জীবনকথা

চা – এ যেন অমৃতের স্বাদ

শুনেছি পঞ্চগড়ে কাজী সাহেব সীমান্ত ঘেঁষে তৈরি করেছেন চায়ের বাগান। এক সময় সিলেট ছাড়া চা বাগানের কথা চিন্তাই করা যেত না। এখন দূর-দূরান্ত থেকে বহুজন তেঁতুলিয়ায় বেড়াতে যান ‘কাজী টি’ দেখতে। দার্জিলিংয়ের পাহাড়ও দেখা যায় সেখান থেকে। তাই গোটা উত্তরবঙ্গের মানুষের মুখে মুখে পঞ্চগড়ের চা বাগানের গল্প। দিনাজপুর থেকে পঞ্চগড়ের দূরত্ব একশ কিলোমিটার। দূরত্ব বেশি ও সময়সাপেক্ষ হওয়ায় চা বাগান দেখার চিন্তা করাই বৃথা। চা বাগান না হোক কোনো প্রশান্তিময় জায়গায় বসে চা তো খাওয়া যাবে, সে আশাতেই বের হয়ে পড়া।
দিনাজপুর জেলা শহরের কোলাহলকে পেছনে ফেলে চলে এলাম বালুয়াডাংগায়। আমরা একটি বড় ব্রিজের ওপর এসে থামলাম। এটি পুনর্ভবা নদীর ওপর নির্মিত কাঞ্চন ব্রিজ। নদীর মতো প্রশান্তিময় স্থানে আসতে পেরে আনন্দিত হই আমি ও সঙ্গী পুলক। কিন্তু ব্রিজের নিচে তাকাতেই মনের ভেতরটা হু হু করে উঠল। পানির অভাবে নদীর অধিকাংশ অংশই শুকিয়ে গেছে। সেখানে চলছে স্থানীয় যুবকদের ক্রিকেট খেলা। ব্রিজ থেকে বহুলোক ক্রিকেট খেলা দেখছে। স্থানীয় এক বৃদ্ধ জানালেন, ভারত থেকে পানি না আসায় কয়েক বছর ধরে শুকিয়ে পুনর্ভবার এই দশা হয়েছে। অথচ একসময় সারা বছর এই নদীতে কানায় কানায় পানি থাকত।
মরা নদী দেখার কষ্ট না বাড়িয়ে চলে এলাম ব্রিজ থেকে। এবার চা খাওয়ার পালা। পুলক খুব ভালো চা খাওয়ানোর কথা জানাল। আমরা চললাম শহরের পূর্বদিকের শেষ প্রান্তে হাইওয়ে সড়ক দিয়ে শেরশাহ রোড বা বটতলীর দিকে। তখন বিকেল ৬টা। বটতলীর কাছাকাছি পৌঁছতেই রাস্তার পাশে একটি ভাঙাচোরা ছাপরা ঘরকে ঘিরে বেশ কিছু মোটরসাইকেলের জটলা চোখে পড়ল। আমরাও থামলাম জটলায় এসে। ছাপরাটি নাশতা খাওয়ার ছোট হোটেলবিশেষ। হোটেলের নামের বিশেষ কোনো সাইনবোর্ড চোখে পড়ল না। ভেতরে কাঠের কয়েকটি সাধারণ বেঞ্চই বসার একমাত্র জায়গা। কোনো আধুনিকতার ছোঁয়া নেই এ হোটেলে। ঢোকার মুখে বড় একটি পাত্রে ছানার রসগোল্লা চোখে পড়ল। বেশ কয়েকজন ছোলা ও পুরি খাওয়ায় ব্যস্ত। লক্ষ্য করলাম, হোটেলের ভেতর ও বাইরে সবাই ছোট গ্লাসে বেশ আয়েস করে চা খাচ্ছে। চা এলো কোত্থেকে? সাধারণত হোটেলের পেছনে রান্নাঘর থাকলেও এখানে তা খুঁজে পাওয়া গেল না। কৌতূহল বেড়ে গেল। গ্লাসের টুং টাং শব্দের দিকে চোখ পড়ল। হোটেলের সামনের বাড়তি অংশে একটি উঁচু জায়গায় লোকজনের কোলাহল ও কাচের গ্লাসের শব্দ। কাছে যেতেই দেখলাম সারি সারি  গ্লাসে মনোযোগের সঙ্গে চা বানাচ্ছে এক ব্যক্তি। এই হোটেলে মিষ্টি বা নাশতার ব্যবস্থা থাকলেও ক্রেতাদের কাছে প্রাধান্য পায়  চা।
