আদিবাসী

পিপল্লা গ্রামের বুনজারদের জীবন

সময় খুবই কম, তার ওপর লোকের অভাব। বেশি মজুরির প্রলোভনেও মিলছে না মাঠের কাজের লেবার। নয়াদীঘির আজগর এখনও খুঁজছে দুটি পাইট। এখানের স্থানীয়রা মাঠের লেবারদের ‘পাইট’ বলে। স্বল্পসময়ে মাঠ তৈরিতে সবাই খোঁজে আদিবাসী পাইট। দিনাজপুরের স্থানীয়দের কাছে পাইট হিসেবে আদিবাসীদের বেশ চাহিদা। সবার কাছে এরা যেমন কর্মঠ তেমনি বিশ্বাসী। সাধারণ সময়ে আদিবাসীরা নিজ থেকেই কাজ খুঁজতে এলেও এ সময়টাতে পাইট খুঁজতে আজগরের মতো অনেককেই যেতে হয় আদিবাসী গ্রামগুলোতে। গ্রামের নাম ‘পিপল্লা’। আজগরসহ যখন গ্রামটিতে পৌঁছলাম তখন মধ্য বিকেল। পাকা রাস্তা পার হয়ে ধান ক্ষেতের আইল দিয়ে যতই গ্রামের দিকে এগুচ্ছি ততই ঢোল আর আদিবাসী গানের অন্যরকম সুর কানে ভেসে আসছে। দূর থেকে শোনা যাচ্ছে দরদ দিয়ে একদল আদিবাসী গাচ্ছে, ‘হে ভগবান, পতিসে পাবনে সিতারাম, জেয় ভগবান’। আজগর জানায়, ভাদ্র, আশ্বিন ও কার্তিক এই তিন মাস যখন কাজ থাকে না তখন এই গ্রামের একদল আদিবাসী জীবিকার জন্য গান করে মন্দির ও বিয়ের অনুষ্ঠানগুলোতে। তারই মহড়া চলছে এখন। নাস্তাসহ ১৭০/- টাকা পারিশ্রমিকে পাইট হিসেবে আজগর খুঁজে পেল মালতি আর হরিমহনকে। মাঠে গিয়ে মেয়েরা আবার কি কাজ করবে, জানতে চাইলে মালতি বলে, ‘দাদা, কাদো (ধানের চারা) গারি, ঘাস বাচি’। সাওতাল ভেবে বললাম তোমরা তো নিশ্চয়ই সাওতাল। জাত রক্ষায় পেছন থেকে হরিমহন কিছুটা চেঁচিয়ে বলল,‘না বাবু, হামারা বুনজার জাতি’।
পিপল্লা গ্রামে বাস করে ৪৮টি আদিবাসী বুনজার পরিবার। একটি বড় পুকুরের চারপাশ ঘেঁষে এদের বাস। এই গ্রামের বুনজাররা এখনও সাওতাল, ওরাং বা অন্যান্য আদিবাসীর মতো ততটা অসচ্ছল নয়। ফলে পূর্ব পুরুষদের সনাতন হিন্দু ধর্ম ত্যাগ করে খ্রিস্টান হওয়ার প্রলোভন তাদের প্রভাবিত করেনি। কথা হলো গোত্রপ্রধান বিসুরা মন্ডলের সঙ্গে। আদিবাসী বুনজাররা তাদের গোত্রের প্রধানকে বলে ‘মন্ডল’। তাই নাম বিসুরা হলেও গোত্রের প্রধান হওয়ায় সবাই ডাকে ‘বিসুরা মন্ডল’ বলে। বিসুরা জানায়, এ গ্রামের বুনজারদের জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত নানা আয়োজনে গোত্রের প্রধান হিসেবে প্রথা অনুসারে তাকে পালন করতে হয় অনেক গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব। মন্ডল ছাড়াও আদিবাসী বুনজার সম্প্রদায়ের গোত্রে থাকে আরও বেশ কয়েকটি দায়িত্বশীল পদ। গোত্রে মন্ডলের পরই মহতের স্থান। এছাড়া এখনও গোত্রের সকলকে নানা খবর পৌঁছে দিতে রয়েছে ‘কোতোয়াল’। গোত্রের অবাধ্য যে কাউকে শাস্তি দেয়ার জন্য আছে ‘সিপাহি’। এই গোত্রের সিপাহি নকুল বুনজার জানায়, তাদের সম্প্রদায়ে এখনো ‘বন্’ প্রথা চালু আছে। কোন বিষয়ে দলপ্রধানের সিদ্ধান্তের বাইরে গেলে বা অবাধ্য হলে শাস্তিস্বরূপ ঐ পরিবারকে ‘বন’ দেয়া হয়। বন অবস্থায় ঐ পরিবারকে আগুন, পানিসহ কোনো কিছু দেয়া ও নেয়া অন্যদের জন্য সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। পুকুরের দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে ৯০ বছর বয়স্ক কুশিমন। এখানে কতদিন থেকে আছেন, জিজ্ঞেস করেও কোনো উত্তর মিলল না। পাশ থেকে গাবলু বুনজার বৃদ্ধের পাশে গিয়ে বলল, ‘কেতনা দিন এহাছে’। জানা গেল, বয়সের ভারে আদিবাসী বুনজারদের ‘খণ্টা’ ভাষা ছাড়া বৃদ্ধা অন্য কোনো ভাষা বুঝতে পারে না। সে এখানে আছে ব্রিটিশ আমল থেকেই। খুব কম বয়সী একটি মেয়ের কাছে এগিয়ে গেলাম। নাম আরতি বালা। মাথায় ভরাট সিঁদুর। জানা গেল, এক মাস আগে বিয়ে হয়েছে তার। বুনজারদের বিয়ের পর্ব হয় কিভাবে, জানতে চাইলে মেয়ের মা উসিলা বালা আগ্রহ নিয়ে জানায় বিয়ে সংক্রান্ত চমৎকার সব তথ্য। আদিবাসী বুনজারদের বিয়েতে কোনো ব্রাহ্মণ নয় বরং ডাকতে হয় ‘লোউরা’ বা নাপিতকে। এই লোউরা বর ও কনের কানি আঙ্গুল কেটে সামান্য রক্ত নিয়ে আম পাতার মধ্যে ঐ রক্ত ও সামান্য আতপ চাল একত্র করে উভয়ের হাতেই বেঁধে দেয়। এরপর কনের শাড়ির সঙ্গে বেঁধে দেয়া হয় বরের ধুতি আর উভয়পক্ষের মন্ডল ও সকলের উপস্থিতিতে বর  কনের চারদিকে পাঁচবার ঘুরে কনের কপালে সিঁন্দুর (সিঁদুর) পরায়। সিঁদুরের পরেই শুরু হয় ভোজপর্ব আর সারারাত চলে আদিবাসী নৃত্য ও হাড়িয়া খাওয়া। বিয়ের লেনদেন সম্পর্কে

