশ্যে অবনত হয়েছেন এক মুসহর । কিন্ত ভ্রমবশত লেখক সেই অবনত হওয়াটাকে ‌সেজদা বলছেন । অর্থাত তাদের উপাসনাকে মুসলমানি শব্দ দ্বারা ধরতে চেষ্টা  করেছেন । এ উচিত বলে মনে হয় না । তাদের সেই উপাসনা পদ্ধতির একটা নাম নিশ্চয়ই আছে । লেখক যদি সেটা পাঠকদের জানাতে পারতেন, তবে ভালো হতো ।

বইটি প্রকাশিত হয়েছে ইত্যাদি গ্রন্থ প্রকাশ থেকে । প্রচ্ছদ করেছেন নিয়াজ চৌধুরী তুলি । ১৬০ পৃষ্ঠার এই বইটির দাম রাখা হয়েছে ২০০ টাকা ।

লিখাটি প্রকাশিত হয়েছে সাপ্তাহিক কাগজে ২ অক্টোবর ২০১১ তে ।

© 2011 – 2018, https:.

এই ওয়েবসাইটটি কপিরাইট আইনে নিবন্ধিত। নিবন্ধন নং: 14864-copr । সাইটটিতে প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো তথ্য, সংবাদ, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করলে আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।

Show More

Salek Khokon

সালেক খোকনের জন্ম ঢাকায়। পৈতৃক ভিটে ঢাকার বাড্ডা থানাধীন বড় বেরাইদে। কিন্তু তাঁর শৈশব ও কৈশোর কেটেছে ঢাকার কাফরুলে। ঢাকা শহরেই বেড়ে ওঠা, শিক্ষা ও কর্মজীবন। ম্যানেজমেন্টে স্নাতকোত্তর। ছোটবেলা থেকেই ঝোঁক সংস্কৃতির প্রতি। নানা সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠনের সঙ্গে জড়িত। যুক্ত ছিলেন বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র ও থিয়েটারের সঙ্গেও। তাঁর রচিত ‘যুদ্ধদিনের গদ্য ও প্রামাণ্য’ গ্রন্থটি ২০১৫ সালে মুক্তিযুদ্ধ ভিত্তিক মৌলিক গবেষণা গ্রন্থ হিসেবে ‘কালি ও কলম’পুরস্কার লাভ করে। মুক্তিযুদ্ধ, আদিবাসী ও ভ্রমণবিষয়ক লেখায় আগ্রহ বেশি। নিয়মিত লিখছেন দেশের প্রথম সারির দৈনিক, সাপ্তাহিক, ব্লগ এবং অনলাইন পত্রিকায়। লেখার পাশাপাশি আলোকচিত্রে নানা ঘটনা তুলে আনতে ‘পাঠশালা’ ও ‘কাউন্টার ফটো’ থেকে সমাপ্ত করেছেন ফটোগ্রাফির বিশেষ কোর্স। স্বপ্ন দেখেন মুক্তিযুদ্ধ, আদিবাসী এবং দেশের কৃষ্টি নিয়ে ভিন্ন ধরনের তথ্য ও গবেষণামূলক কাজ করার। সহধর্মিণী তানিয়া আক্তার মিমি এবং দুই মেয়ে পৃথা প্রণোদনা ও আদিবা।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

Back to top button