কাঙাল হরিনাথ: গ্রামীণ সাংবাদিকতার পথিকৃত
গ্রামীণ সাংবাদিকতার পথিকৃত কাঙাল হরিনাথ মজুমদার।হরিনাথ মজুমদারের জন্ম ১৮৩৩ সালে। তাঁর স্বপ্নের সব নাড়ি কুষ্টিয়ার কুমারখালীর কুণ্ডুপাড়ার মাটিতে পোঁতা। স্মৃতি বলতে অবশিষ্ট রয়েছে ঐতিহাসিক ছাপার যন্ত্র, এমএন প্রেস, হাত মেশিন, বাংলা টাইপ ও হরিনাথের কিছু পাণ্ডুলিপি। তাঁর বাড়ির ঐতিহাসিক বাড়িটি আজ ভঙ্গুরপ্রায়। বাড়ির এক কোণে পড়ে আছে সেই প্রেস, যাতে রয়েছে কাঙাল হরিনাথ, লালন, মীর মশাররফ ও জলধর সেনের হাতের স্পর্শ।
ঊনবিংশ শতকের নির্ভীক সাংবাদিক ছিলেন কাঙাল হরিনাথ। তিনি কুষ্টিয়ার প্রথম সংবাদপত্র ‘গ্রামবার্ত্তা প্রকাশিকা’র সম্পাদক ছিলেন।‘বাংলা মুদ্রণ যন্ত্র’ নামের যে যন্ত্রটিতে তিনি ১৮৭৩ সালে গ্রামবার্ত্তা ছাপিয়ে ছিলেন, সেটি দর্শনার্থীদের জন্য এখনও তাঁর বাড়িতে রাখা আছে।
অল্প বয়সেই তিনি পিতা-মাতাকে হারিয়েছিলেন। স্থানীয় ইংরেজি স্কুলে শুরু হয় তার পড়ালেখা। তবে অনাথ হয়ে পড়ায় আর্থিক দুর্গতিতে লেখাপড়া বেশিদূর এগোয় না। তিনি একইসাথে বিদ্যানুরাগ ও সমাজ-সচেতনত ছিলেন। নিজ গ্রামে তিনি বন্ধুবান্ধবের সহায়তায় একটি ভার্নাকুলার স্কুল খুলেছিলেন ১৮৫৫ সালে। সেখানেই অবৈতনিক শিক্ষকতা শুরু করেছিলেন। পরের বছর তিনি কুমারখালীতে একটি বালিকা বিদ্যালয় স্থাপন করেন। ১৮৫৮ সালে এই বালিকা বিদ্যালয়ের নতুন ভবনের দ্বারোদ্ঘাটন করেছিলেন স্বয়ং ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর।
এ দেশে নারীদের শিক্ষার প্রসারেও হরিনাথের ভূমিকা উল্লেখযোগ্য।
স্থানীয় জমিদার ও ইংরেজদের অত্যারচারের বিরুদ্ধে তিনি ঈশ্বরগুপ্তের সংবাদ প্রভাকর পত্রিকায় লেখালেখি শুরু করেন। সেই তার সাংবাদিকতার শুরু। পরে ১৮৬৩ সালে নিজেই প্রকাশ করেন গ্রামবার্ত্তা প্রকাশিকা নামের মাসিক পত্রিকা। পরে এটি পাক্ষিক ও সাপ্তাহিক হিসেবে প্রকাশিত হয়। গ্রামবার্ত্তা প্রথমে প্রকাশিত হতো কলকাতার গীরিশ বিদ্যারত্ন প্রেস থেকে।
বাংলা পিডিয়ার তথ্যানুসারে, ১৮৬৪ সালে কুমারখালীতে স্থাপিত হয় মথুরনাথ যন্ত্র। বিখ্যাত ঐতিহাসিক অক্ষয় কুমার মৈত্রের পিতা হরিনাথের বন্ধু মথুরনাথ মৈত্র এটি প্রতিষ্ঠা করেন। পরে তিনি মুদ্রণযন্ত্রটি হরিনাথকে দান করেন। ১৮৭৩ সাল থেকে এই যন্ত্রেই গ্রামবার্ত্তা প্রকাশিত হতে থাকে। ২৫ বছর ধরে পত্রিকাটি নিয়মিত প্রকাশিত হয়েছিল।কাঙাল হরিনাথ মজুমদারের কোনোদিন কোনো বিদ্যালয়ে পড়াশোনা শেখা হয়নি। পারিবারিক দৈন্যের কারণে বালক বয়সে কুমারখালী বাজারের এক কাপড়ের দোকানে কাঙাল হরিনাথ কাজ নিতে বাধ্য হন দৈনিক দুই পয়সা বেতনে। এরপর ৫১টি কুঠির হেড অফিস কুমারখালীর নীলকুঠিতে শিক্ষানবিস হিসেবে যোগ দেন। কিন্তু মানবদরদি ও সত্যনিষ্ঠ হরিনাথের পক্ষে সেখানেও বেশিদিন কাজ করা সম্ভব হয়নি। নীলকুঠিরে স্বল্পকালীন কর্মজীবনে হরিনাথ রায়ত-প্রজার ওপর কুঠিয়ালদের অত্যাচার ও শোষণের স্বরূপ নিজ চোখে দেখেন। ধারণা করা হয় এই শোষণের প্রতিকারের চিন্তা থেকেই পরে হরিনাথ মজুমদার ‘গ্রামবার্ত্তা প্রকাশিকা’ সম্পাদনা করেন। গণসংগীত শিল্পী কমরেড হেমাঙ্গ বিশ্বাস তার এক লেখায় উল্লেখ করেন, ‘রবীন্দ্রনাথের আগে ঠাকুর পরিবারের যেসব সদস্য জমিদার হিসেবে শিলাইদহে এসেছিলেন, তারা প্রজাবত্সল ছিলেন না। তাদের অত্যাচারের কথা হরিনাথ গ্রামবার্ত্তা প্রকাশিকায় সাহসের সঙ্গে লিখতেন। দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর তার প্রিয় বন্ধু কাঙালকে শায়েস্তা করতে পাঞ্জাবি লাঠিয়ালদের কলকাতা জাঁকিয়ে দিয়েছিলেন।
