হাতিখেদা, টংক প্রথা ও হাজং মাতার কথা
স্মৃতিসৌধের কাছে ভাগ হয়ে গেছে রাস্তাটি। একটি রাস্তা স্মৃতিসৌধের গাঁ ঘেঁষে বাম দিক দিয়ে চলে গেছে বিপিনগঞ্জের দিকে। অন্যটি সোজা গিয়ে শেষ হয়েছে বিজয়পুর জিরো পয়েন্টে। চারপাশে সবুজের আলিঙ্গন। দূরে ছায়ার মতো দাঁড়িয়ে আছে মেঘে ঢাকা গারো পাহাড়। দূর থেকে সে পাহাড়ের দৃশ্য দেখতে অন্যরকম লাগে।
স্মৃতিসৌধের সামনে খানিকটা জটলা। দুর্গাপুরে বেড়াতে আসা আগতরা ঘুরে দেখছে সৌধটিকে। কেউ কেউ নিজেদের মধ্যেই আলাপ জমিয়েছে ইতিহাসে ঘটে যাওয়া ঘটনাগুলো নিয়ে। নীল আকাশ আর সবুজ প্রকৃতির মাঝে মাথা তুলে দাঁড়িয়ে থাকা স্মৃতিসৌধটি হাজং মাতা রাসামণির স্মরণে নির্মিত হয়েছে ১৯৯০ সনে।
দুর্গাপুরের নাট্যকর্মী গোপালকে নিয়ে আমরাও এসেছি স্মৃতিসৌধটি দেখতে। কিন্ত কে ছিলেন রাসামণি? গোপাল জানালেন তার আগে জানতে হবে হাতি-খেদা আন্দোলনের কথা। অনেক বছর আগে এই আন্দোলন করেছিল দুর্গাপুর অঞ্চলের হাজং, গারো আর বাঙালি কৃষকরা। আমরা আগ্রহী হতেই গোপাল বলতে শুরু করে সে আন্দোলনের কথা।
এক সময় সুসং রাজা বা জমিদাররা ছিল গারো পাহাড়ের বিপুল অরণ্য সম্পদের মালিক। এ থেকে তাদের প্রচুর আয় হতো। এছাড়া তাদের আর একটা আয়ের পথ ছিল হাতির ব্যবসা। এক সময় এই গারো পাহাড়ে দলে দলে হাতি নিঃশংক চিত্তে বিচরণ করত। বছরের একটা নির্দিষ্ট সময়ে সেই বন্য হাতিদের ধরবার ব্যবস্থা করা হতো। প্রচলিত ভাষায় এর নাম হাতি-খেদা। হাতি-খেদার সময় অনেক লোকের সাহায্যের প্রয়োজন হতো। শত শত লোককে অনেক দূর থেকে হাতির দলকে ঘেরাও করে, উচ্চকন্ঠে চিৎকার করে ও নানা রকম বিকট আওয়াজ তুলে তাদের তাড়া করে নিয়ে আসতে হতো।
হাতি ধরাতে পারদর্শী ছিল হাজংরা। তাই সুসংরাজ বংশের রাজা কিশোর হাতি ধরার জন্য ১৭৭০ খ্রিষ্টাব্দে অনেক হাজং পরিবারকে দুর্গাপুর থানার পাহাড়ি অঞ্চলে বসতি করান। এই চাষীরা রাজার বা জমিদারের হুকুমমাত্রই হাতিখেদা পেতে হাতি ধরে দিত অর্থাৎ কাজে নামতে হতো। এই কাজের ফলে হাজংরা নিজেদের কাজ করার সময় পেত না। ফলে তাদের দুঃখ দুর্দশার অন্ত ছিল না। হাতি ধরলে রাজার লাভ হতো কিন্তু এতে বনে জঙ্গলে ও হাতির আক্রমণে অনেক হাজং চাষী প্রাণ হারাত। এ কাজের জন্য তাদের কোনো পারিশ্রমিক দেয়া হতো না। বরং হাতি ধরার কাজে না আসলে রাজা-জমিদাররা তাদের ওপর অত্যাচার চালাত।