আদিবাসী বুনজারদের বেশকিছু তথ্য আমাদের অবাক করে। বাঙালি সমাজে প্রকাশ্যে বা গোপনে যৌতুক নেয়ার প্রবণতা থাকলেও আদিবাসী বুনজারদের এখনও মেয়ে পক্ষকে পণ হিসেবে দিতে হয় ২৯ টাকা ও আধা মণ চাল। আদিবাসী বুনজারদের যে কোনো অনুষ্ঠানে শুকর বা খাসির মাংস খাওয়ানো হলেও তাদের পছন্দের তালিকায় আছে বিজু, কুচিয়া (কুচ্ছা), মুসো (ইঁদুর), দুরা (কচ্ছপ), গোঙ্গা (শামুক), কোকড়া (কাকড়া) প্রভৃতি। এরা মনে করে, এগুলো খেলে অনেক দুরারোগ্য ব্যাধি থেকেও রক্ষা পাওয়া যায়। মালতির ভাষায় ‘বিজু খালে প্যারালাইসিস নে হোতে’ (বিজু খেলে প্যারালাইসিস হয় না)। হরিমহন বুনজার বলে ‘মুসো খালে পিলে নে হোতে’ (ইঁদুর খেলে ভুঁড়ি হয় না)। গোত্রের মন্ডল বলে ‘কোকড়া খালে খেসরা নে হোতে’ (কাকড়া খেলে বসন্ত রোগ হয় না)। বুনজাররা মনে করে টাকার অভাবে দুধ খেতে না পারলেও কুচিয়া দুধের বিকল্প হিসেবে কাজ করে। যাদের আর্থিক অবস্থা ভাল নয় তাদের অনেক টাকা দিলে খ্রিস্টান হবে কিনা জানতে চাইলে গোত্রের মন্ডলের সাফ জবাব, ‘হবো না তো, কেনে হবে’।
কথা হলো যুবক বয়সী মানু বুনজারের সঙ্গে। তার সকল আনন্দ পূজাকে ঘিরে। মানু জানায়, হিন্দু ধর্মের প্রায় সব পূজাই বুনজাররা উদ্যাপন করলেও ভাদ্র মাসে কালী পূজার ছয়দিন পর এরা পালন করে একটি বিশেষ ধরনের পূজা। তাদের ভাষায়, ‘সূর্যা হু পূজা’। এই পূজার তিন দিন আগ থেকে পাক পবিত্রতার সঙ্গে থাকতে হয় উপোস। উপোস অবস্থায় দুধ কলা ছাড়াও খাওয়া যায় বিনা লবণে আতপ চালের ভাত। বুনজারদের ভাষায় এটি ‘খির’। পূজার দিন সকালে সূর্য ওঠার সময় নদীর মধ্যে কোমর পানিতে নেমে সূর্যকে ভোগ দিয়ে প্রার্থনা করা হয়। তাদের বিশ্বাস এই পূজার মাধ্যমে একইসঙ্গে সূর্য ও গঙ্গার আশির্বাদ পাওয়া যায়। সামরি বালার বাড়িতে ঢুকতেই দেখা গেল পূজার স্থান ও দেবতা। সে জানায়, এটি তাদের  দৈনন্দিন দেবতা বিশহরি। প্রতিদিন সন্ধ্যায় দেবতার পূজা দেয় সে। তার বিশ্বাস পূজা না করে পাপ কাজে লিপ্ত থাকলে এক সময় অনেককেই স্বপ্নে ভয়ঙ্কর সাপ দেখতে হবে।  সামরির মতো আদিবাসী বুনজাররা এখনো ‘ভূতে’ বিশ্বাস করে। বাড়িতে কারো পেটের ব্যথা বা বমি হলেই তারা বলতে থাকে ‘ভূতে ধরেছে’। আর এর জন্য ঝাড়ফুঁকই একমাত্র চিকিৎসা।
অন্যান্য আদিবাসী সম্প্রদায়ের মতো  আদিবাসী বুনজারদেরও একসময় ছিল শত শত বিঘা জমি। জমি থাকলেও অধিকাংশ আদিবাসীরা ছিল সহজ সরল। দলের মন্ডল জানায়, ব্রিটিশ আমল থেকে এরা এখানে থাকলেও এদের অধিকাংশ জমি আজ অন্যের দখলে। এখন প্রায় সবাই ভূমিহীন। কিছু জমি নিয়ে চলছে স্থানীয়দের সঙ্গে বিরোধ। আর সে কারণেই প্রায়ই পেতে হয় প্রাণনাশের হুমকি। হরিমহনের বক্তব্য একটু ভিন্ন। সে মনে করে মূর্খতাই আদিবাসীদের জমি বে-দখল হওয়ার অন্যতম কারণ। হরিমহনের ভাষায়, ‘হামনির জমি জোর করে মানসে লেলেল কে, হামনি মূর্খ গতিকে মানসে লেলেল কে’। তাই  দুই ছেলেকেই সে লেখাপড়া শিখাচ্ছে।  বড় কোন স্বপ্নে নয়। তার বিশ্বাস ছেলেমেয়েরা লেখাপড়া শিখলে তাদের জমি আর অন্য কেউ বে-দখল করে নিতে পারবে না, ঠকাতে পারবে না। হরিমহন বলে ‘পড়ালেখা করলে আর ঠোকাল নে পারতে’।
পিপল্লা গ্রামের আদিবাসী বুনজারদের জীবন দেখে যখন ফিরছিলাম তখন বার বার কানে বাজছিল হরিমহনের কথাগুলো। একই দেশে কোন জাতির সন্তানরা লেখাপাড়া করছে জীবনে প্রতিষ্ঠা পেতে আর অন্য জাতির সন্তানরা লেখাপড়া করছে শুধুই ঠকানো থেকে রক্ষা পেতে। স্বপ্নের এই বৈষম্য নিয়েই কি এদেশে বড় হতে থাকবে আদিবাসীর সন্তানরা। তাতে কি মিলবে বৈষম্যহীন সমাজ?

