পূজা পার্বণে কড়া আদিবাসী
কার্তিকের দুপুর। আজ রোদ উঠেছে পুরোমাত্রায়। এর মধ্যেই রওনা দিতে হলো ঝিনাইকুড়ির দিকে। কিছুদিন আগেও ঘামে গোসল দেয়া লোকসকলকে দেখা যেত গাছের ছায়ায়। রাস্তার পাশে বড় বড় গাছের নিচে এখন আর তেমন লোকদের আনাগোনা চোখে পড়ে না। নিজের চোখেমুখেও টানটান আর খসখসে অনুভূতি টের পাই। বুঝে নেই এটি বদলের রীতি। ঋতু পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে এভাবেই বদলে যেতে থাকে গ্রামের পরিবেশ আর লোকজনের চলাফেরা ও গ্রাম্য আচারগুলো। এই বদলানোর কথা কাউকে বলে দিতে হয় না।
এই গ্রামটির চেহারাও বদলে গেছে। কিছুদিন আগেও চারপাশ ঢাকা ছিল ধানক্ষেতের সবুজ কার্পেটে। ক্রমেই তা রঙ বদলে হয়ে যাচ্ছে গাঢ় বাদামি থেকে সোনালি। একই সঙ্গে বদলে যাচ্ছে কৃষকদের গোমরা মুখগুলো। হাসির রেখা ফুটে উঠেছে মলিন মুখগুলোতে। আর কয়েকদিন পরই অগ্রহায়ণ। সে সময়ে নবান্ন উৎসবে মেতে ওঠে বাংলার গ্রামগুলো।
পাকা ধানগুলোর দিকে তাকিয়ে থাকতেই মনে পড়ে এক সম্রাটের কথা। তিনি সম্রাট আকবর। বঙ্গাব্দ বা বাংলা মাসের প্রবর্তক। মনে পড়ে নক্ষত্রের নামে নামকরণ হওয়া বাংলা মাসের নামগুলো। পুষ্যা নক্ষত্র থেকে পৌষ, মঘান থেকে মাঘ, ফল্গুনী থেকে ফাল্গুন, চিত্রা থেকে চৈত্র, বিশাখা থেকে বৈশাখ, জ্যেষ্ঠা থেকে জ্যৈষ্ঠ, আষারা থেকে আষাঢ়, শ্রাবণা থেকে শ্রাবণ, ভ্রাদ্রা থেকে ভাদ্র, অশ্বিনী থেকে আশ্বিন, কৃত্তিকা থেকে কার্তিক। কিন্ত অগ্রহায়ণ হলো না নক্ষত্রের নামে।‘অগ্র’ অর্থ প্রথম আর ‘হায়ণ’ মানে বৎসর। এক সময় অগ্রহায়ণ থেকেই বছর শুরু হতো। হঠ্যাৎ মোটরসাইকেলের ঝাঁকুনিতে সম্রাট আকবরকে ভুলে কোনো রকমে সামলে নিলাম নিজেকে। আমরা পৌঁছে গেছি গ্রামটিতে। গ্রামের সবাই এ সভ্যতার প্রথম দিক্কার মানুষের জাতি। এরা আদিবাসী। এখানের আদিবাসীরা নিঃশব্দে অবলুপ্ত হচ্ছে এ দেশ থেকে। ক্রমেই আমরা হারিয়ে ফেলছি ‘কড়া’ নামক একটি জাতি, একটি সভ্যতা আর একটি সংস্কৃতিকে।
গ্রামে ঢুকতেই ছেলেমেয়েদের জটলার মুখোমুখি হলাম। ভিড় ঠেলে কাছে যেতেই দেখা মিলল কৃষ্ণ কড়ার। গোত্রের একমাত্র শিক্ষিত যুবক সে। কতটুকু লেখাপড়া প্রশ্ন করতেই জবাব মেলে, ‘মেট্রিক ফেল’। এর বদৌলতেই একটি ভাঙ্গা রেডিওকে কোনো রকমে চালানোর চেষ্টা করছে সে। কখনো বাংলা, কখনো ইন্ডিয়ান গান বাজছিল রেডিওটিতে। আবার মাঝে মধ্যেই নীরবে হারিয়ে যাচ্ছিল সব সুর। অবাক হয়ে কৃষ্ণের কেরামতিই দেখছিল সকলে ।
‘কড়া’ শব্দের অর্থ জানতে চাইলে জটলার মধ্যে কোনো উত্তর মেলে না। নীরবতা ভেঙ্গে মুখ খোলেন ৬৫ বছর বয়স্ক সাতান কড়া। ‘মাটি খোঁড়া’ থেকে কড়া শব্দটি এসেছে। এ সম্প্রদায়ের লোকেরা তাদের পূর্বপুরুষদের আমল থেকে দীঘি খোঁড়ার মতো কাজের সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিল। সাতান জানায়, কড়ারা এসেছে ভারতের দুমকা থেকে। রেললাইনের রাস্তা তৈরিতে মাটির কাজ করতেই এদেশে এ সম্প্রদায়ের আগমন। অন্যান্য আদিবাসী সম্প্রদায়ের মতো কড়ারাও গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে বেটকি ডেকে (সভা করে) ভোটাভুটির মাধ্যমে গঠন করে ৩ সদস্যের পরিষদ। মাহাতো, গড়াৎ ও পারামানি ছাড়াও কড়া সম্প্রদায়ের কয়েকটি গ্রামের একজন প্রধান থাকে। কড়া ভাষায় তাঁকে বলা হয় ‘পাঁরে’।