এভাবেই কাটতে থাকল হাজংদের দিনগুলো। এ সময় মনা সর্দারের নেতৃত্বে দুর্গাপুরের কৃষকরা বিদ্রোহ করে। গারো চাষীরাও যোগ দেয় সে বিদ্রোহে। বিদ্রোহ চতুর্দিকে ছড়িয়ে পড়ে। মনার জীবনে নেমে আসে করুণ পরিণতি। জমিদাররা মনা সর্দারকে বুনো হাতির পায়ের তলে পিষে হত্যা করে। ফলে ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে গারো ও হাজং কৃষকরা। তারা একযোগে আক্রমণ করে সুসং জমিদার বাহিনীর ওপর। হাজং মাহুতেরা হাতিগুলো ছেড়ে দিলে বুনো হাতির আক্রমণে জমিদার বাহিনী ছত্রভঙ্গ হয়ে যায়। অনেকে মারাও পড়ে। বিদ্রোহীরা সুসং দুর্গাপুর অভিমুখে অভিযান চালালে জমিদার-পরিবার প্রাণ বাঁচাতে নেত্রকোণায় পালিয়ে যায়। বিদ্রোহীরা বিজয়পুর, ধেনকী, ভরতপুর, আড়াপাড়া, ফারাংপাড়া, চেংনী প্রভৃতি স্থানে যত হাতিখেদা ছিল সব ধ্বংস করে দেয়। এ বিদ্রোহ চলে পাঁচ বছর। বিদ্রোহের ফলে হাতিখেদা চিরতরে বন্ধ হয়ে যায়। স্বস্তি পায় গারো ও হাজং কৃষকরা।গোপাল এবার শুরু করে কুমুদিনী হাজংয়ের কথা। গারো পাহাড়ের পাদদেশে সোমেশ্বরী নদীর পশ্চিম তীরে বহেরাতলী গ্রামে জন্ম কুমুদিনী হাজংয়ের। তার বাবা অতিথ চন্দ্র ছিলেন একজন হাতিখেদা বিদ্রোহী। বাবা-মা মারা যাওয়ার পর মামার কোলেÑ পিঠেই বড় হন কুমুদিনী হাজং। ১৫ বছর বয়সে কুমুদিনীর বিয়ে হয় লংকেশ্বর হাজংয়ের সঙ্গে।
এ সময় গারো পাহাড় অঞ্চলে জমিদার ও মহাজনরা চালু করে নতুন ব্যবস্থা। এই নতুন ব্যবস্থার নামই ‘টংক প্রথা’। এ প্রথানুসারে, জমির জন্য কৃষককে টাকার খাজনা দিতে হতো না বটে, কিন্তু ধান উঠলে জমিদারকে একর প্রতি একটা নির্দিষ্ট পরিমাণ ফসল দিতে হতো। কিন্তু জমির উপর কৃষকের কোনো স্বত্ব ছিল না। জমিদার যে কোনো সময় তার হাত থেকে এই জমি ছাড়িয়ে নিতে পারত। গোপালের ভাষায়, ‘ব্যবস্থাটা অনেকটা বর্গা প্রথার মতো, কিন্তু তফাৎ একটু আছে। বর্গাদার চাষীদের ফসল উঠলে উৎপন্ন ফসলের একটি অংশ জমির মালিককে দিতে হয়। কিন্ত এই টংক প্রথার ক্ষেত্রে উৎপন্ন যা-ই হোক না কেন, চাষীকে একটা নির্দিষ্ট পারমাণ ধানো দিতেই হতো। যদি কোন কারণে ফসল সম্পুর্ণভাবে নষ্টও হয়ে যায় তবুও এই নিয়ম লংঘন করা চলবে না। তখন বাজার থেকে ধান কিনে জমিদারের পাওনা চুকিয়ে দিতে হতো।’