আমরা অপেক্ষা করছি চায়ের জন্য। মালেকের দোকানের চায়ের জন্য অপেক্ষা করাই রেওয়াজ। শুনেছি অনেক সময় বিতরণের শৃঙ্খলা ঠিক রাখতে অর্ডারের সঙ্গে সঙ্গেই টোকেন বিতরণ করা হয়ে থাকে। আগ্রহ নিয়ে দেখছিলাম সবকিছু। যে ছেলেটি চা বানাচ্ছিল ক্লান্তি কাটাতে সে বের হলো দোকান থেকে। তার জায়গায় এলো আরেকজন। দুধের মধ্যে শৈল্পিক কায়দায় কিছুটা ওপর থেকে চায়ের লিকার ঢেলে  দুই হাতে ঘুটনি দিয়ে নেড়ে পরিবেশন করছে চা। এই ছেলেটিকেও ক্রেতারা মালেক নামে ডাকছিল। মনে খটকা লাগল, তাহলে আসল মালেক কে? খোঁজ করে বেশ কিছুক্ষণ পর আসল মালেকের দেখা পাওয়া গেল। মুখে দাড়ি কিন্তু যুবক বয়সী। চোখেমুখে হাসিমাখা উদ্যম। বুঝে গেলাম, এখানে আসা লোকেরা চায়ের জন্য এতই ব্যাকুল থাকে যে, ব্যক্তি মালেককে চেনার সময় তাদের নেই। চায়ের সঙ্গে মালেক নামটি স্থানীয়দের মনে এমনভাবে জায়গা করে নিয়েছে যে, এখন দোকানে যেই চা বানায় চায়ের জন্য ব্যাকুল ক্রেতারা তাকেই ‘মালেক’ নামে ডাকে।খানিক পরেই আমার হাতে চা ভর্তি একটি গ্লাস চলে এলো। চুমুক দিতেই টের পাই চা নয়, যেন অমৃত। ঘন দুধের চায়ের মধ্যে মালাই দেয়াতে সত্যিই অমৃতের মতো লাগছিল। বুঝে গেলাম, শহরের একপ্রান্তে হলেও কেন এখানে চা খাওয়ার এত ধুম! দিনাজপুরের নদী দেখে কেউ হতাশ হলেও মালেকের দোকানের চা তাকে হতাশ করবে না। চা খেতে খেতে কথা বললাম মাঝ বয়সী সেকান্দারের সঙ্গে। তিনি থাকেন শহরের ভেতর। পনেরো টাকা রিকশা ভাড়া দিয়ে মাঝেমধ্যেই এখানে আসেন শুধু চা খেতে। তার প্রিয় ‘বিনা পানির চা’। স্থানীয় ব্যবসায়ী সাইদুরের পছন্দ ‘মালাইয়ের চা’। আর আমাদের পুলক বাবুর পছন্দ ‘সাধারণ দুধ বা লাল চা।’
একটি মাইক্রোবাসে বসে সপরিবারে মালাইয়ের চা খাচ্ছিলেন পঞ্চাশোর্ধ্ব এক ভদ্রলোক। নাম আব্দুল হালিম। তিনি উচ্চপদস্থ সরকারি কর্মকর্তা। পরিবার নিয়ে এসেছেন ঢাকা থেকে। কান্তিনগর মন্দির ও রামসাগর দেখে লোকমুখে শুনে এসেছেন মালেকের দোকানের চা খেতে। কেমন লাগল জিজ্ঞেস করতেই বললেন, ‘চমৎকার’। হালিম সাহেব মনে করেন, মালেকের মতো যুবকেরা পরিশ্রম ও সততাকে পুঁজি করে নিজের কর্মসংস্থান তৈরি করছে বলেই এ দেশ টিকে আছে। তার ধারণা, মালেকের হাতে অন্য রকম গুণ আছে। তা না হলে এমন চা বানানো সম্ভব নয়।