ভিড় পেরিয়ে গ্রামের একেবারে শেষ প্রান্তে গোত্রের মাহাতো জগেন কড়ার বাড়ি। এক সময় কয়েকশ একর জমি থাকলেও বর্তমানে তার নিজস্ব জমি মাত্র ৪ শতক। কয়েক দিন পরেই সে জমির ধান কাটা হবে। তাই পরিকল্পনা চলছে ধান কাটা অনুষ্ঠানের। কড়া ভাষায় এটি ‘লবান’। জগেন জানায়, প্রতিবছর অগ্রহায়ণ মাসে প্রত্যেক পরিবারকে পৃথক পৃথকভাবে পালন করতে হয় ‘লবান’ অনুষ্ঠান। জানা যায় কড়াদের লবানের আনুষ্ঠানিকতাগুলো। বাড়ি থেকে যে আরোয়া ধান (নতুন ধান) কাটতে যাবে সে উপোস অবস্থায় ক্ষেত থেকে কেটে আনে এক গোছা পাকা ধানের আগাল। মাথায় করে ধানের গোছা নিয়ে বাড়িতে ঢোকার পূর্বে বাড়ির মহিলারা তাকে প্রণাম করে উলু ধ্বনি দিয়ে তার পা ধুইয়ে দেয়। অতঃপর দূর্বা ঘাস, প্রদীপ আর ধূপ জ্বালিয়ে বরণ করে মাথার ধান উঠানে নামিয়ে রাখে। এদের বিশ্বাস এভাবে ফসলরূপী দেবী লক্ষ্মীকে বরণ করা হয়। এরপর ধান থেকে চাল বের করে, ধূপ ও প্রদীপ জ্বালিয়ে বাড়ির তুলসী দেবতাকে ভক্তি করে সেখানে একটি মুরগি বলি দেয়া হয়। কড়া ভাষায় একে ‘পিড়া ঘার’ বলে। এরপর বলি দেয়া মুরগির মাংসের সঙ্গে নতুন চাল দিয়ে খিচুড়ি রান্না করে উপোসকারীর উপোস ভাঙে এরা। এ ছাড়াও কিছু চাল বেটে গোটা বাড়িতে ছিটিয়ে দিতে হয়। এদের বিশ্বাস এতে সারা বছরই খাদ্যের অভাব হবে না। লবানের সময় এরা একে অপরকে বলতে থাকে, ‘হামনি ঘার আইজ লবান’।
কড়াদের ধর্ম কি। কিনা কড়া জানায় তাদের ধর্ম কারমা। কোনো দেবদেবীর পূজা না করলেও নিজেদের কর্মভাগ্যের জন্য এরা ভাদ্র মাসে ‘কারমা পূজা’ করে ধুমধামের সঙ্গে। বিশেষ প্রজাতির খিল কদম গাছের ডাল কেটে এনে পূজা করে এরা। প্রথানুসারে গোত্রের বিবাহিতরা এ গাছের ডাল কাটতে পারে না। তাই অবিবাহিত কোনো যুবককে কয়েক বছরের জন্য ডাল কাটা ও বিসর্জন দেয়ার জন্য মাহাতো মনোনীত করে দেন। ডাল কাটার দিন নদীতে স্নান করে গাছের গোড়ায় ধূপ জ্বালিয়ে, সিঁদুর দিয়ে ৩টি তেলের পিঠা গাছের সঙ্গে বেধে দেয়া হয়। অতঃপর ৩ চটে (৩ কোপে) ডাল কাটাতে হয়। ডালটি মাটিতে পড়ার পূর্বেই সেটি ঘাড়ে করে নিয়ে যাওয়া হয় পূজাস্থলে। সেখানে গোত্রের সবাই ঢাক-ঢোল বাজিয়ে ডালটিকে মাটিতে গেড়ে দেয়। একই সঙ্গে দুটি লাল মুরগা (মোরগ) বলি দিয়েই শুরু করা হয় কারমা পূজার আনুষ্ঠানিকতা। সারা রাত চলে নাচ, গান আর হাড়িয়া খাওয়া।ভোর বেলা দলের মাহাতো স্নান করে ভেজা শরীরেই প্রথমে এক বাটি দুধ ঢেলে দেয় খিল কদম গাছের ডালের মাথায়। অতঃপর তাকে ভক্তি করে ফিরে যায় নিজ বাড়িতে। এর পর পরই গোত্রের সবাই একে একে ডালটির মাথায় দুধ ঢালতে থাকে। দুধ ঢালা শেষে যে ব্যক্তি ডাল কেটেছিল সে প্রথমেই ডালটির চারদিকে ৩ পাক ঘুরে ডালটিকে কাঁধে তুলে নিয়ে বিসর্জন দেয় নিকটবর্তী নদী বা পুকুরে।