এটি ছিল মূলত জামিদারদের ফাদ। এই টংক প্রথার কারণে দুর্গাপুরের হাজংরা ক্রমেই জমি হারিয়ে নিঃস্ব হতে থাকে। কমরেড মণি সিংহ ছিলেন সুসং রাজা বা জমিদারের ভাগ্নে। তিনি মেহনতি কৃষকদের ঐক্যবদ্ধ করে টংক আন্দোলন গড়ে তুলতে থাকলেন। টংক প্রথা উচ্ছেদ, টংক জমির খাজনা স্বত্ব, জোত স্বত্ব. নিরিখ মতো খাজনা ধার্য, বকেয়া টংক মওকুফ, জমিদারী প্রথা উচ্ছেদ প্রভৃতি ছিল টংক আন্দোলনের মূল দাবি।
হাজংরা সে সময় টংক আন্দোলনে বেশ সক্রিয় ছিল। সে সূত্রে কুমুদিনী হাজংয়ের স্বামী ও তিন ভাই রাজেন্দ্র হাজং, ইসলেশ্বর হাজং ও গজেন্দ্র হাজং টংক আন্দোলনে জড়িয়ে পড়েন। তারা বহেরাতলী গ্রামে টংক প্রথার বিরুদ্ধে আন্দোলনে সক্রিয় ছিলেন। গোটা গ্রামটির জঙ্গি কৃষকরাও আন্দোলনে অংশ নিতেন। ফলে কৃর্তপক্ষের বিষ নজর ছিল গ্রামটির দিকে।
এরই মধ্যে স্মৃতিসৌধের সম্মুখে জড়ো হয়েছে বহু পর্যটক। সবার মুখে মুখে বীরঙ্গনা রাশিমণি’র কথা। কিন্তু কিভাবে শহীদ হলেন হাজং মাতা রাশিমনি? এর কোনো তথ্যই টাঙ্গানো নেই সৌধ প্রাঙ্গণে।
১৯৪৬ সালের ৩১ জানুয়ারি সকাল ১০টার দিকে বিরিশিরি থেকে বহেরাতলী গ্রামে ইস্টার্ন ফ্রন্টিয়ার রাইফেল বাহিনীর একটি দল কুমুদিনী হাজংয়ের স্বামী লংকেশ্বর হাজংয়ের বাড়িতে হানা দেয়। টংক আন্দোলনের মাঠ পর্যায়ের নেতা লংকেশ্বর হাজং ও তার ভাইদের গ্রেফতার করাই ছিল উদ্দেশ্য। কিন্তু তারা আসার পূর্বেই লংকেশ্বর হাজং ও তার তিন ভাই আত্মগোপন করে আড়াপাড়ায় মণি সিংহের গোপন আস্তানায় চলে যায়। লংকেশ্বর হাজংকে ধরতে না পেরে রাইফেল বাহিনীর সেনারা ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে। এক পর্যায়ে তারা লংকেশ্বর হাজংয়ের সদ্য বিবাহিত স্ত্রী কুমুদিনী হাজংকে ধরে নিয়ে যায়।
গোপাল জানালেন, রাসামণির শহীদ হওয়ার ঘটনাটির চমৎকার বর্ণনা পাওয়া যায় প্রখ্যাত লেখক সত্যেন সেন রচিত ‘বাংলাদেশের কৃষকের সংগ্রাম’ বইটিতে। তিনি বীরাঙ্গনা রাশিমণির সংগ্রামের বর্ণনা দিয়েছেন ঠিক এভাবে – ‘সেদিন এই গ্রামের জঙ্গি কৃষক কর্মীরা কোনো এক সভায় যোগ দিতে গিয়েছিল। সে সুযোগে পাঁচজন সশস্ত্র সেনা হানা দেয় গ্রামটিতে। তারা অবাধে