লিখাটা প্রকাশিত হয়েছে সাপ্তাহিকে ১ অক্টোবর ২০০৯ এ

© 2011 – 2018, https:.

এই ওয়েবসাইটটি কপিরাইট আইনে নিবন্ধিত। নিবন্ধন নং: 14864-copr । সাইটটিতে প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো তথ্য, সংবাদ, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করলে আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।

Show More

Salek Khokon

সালেক খোকনের জন্ম ঢাকায়। পৈতৃক ভিটে ঢাকার বাড্ডা থানাধীন বড় বেরাইদে। কিন্তু তাঁর শৈশব ও কৈশোর কেটেছে ঢাকার কাফরুলে। ঢাকা শহরেই বেড়ে ওঠা, শিক্ষা ও কর্মজীবন। ম্যানেজমেন্টে স্নাতকোত্তর। ছোটবেলা থেকেই ঝোঁক সংস্কৃতির প্রতি। নানা সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠনের সঙ্গে জড়িত। যুক্ত ছিলেন বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র ও থিয়েটারের সঙ্গেও। তাঁর রচিত ‘যুদ্ধদিনের গদ্য ও প্রামাণ্য’ গ্রন্থটি ২০১৫ সালে মুক্তিযুদ্ধ ভিত্তিক মৌলিক গবেষণা গ্রন্থ হিসেবে ‘কালি ও কলম’পুরস্কার লাভ করে। মুক্তিযুদ্ধ, আদিবাসী ও ভ্রমণবিষয়ক লেখায় আগ্রহ বেশি। নিয়মিত লিখছেন দেশের প্রথম সারির দৈনিক, সাপ্তাহিক, ব্লগ এবং অনলাইন পত্রিকায়। লেখার পাশাপাশি আলোকচিত্রে নানা ঘটনা তুলে আনতে ‘পাঠশালা’ ও ‘কাউন্টার ফটো’ থেকে সমাপ্ত করেছেন ফটোগ্রাফির বিশেষ কোর্স। স্বপ্ন দেখেন মুক্তিযুদ্ধ, আদিবাসী এবং দেশের কৃষ্টি নিয়ে ভিন্ন ধরনের তথ্য ও গবেষণামূলক কাজ করার। সহধর্মিণী তানিয়া আক্তার মিমি এবং দুই মেয়ে পৃথা প্রণোদনা ও আদিবা।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

Back to top button