কারমা পূজা ছাড়াও কড়া সম্প্রদায়ের আদিবাসীরা পালন করে ভিন্ন রকমের বিশহরি পূজা। কৃষ্ণ জানায় তারা বিশ্বাস করে এ পূজায় তাদের অভাব ও কষ্টের কথা শুনতে তাদের ওপরই ভর করে নেমে আসে ৬টি ভূত (দেবতা)। গোত্রের মাহাতো পূজার নিয়মসহ হর্ হর করে বলতে থাকে ভূতগুলোর নাম। গাঁও রাখ ওয়াল, দানব, বিশহরি, চকর গুরু, কামরুক গুরু, বাংশিং গুরু। এ পূজায় মাটি দিয়ে উঠানে ৪ আঙ্গুল উঁচু ডিবি তৈরি করে সেখানে ধূপ জ্বালিয়ে, সিঁদুর দিয়ে কবুতর বলি দেয়া হয়। ভূত বা দেবতাকে শান্ত করার জন্য রাখা হয় বিশেষ ধরনের গাছের চাবুক। অতঃপর ভক্তি করে এরা মাদল বাজিয়ে নাচতে নাচতে দেবতাদের ডাকতে থাকে। এরা বিশ্বাস করে এতে গোত্রের তুলা রাশির ব্যক্তিদের ওপর দেবতা ভর করে। কখনো কখনো দেবতা আসতে দেরি হলে পুতা (মসলা বাটার)-এর পাথরে ধূপের ধোঁয়া দিয়ে তার ওপর তুলা রাশির লোক দাঁড় করালেই দ্রুত দেবতারা চলে আসে। দেবতাদের প্রথমে চাবুক দিয়ে শান্ত করে বলা হয় ‘মাহারাজ তয় শান্ত হওয়া’। দেবতারা শান্ত হলে গোত্রের সকলেই নানা রোগ, শোক ও সমস্যার কথা তাকে জানায় এবং সমাধানের মিনতি করে।
মাহাতোর শেষেই সুনিয়া শুরু করে আরেকটি পূজার কথা। গবাদিপশুর মঙ্গলের জন্য কড়া সম্প্রদায়ের আদিবাসীরা পালন করে বিশেষ ধরনের পূজা । কড়া ভাষায় এটি ‘গট পূজা’। এ পূজায় কাদা মাটির ওপর ডিম রেখে, সেখানে সিঁদুর দিয়ে, ধান আর দূর্বা ঘাস দিয়ে ঢেকে দেয়া হয়। অতঃপর তার ওপর দিয়ে গোত্রের সকলের গরু নিয়ে যাওয়া হয়। যার গরুর পায়ে লেগে ডিমটি ভেঙ্গে যাবে তাকে সকলে ঘাড়ে চড়িয়ে হৈ হুল্লড় করে তার বাড়িতে নিয়ে আসে। তখন সবাইকে অন্যান্য খাবারের সঙ্গে খাওয়ানো হয় হাড়িয়া। ঐদিন সূর্য ডোবার আগে ঐ ব্যক্তি তার গোয়াল ঘরটি পরিষ্কার করে সেখানে একটি পিঁড়ি রেখে তার চারপাশে গোল করে ঢেলে দেয় চালেরগুঁড়ার আটা। অতঃপর পিঁড়ির ওপর ধান, দূর্বা ঘাস আর সিঁদুর দিয়ে ভক্তি করা হয়।
দুই একজন ছাড়া এখানকার কড়া সম্প্রদায়ের আদিবাসীরা এখন আর লবান পালন করে না। কেননা অধিকাংশ আজ বর্গা চাষী। এক সময় এদের শত শত বিঘা জমি ছিল যার অধিকাংশই চলে গেছে স্থানীয় ভূমিদস্যুদের দখলে। ফলে জমির সঙ্গে সঙ্গেই হারিয়ে যাচ্ছে একটি জাতির একটি উৎসব। একইভাবে প্রতিবছর কারমা পূজা পালন করলেও আদিবাসী কড়াদের কর্ম ভাগ্য সুপ্রসন্ন হয়নি অদ্যাবধি। বরং অর্থের অভাবে পূজার উৎসবগুলোও চলছে কোনো রকমে। কারমা পূজার কাহিনীর করমা ধরমার মতোই কপাল পুড়ে আছে এখানকার আদিবাসীদের। তবুও বুক ভরা আশা নিয়ে প্রতিনিয়ত ভাগ্য জয়ের চেষ্টা চালাচ্ছে কড়া সম্প্রদায়ের আদিবাসীরা।
লিখাটি প্রকাশিত হয়েছে সাপ্তাহিকে ২২ এপ্রিল ২০১০ এ
© 2011 – 2018, https:.