সবাই মালেকের দোকান হিসেবে চিনলেও নিয়মিত চা খেতে আসা লতিফ জানাল, চায়ের দোকানসহ হোটেলটির নাম ‘মোল্লার হোটেল’। মালেকের বড় ভাই জব্বারই এর প্রধান। দশ ভাইবোনের কষ্টের সংসারকে বাঁচিয়ে রাখতে জব্বারকে জীবনের অধিকাংশ সময় কাটাতে হয়েছে অন্যের হোটেলে কাজ করে। এক সময় নিজেই কিছু করার উদ্যোগ নেন। ঋণ করে পরপর দু’বার ছোট হোটেলের ব্যবসা শুরু করেন। কিন্তু চাঁদাবাজি আর বাকির ভারে টিকতে পারেনি তার ব্যবসা। তারপরও হাল ছাড়ে না জব্বার। জীবন সংগ্রামে পাশে পায় ছোটভাই মালেককে। দুই ভাই মিলে তিন বছর আগে শুরু করে এই হোটেল। লতিফ মনে করেন, তাদের সবচেয়ে বড় পুঁজি মানুষকে ভেজালমুক্ত খাঁটি জিনিস খাওয়ানোর আপোসহীন চেষ্টা আর দুই ভাইয়ের  পারস্পরিক ভালোবাসা।
লতিফের কথা শুনে জব্বারের সঙ্গে কথা না বলে পারা গেল না। জব্বার জানালেন, শুরু থেকেই বেশি লাভের আশায় চায়ের মান নষ্ট করেননি তারা। বিশেষ মিটার দিয়ে কঠোর পরীক্ষা করে পুরনো পুলিশ ফাঁড়ির ফার্ম ও চিরিরবন্দর থেকে পানিমুক্ত দুধ কিনতে হয় তাদের। পানি দেয়া দুধ দিয়ে চা বানানোকে জব্বার লোক ঠকানো বা চুরি মনে করেন। তার বিশ্বাস, ‘মানুষ ঠকানো মানে আল্লাহকে ঠকানো। জব্বার জানান, বর্তমানে প্রতিদিন দেড় শ লিটারের ওপর দুধ লাগে চায়ের জন্য। এই ব্যবসার ওপর বেঁচে আছে তার পরিবার ও  সতেরো জন শ্রমিক।
ভিড় ঠেলে মালেকের কাছে পৌঁছাই। হাজার হাজার মানুষকে যিনি চা খাইয়ে তৃপ্ত করেন তাকে ‘চা শিল্পী’ বলাই শ্রেয়। কথা বলার সময় নেই তার। কথা বলতে গিয়ে কটি গ্লাসের চা খারাপ করতে চান না তিনি। এত চা বানাতে কষ্ট হয় না? মালেকের জবাব, ‘হাতে কড়া পড়ে যায়।’ চা ভালো হওয়ার জন্য কী মেশানো হয়? বললেন, ‘খাঁটি দুধ জ্বাল দিয়ে চা বানানো হয়। যে দুধে পানি দেয়া হয় আমরা সেটা কিনি না আর একবার চা পাত্তি দিয়ে একবারই চা বানাই।’ কেউ চা খেয়ে ভালো বললে কেমন লাগে? মুচকি হেসে বললেন, ‘অনেক ভালো লাগে।’
মালেক গর্বের সঙ্গে জানায়, শুধু সাধারণ মানুষই নয়, স্থানীয় সংসদ সদস্য, গণ্যমান্য ব্যক্তি ও অনেক বিদেশি তার চা খেতে আসেন এখানে। প্রতিদিন আনুমানিক ১ হাজার ২০০ কাপ চা বানাতে হয় তাকে। মালেকের বিশ্বাস, বেশি লাভ নয়; বরং সততাই তাদের চায়ের ব্যবসাকে টিকিয়ে রেখেছে এবং রাখবে। কখনো মন খুব খারাপ হয়? কিছুটা নীরব থেকে মালেকের উত্তর, ‘যখন চাঁদার জন্য চাঁদাবাজরা চোখের সামনে চায়ের গ্লাস ভাঙতে থাকে।’
আরেক কাপ চা খেয়ে যখন ফিরছি তখন মালেকের দোকানের চারপাশে ভিড় জমে গেছে। সবার হাতে শোভা পাচ্ছে মালেকের ‘চা’। আমাকে ভুলে মালেক আবার ব্যস্ত হয়ে পড়ে চা বানাতে। প্রচার বা বিখ্যাত বনে যাওয়া কোনোটিই তার লক্ষ্য নয়। তার উদ্দেশ্য সবাইকে খাঁটি দুধের চা খাওয়ানো। চা বানানোর টুং টাং শব্দ ও মানুষের কোলাহলকে পেছনে ফেলে ফিরছি আর মনে মনে ভাবছি পুনর্ভবা নদীর মতো মালেকের চা বানানোতে যেন কখনই ভাটা না পড়ে।

