বিনোদিনী : ঊনবিংশ শতকের বাংলা মঞ্চের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য অভিনেত্রী
বিনোদিনী ঊনবিংশ শতকের বাংলা মঞ্চের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য অভিনেত্রী । ১৮৬২ সালে কলকাতায় জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর ১২ বছরের স্বল্প অভিনয় জীবনের মধ্যেই তিনি মঞ্চাভিনয়ে বিপুল সাফল্য অর্জন করেন।
তিনি বারবণিতার পরিবেশ থেকে একেবারে ছোট বয়েসে বাংলা মঞ্চে অভিনেত্রী হিসাবে আত্মপ্রকাশ করেন । তাঁর প্রথম অভিনয় ছিল ১২ বছর বয়েসে মাত্র মাসিক দশ টাকা বেতনে গ্রেট ন্যাশন্যাল থিয়েটারে শক্রসংস্থার নাটকে দ্রৌপদীর সখীর ছোট্ট ভূমিকায় । বেঙ্গল থিয়েটারে প্রথম অভিনেত্রী গ্রহণ করা হয় ১৮৭৩ সালে । এর একবছরের মধ্যেই বিনোদিনী সাধারণ রঙ্গালয়ে যোগ দেন । নাচগানে পারদর্শী বিনোদিনী খুব তাড়াতাড়ি অভিনয়ে দক্ষ হয়ে ওঠেন এবং একজন প্রথম শ্রেনীর অভিনেত্রী হিসাবে খ্যাতি লাভ করেন ।১৮৭৪ থেকে একটানা ১২ বছর তিনি অভিনয় করেছিলেন । ১৮৮৬ খ্রীষ্টাব্দের ২৫ ডিসেম্বর তিনি শেষবার অভিনয় করেন । এর আগে পর্যন্ত ৫০টি নাটকে তিনি ৬০টিরও বেশি চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন
পৌরানিক, সামাজিক বা ঐতিহাসিক যেকোন রকমের চরিত্র রূপায়নেই তিনি প্রতিভার পরিচয় দিয়েছিলেন । একই নাটকে তিনি বিভিন্ন চরিত্রে সফলতার সাথে অভিনয় করেন । যেমন মেঘনাদবধের সাতটি চরিত্রে বা দুর্গেশনন্দিনীর দুটি ভিন্নমুখী চরিত্রে (আয়েষা ও তিলোত্তমা) । একই অভিনয় রজনীতে তিনি একাধিক নাটকে বিভিন্ন চরিত্রে অভিনয় করতে পারতেন । যেমন বিষবৃক্ষের কুন্দনন্দিনী এবংসধবার একাদশীর কাঞ্চন, চৈতন্যলীলার চৈতন্য এবং বিবাহ বিভ্রাটে বিলাসিনী কারফরমা, বিল্বমঙ্গলে চিন্তামনি এবং বেল্লিক বাজার এ রঙ্গিনী ।পুরুষ চরিত্রের অভিনয়েও তিনি প্রতিভার পরিচয় দেন । তাঁর অভিনীত পুরুষ চরিত্রগুলির মধ্যে রয়েছে চৈতন্য, প্রহ্লাদ প্রভৃতি । বিনোদিনী করুণরসাত্মক, ভক্তিরসাত্মক, গুরুভাবাপন্ন বা গভীর চরিত্রের রূপায়নে অনায়াস দক্ষ ছিলেন । তিনি হালকা এবং হাস্যরসাত্মক চরিত্রায়নেও নিপুন ছিলেন ।১৮৮৩ সালের দিকে গিরিশ ঘোষ স্টার থিয়েটার গড়ে তুলেছিলেন।কারণ গ্রেট ন্যাশনাল থিয়েটারের মালিক ছিলেন একজন অবাঙ্গালী ব্যবসায়ী প্রতাপচাঁদ জহুরী, যিনি থিয়েটারকে ব্যবসা হিসেবেই দেখতেন। তাই তাঁর অধীনে কাজ করা গিরিশ ঘোষ এবং বিনোদিনী কারও পক্ষেই সহজ ছিল না। থিয়েটার গড়ে তোলার জন্য যে রকম টাকা পয়সা দরকার ছিল , তা গিরিশ ঘোষের ছিল না। একজন ২০-২১ বছরের ব্যবসায়ী গুরমুখ রায় অর্থ সাহায্য প্রদান করেন।থিয়েটারের চেয়ে তার বিনোদিনীর প্রতিই বেশি আকর্ষণ ছিল। গুরমুখ রায় বিনোদিনীকে ৫০ হাজার টাকায় কিনে নিতে চেয়েছিল যাতে সে অভিনয় ছেড়ে দেয়।বিনোদিনী আংশিক রাজী হন সে প্রস্তাবে কারণ তিনি অভিনয় ছাড়তে রাজী ছিলেন না। গুরমুখ রায়ের রক্ষিতা হন বিনোদিনী।এই ঘটনায় তাঁর পূর্ববর্তী মালিক ধনী জমিদার ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠেন এবং তিনি লাঠিয়াল দিয়ে নতুন থিয়েটার ভেঙ্গে দিতে চেষ্টা করেন।সেই ধনী জমিদার তলোয়ার হাতে বিনোদিনীর শোবার ঘরে প্রবেশ করে তাকে খুন করতে উদ্যত হন। কিন্তু বিনোদিনী উপস্থিত বুদ্ধির জোরে সে যাত্রা বেঁচে যান।