গ্রামের ভেতর ঢুকল আর ঘরে ঘরে গিয়ে মার পিট আর নানারকম উৎপাতের সৃষ্টি করে চলল। তারা গ্রাম ছেড়ে চলে আসার সময় কুমুদিনী হাজংকে জোর করে তাদের সঙ্গে টানতে টানতে নিয়ে চলল। কিছুটা এগোতেই একদল কৃষকের সঙ্গে তাদের একেবারে মুখোমুখি দেখা। কৃষকরা সংখ্যায় ত্রিশ-চল্লিশ। তাদের মধ্যে দশ-বারোজন মেয়ে। বহেরাতলী থেকে এরা সভায় যোগ দিতে গিয়েছিল। প্রায় সবার হাতেই বল্লম। বন্দিনী কুমুদিনী তার গ্রামের পরিচিতদের দেখে আর্তকন্ঠে সাহায্যের জন্য চিৎকার করে উঠল। কৃষকদের দলের সামনের সারিতে ছিলেন রাশিমণি। বয়স চল্লিশ ছাড়িয়ে গেছে। উদ্যোমের ভাটা পড়েনি একটুকুও। কৃষক সমিতির জঙ্গি কর্মী হিসেবে সকলের কাছে সে পরিচিত।
কুমুদিনীর চিৎকার শুনে গর্জে ওঠে সবাই। সবার আগে সাড়া দেন রাশিমণি। কুমুদিনীকে চিনতে পেরে তিনি ছুটে গিয়ে বাঘিনীর মতোই পুলিশের ওপর ঝাপিয়ে পড়েন। সঙ্গে সঙ্গে ওদের একটা রাইফেল গর্জে ওঠে। গুলিবিদ্ধ রাশিমণি লুটিয়ে পড়েন মাটিতে। তার প্রিয় বহেরাতলীর মাটি বুকের রক্তে ভিজে লাল হয়ে ওঠে। রাশিমণির পিছন পিছন ছুটে এসেছিলেন কৃষককর্মী সুরেন্দ্রনাথ। ওরা তাকেও গুলি করল।
চোখের সামনে পর পর দুটি মৃত্যু। তাদের দুজন প্রিয় কমরেড। জঙ্গী কৃষকরা ভীম গর্জনে আকাশ কাপিয়ে বল্লম হাতে পুলিশদের তাড়া করল। দিশেহারা পুলিশদের মধ্যে দুজন বিপথে গিয়ে আটকা পড়ল। ছুটে আসা কৃষকদের বল্লম ওদের ধরাশায়ী করে ফেলল।’
রাশিমণি হাজং শহীদ হওয়ার এক মাস পরেই স্ত্রী বিয়োগে কাতর রাশিমণির স্বামী পাঞ্জী হাজং আগুনে আত্মাহুতি দেয়। নিঃসন্তান হয়েও হাজংদের অধিকার ও নারী সংগ্রামের প্রতীক রাশিমণি হাজং সম্প্রদায়ের হাজং মাতা হিসেবে খ্যাতি লাভ করেন। আর কুমুদিনী হাজং হয়ে ওঠেন টংক আন্দোলনের প্রেরণার উৎস। শহীদ রাশিমণির কথা হাজং কৃষকরা আজও ভুলতে পারেনি। তার নামটা এখনও তাদের মুখে মুখে ফিরে ।
স্মৃতিসৌধ থেকে যেতে হবে আরেক গন্তব্যে। গারো পাহাড়ে সৌন্দর্য দেখতে রওনা হই বিজয়পুর জিরো পয়েন্টের দিকে। পেছনে পড়ে হাজং মাতা শহীদ রাশিমণির স্মৃতিসৌধটি। তার প্রতি শ্রোদ্ধা নিয়ে মনে মনে শুধু কয়েকবার বলি, ‘কমরেড তোমায় লাল সালাম’।
লিখাটি প্রকাশিত হয়েছে সাপ্তাহিকে ১৭ নভেম্বর ২০১১
© 2011 – 2018, https:.