ছায়ানট : স্থির প্রত্যয়ে যাত্রা
ছায়ানটের যাত্রা শুরু হয়েছিলো ১৯৬১ সালের শেষ দিকে । পঞ্চাশ বছর হয়ে গেল । রবীন্দ্র-জন্মশতবার্ষিকী অনুষ্ঠানের পর ওই উপলক্ষে একত্রিত সংস্কৃতিকর্মীরা জয়দেবপুরে সারাদিনের আনন্দ সম্মিলনে জড়ো হয়েছিলেন । পরিকল্পনার মূলে ছিলেন মোখলেসুর রহমান সিধুভাই । শতবার্ষিকীর সময়ে যেমন, তেমনি এই মেলার আয়োজনে সিধুভাই আর তাঁর সহধর্মিণী শামসুন্নাহার রহমান, আমাদের রোজবু-র উতসাহ ছিল অপরিসীম । তাদেঁর র্যান্কিন স্ট্রিটের বাসাটি ছিল এই সব কর্মকান্ডের কেন্দ্রস্থল । শতবার্ষিকী অনুষ্ঠানের মহড়া তো বটেই, দাঙ্গার সময়ে সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠীর আশ্রয় মিলেছে ওই বাড়িতেই । সেখানে প্রহরায় অতন্দ্র ছিল ছায়নট কর্মীবাহিনী ।
তো, জয়দেবপুরে আনন্দমেলার পর শেষবিকেলে সকলে গোল হয়ে বসা হল । মোখলেসুর রহমান ( সিধুভাই ) জানালেন একটি সমিতি গঠনের উদ্দেশ্যেই এই বৈঠক । সুফিয়া কামাল অবিসংবাদিত সভাপতি । সাধারণ সম্পাদক ফরিদা হাসান । সংগঠনের নাম হলো ‘ছায়ানট’, রাগিণীর নামে নাম । এতকাল পরে সমিতির সকল সদস্যের নাম মনে করতে পারি না । সহ-সভাপতি হয়েছিলেন সায়েরা মহিউদ্দীন, সে-কথা মনে আছে । ক’জন সদস্যের নাম বলতে পারি । যেমন, আহমেদুর রহমান, ওয়াহিদুল হক, রোজবু, সাইদুল হাসান, মিজানুর রহমান ছানা, সাইফুদ্দিন আহমেদ মানিক, দেবদাস চক্রবর্তী, নূরুল ইসলাম । সরকারি চাকুরে ছিলাম বলে আমি সদস্য হতে পারিনি। অবশ্য প্রতিটি সভায় উপস্থিত থেকে আলোচনায় যোগ দিয়েছি । অনুষ্ঠান পরিকল্পনা আর পরিচালনার দায়িত্বও পালন করে এসেছি । আজ চারপাশে তাকিয়ে দেখি প্রথম সংসদের অধিকাংশ সদস্যই চলে গেছেন পরলোকে । বিনম্র শ্রদ্ধায় ছায়ানটের অগ্রযাত্রায় তাদেঁর ভূমিকার কথা স্মরণ করি। ১৯৬৪ সালে ছায়ানট ‘ পূর্ব পাকিস্তান সংস্কৃতি সম্মেলন ‘ করবার সিদ্ধান্ত নিলে এ বিষয়ে আহমেদুর রহমান একটি ঘোষণাপত্র তৈরি করে দিয়েছিলেন । যদিও, সরকার-পরিকল্পিত ভায়বহ সংখ্যালঘু নিধনযজ্ঞ শুরু হওয়াতে সে- সম্মেলন করা সম্ভব হয়নি ।
ছায়াটন কাজ শুরু করেছিল ১৯৬২ সালে পুরোনো গানের অনুষ্ঠান দিয়ে । তার পরে প্রথম শ্রোতার আসর সাজানো হয় সিধুভাইদের বাসায় । ফিরোজা বেগমের নানা ধরণের গান হয়েছিল সেদিন। দ্বিতীয়বার হল ফাহমিদা খাতুনের রবীন্দ্রসঙ্গীত । তৃতীয় আসরে শুদ্ধ সঙ্গীত । শ্রোতাদের জায়গা হতে চায়না ঘরে । তার অর্থ, বাঙালির মনে ঐতিহ্যের প্রতি আগ্রহ-আকর্ষন বেড়ে উঠতে লাগলো । আয়োজকরা বিপদে পড়লেন তখন । দেশে ভালো শিল্পী তো খুব বেশি নেই ! বাঙালি জাগছে, তার মনের রসদ চাই ! ছায়নট যে শুরু দায়িত্ব মাথায় তুলে নিয়েছে তা থেকে পেছোবার উপায় নেই, ইচ্ছেও নেই কোরো । কী করা যায় ?