সমাজের সকল স্তরের মানুষই তাঁর অভিনয় প্রতিভায় মুগ্ধ হয়েছিলেন । তাঁর প্রশংসক দের তালিকায় ছিলেন রামকৃষ্ণ, বিবেকানন্দ, বন্কিমচন্দ্র, ফাদার লাঁফো, এডুইন আরনল্ড, কর্ণেল অলকট প্রমুখ । রামকৃষ্ণদেব তাঁর চৈতন্যলীলার অভিনয় দেখে তাঁকে গ্রীনরুমে গিয়ে চৈতন্য হোক বলে আশীর্বাদ করেছিলেন । বঙ্কিমচন্দ্র তাঁর উপন্যাসের চরিত্রগুলিকে বিনোদিনীর মধ্যে দিয়ে সফলভাবে গড়ে উঠতে দেখেছিলেন । তাঁর অভিনয়ের গুরু গিরিশচন্দ্র ঘোষ তাঁর বহু প্রশংসা করেছিলেন । গিরিশচন্দ্রের ‘কি করিয়া বড় অভিনেত্রী হইতে হয়’ শীর্ষক প্রবন্ধের আলোচনায় বিনোদিনীর জীবনচর্চাকে আদর্শ হিসাবে গ্রহণ করেছিলেন । তৎকালীন সংবাদপত্রগুলি বিনোদিনীকে ফ্লাওয়ার অফ দি নেটিভ স্টেজ, মুন অফ স্টার কোম্পানী, প্রাইমাডোনা অফ দি বেঙ্গলী স্টেজ আখ্যা দিয়েছিল ।
বিনোদিনী ধনী যুবক গুর্মূখ রায়ের ৫০০০০ টাকার প্রলোভন ত্যাগ করেন । বরং বাংলা থিয়েটারের উন্নতির জন্য তিনি নতুন থিয়েটার খুলতে রাজি হন এবং গুর্মুখ রায়ের রক্ষিতা হতেও রাজি হন । বিনোদিনীর ইচ্ছা ছিল যে নতুন থিয়েটার তৈরি হবে তা বিনোদিনীর নামে বি-থিয়েটার হবে । কিন্তু কিছু মানুষের প্রতারনার শিকার তিনি হন । যাঁদের মধ্যে তাঁর নিজের অভিনয় গুরু গিরিশচন্দ্রও ছিলেন । বিনোদিনীর ত্যাগ স্বীকারে যে নতুন থিয়েটার তৈরি হয় বিনোদিনীর নাম তাতে থাকেনি । এই নতুন থিয়েটারের নাম হয় স্টার থিয়েটার । এই বিশ্বাসঘাতকতায় যখন বিনোদিনী দুঃখে বেদনায় কাতর তখনই রামকৃষ্ণদেব তাঁর চৈতন্যলীলা নাটক দেখতে এসে তাঁকে আশীর্বাদ করেন । এর দুবছর পরেই ১৮৮৬ খ্রীষ্টাব্দে মাত্র ২২-২৩ বছর বয়েসে তিনি রঙ্গমঞ্চ ত্যাগ করে যান । তারপর দীর্ঘদিন জীবিত থাকলেও কখনও অভিনয়ে ফিরে আসেননি । ফলে বাংলা থিয়েটার বঞ্চিত হয় এক অসামান্য অভিনেত্রীর প্রতিভা এবং অভিনয় থেকে ।
বিনোদিনী মহিলাদের অভিনয়কে বাঙ্গালী দর্শকদের কাছে গ্রহণযোগ্য করতে ঐতিহাসিক ভূমিকা পালন করেন।বিশ শতকের গোড়ায় যখন গ্রামোফোন চালু হয়, তখন বিনোদিনী গান শুরু করেন।তাঁর গানের গলা ছিল উঁচুমানের।জীবনে তিনি মোট তিনজন ধনীর রক্ষিতা ছিলেন। এর মধ্যে শেষ ব্যাক্তির সাথে তিনি ছিলেন ৩১ বছর। তিনি বিনোদিনীর জন্য বাড়িসহ কিছু সম্পত্তি রেখে যান।তাই স্বচ্ছলতা মধ্য দিয়েই তিনি ১৯৪১ সালে মৃত্যু বরণ করেন। বিনোদিনী লিখেছেন তাঁর আত্মজীবনী আমার কথা, কবিতা গ্রন্থ বাসনা এবং কনক ।
তথ্য ও ছবি : সংগৃহীত
© 2011 – 2018, https:.