গ্রামবার্ত্তা পত্রিকায় হরিনাথ সাহিত্য, দর্শন বিজ্ঞানসহ বিভিন্ন বিষয়ে প্রবন্ধ প্রকাশের পাশাপাশি অত্যন্ত সাহসিকতার সঙ্গে জমিদার ও ব্রিটিশ নীলকরদের অত্যাচারের কাহিনী প্রকাশ করেন। একটা পর্যায়ে জমিদারেরা তার ওপর হামলার পরিকল্পনা করেন। তখন লালন সাঁই অনুসারীদের নিয়ে হরিনাথের বাড়িতে এসে পাহারা দিয়ে তাকে রক্ষা করেন।
ফকির লালন সাঁইয়ের সঙ্গে হরিনাথের অত্যন্ত ঘনিষ্ঠতা ছিল। এ ছাড়া বিষাদ সিন্ধু ও জমিদার দর্পণ-এর রচয়িতা মীর মশাররফ হোসেন, প্রখ্যাত সাহিত্যিক-সাংবাদিক জলধর সেন, অক্ষয় কুমার মৈত্র, দীনেন্দ্র কুমার রায়রা ছিলেন তার শিষ্যতুল্য এবং গ্রামবার্তার লেখক। হরিনাথ নিজেও ছিলেন আধ্যাত্মিক সাধক। ‘কাঙাল ফকির চাঁদ বাউল’ নামেও তিনি পরিচিত ছিলেন। বহু গান লিখেছেন। প্রকাশিত গ্রন্থ ১৮টি। এর মধ্যে ‘বিজয় বসন্ত’ নামের উপন্যাসটি অত্যন্ত জনপ্রিয় হয়েছিল। এর ২০টি সংস্করণ প্রকাশিত হয়েছিল তার জীবদ্দশাতেই।
পূর্বপুরুষের আর্থিক দৈন্য কাটিয়ে উঠতে পারেননি অশোক মজুমদার। তিনি জানালেন, ১৯৭১ সালে প্রেসঘরটির ওপরে পাকিস্তানি হানাদারেরা বোমা ফেলেছিল। যন্ত্রটি রক্ষা পেলেও ঘরের ছাদ দেয়াল ভেঙে যায়। মেরামত করার সামর্থ্য নেই। এখানেই মাথা গুঁজে আছেন স্ত্রী-পুত্র নিয়ে। ‘ডবল ক্রাউন’ সাইজের কাগজে এই মুদ্রণযন্ত্রটিতে সারা দিনে প্রায় এক হাজারটি ছাপ দেওয়া যায়। ‘যে যন্ত্রে কাঙালের হাতের স্পর্শ, লালনের হাতের স্পর্শ, মীর মশাররফ, জলধর সেনের হাতের স্পর্শ, সেখানে আমি হাত রাখতি পারছি, এর চেয়ে সৌভাগ্য আর কি আছে’, বলছিলেন অশোক। সে কারণেই যন্ত্রটি বুক দিয়ে আগলে রেখেছেন।
‘কাঙাল’ বলেই সবার কাছে পরিচিত হরিনাথ মজুমদার। নিজে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষালাভ করতে পারেননি বলে লোক শিক্ষার প্রতি হরিনাথের বিশেষ আগ্রহ ছিল। কলকাতার বাইরে দূরে মফস্বলে সংস্কৃতিচর্চার একটি অনুকূল আবহাওয়া রচনা করতে পেরেছিলেন তিনি। কিন্তু উপার্জনের নির্দিষ্ট উত্স না থাকায় আর গ্রামবার্তা প্রকাশিকা প্রকাশের জন্য চরম ঋণগ্রস্ত হয়ে পড়ায় আক্ষরিক অর্থেই তিনি প্রায় কাঙাল হয়ে পড়েন। তারপরও কৃষক-প্রজা, রায়ত শ্রমজীবী মানুষ ও মধ্যবিত্ত শ্রেণীর স্বার্থের অনুকূলে নানা প্রতিকূলতা সত্ত্বেও মাসিক, পাক্ষিক ও সাপ্তাহিক হিসেবে গ্রামবার্তা প্রকাশিকা বিভিন্ন পর্যায়ে প্রায় ২৫ বছর চলেছিল।১৮৯৬ সালে তিনি মৃত্যুবরণ করেন।
ছবি ও তথ্য : সংগৃহীত
© 2011 – 2018, https:.
এই লেখায় ১৯৭১ সালে প্রেসের উপর বোমা ফেলার যে তথ্য দেয়া হয়েছে সেটা সঠিক নয়।
আপনাকে ধন্যবাদ। তবে তথ্যটি দৈনিক সকালের খবরে প্রকাশিত সাংবাদিক ও আইনজীবী সিরাজ প্রামাণিক এর একটি লিখা থেকে সংগৃহীত।
nice articles …
thanks.