লিখাটি প্রকাশিত হয়েছে সাপ্তাহিকে ১১ জুলাই ২০০৯

© 2011 – 2018, https:.

এই ওয়েবসাইটটি কপিরাইট আইনে নিবন্ধিত। নিবন্ধন নং: 14864-copr । সাইটটিতে প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো তথ্য, সংবাদ, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করলে আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।

Show More

Salek Khokon

সালেক খোকনের জন্ম ঢাকায়। পৈতৃক ভিটে ঢাকার বাড্ডা থানাধীন বড় বেরাইদে। কিন্তু তাঁর শৈশব ও কৈশোর কেটেছে ঢাকার কাফরুলে। ঢাকা শহরেই বেড়ে ওঠা, শিক্ষা ও কর্মজীবন। ম্যানেজমেন্টে স্নাতকোত্তর। ছোটবেলা থেকেই ঝোঁক সংস্কৃতির প্রতি। নানা সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠনের সঙ্গে জড়িত। যুক্ত ছিলেন বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র ও থিয়েটারের সঙ্গেও। তাঁর রচিত ‘যুদ্ধদিনের গদ্য ও প্রামাণ্য’ গ্রন্থটি ২০১৫ সালে মুক্তিযুদ্ধ ভিত্তিক মৌলিক গবেষণা গ্রন্থ হিসেবে ‘কালি ও কলম’পুরস্কার লাভ করে। মুক্তিযুদ্ধ, আদিবাসী ও ভ্রমণবিষয়ক লেখায় আগ্রহ বেশি। নিয়মিত লিখছেন দেশের প্রথম সারির দৈনিক, সাপ্তাহিক, ব্লগ এবং অনলাইন পত্রিকায়। লেখার পাশাপাশি আলোকচিত্রে নানা ঘটনা তুলে আনতে ‘পাঠশালা’ ও ‘কাউন্টার ফটো’ থেকে সমাপ্ত করেছেন ফটোগ্রাফির বিশেষ কোর্স। স্বপ্ন দেখেন মুক্তিযুদ্ধ, আদিবাসী এবং দেশের কৃষ্টি নিয়ে ভিন্ন ধরনের তথ্য ও গবেষণামূলক কাজ করার। সহধর্মিণী তানিয়া আক্তার মিমি এবং দুই মেয়ে পৃথা প্রণোদনা ও আদিবা।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

Back to top button