দু:সাহস বটে ওয়াহিদুল হকের ! মনে মনে ঠিক করে ফেললেন, সঙ্গীতবিদ্যায়তন গড়তে হবে । তা না হলে সাধনা হবে কি করে ? সংস্কৃতিমান মানুষ তৈরি করবার এই তো পথ ! কিন্ত সভাতে এত বড় কাজের সিদ্ধান্ত কি সহজে পাশ করানো যায় !!! অর্থ আসবে কোঙ্থেকে ? ওয়াহিদুল বলেন, কেন সবাই মিলে চাঁদা দিলেই স্কুল করা যাবে, কে কত দেবেন বলুন । বড় ভরসা যাঁর ওপর সেই সিধুভাই অসন্তষ্ট হয়ে মুখ ফিরিয়ে রইলেন । ওয়াহিদুল জোর করে ঘোষণা দিলেন আমি আর সনজীদা মাসে মাসে সত্তুর টাকা করে দেব । তখন অগত্যা একে একে কেউ পনের, কেউ পচিঁশ, কেউ তিরিশ, এমন কী দশ টাকা কবুল করলেন । তখন পাশ হয়ে গেল প্রস্তাব ।
শুরু হল সংস্কৃতির সাধনা, বাঙালি হবার সাধনা, মানুষ হবার সাধনা । সবাই জানেন, পাকিস্তান রাষ্ট্র তখন দেশের বাঙালিকে পাকিস্তানি মুসলমান বানাবার জোর চেষ্টা চালাচ্ছে । তার প্রতিকূলে আমরা শুরু করলাম বাঙালিত্বের চর্চা, ঐতিহ্য চেতনাকে পুনরুদ্ধার করে বাঙালির সাংস্কৃতিক স্বাধিকার প্রতিষ্ঠিত করবার চেষ্টা । তারই অনুসরণে বসন্তের অনুষ্ঠান সাজানো হলো খোলা চত্বরে । বিদ্যায়তনে গান শিখতে – আসা শিক্ষার্থীদের মধ্যে থেকে বেশ একটি দল তৈরি হয়ে উঠছিলো । ওদের নিয়ে বলধার জমিদারদের বাগানে গিয়ে শরতের গানের উতসব করা হলো । বর্ষা আবাহনের জন্যে অবশ্য বাধ্যতামূলকভাবে আচ্ছাদিত জায়গা বেছে নিতে হতো । এইভাবে একের পর এক ঋতুউতসব শুরু করা হলো ।
ছায়ানটের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত হয়েছিল সুপ্রসর অঙ্গনে নববর্ষ বরণ করে বাঙালির সম্মিলনের সুযোগ সৃষ্টি করা । ঋতুউতসবগুলো থেকে শুরু করে ক্রমে ধর্মবর্ণনির্বিশেষে সকল বাঙালির উতসব প্রতিষ্ঠা পেল এর মধ্য দিয়ে । বিশেষ করে বর্ষবরণের বটমূল যেন হলো বাঙালির ঐক্যবদ্ধ হবার জায়গা । দিনে দিনে আপন অধিকার অর্জনের শপথ অন্তরে অন্তরে বলিষ্ঠ হতে লাগলো । সকালের আলোয় আমাদের প্রার্থনা হলো ‘ আলোকের এই ঝরনাধারায় ধুইয়ে দাও’ । মন্ত্র হল ‘ সবারে বাস রে ভালো, নইলে মনের কালো ঘুচবে না রে’। প্রতিজ্ঞা হয়ে দাঁড়ালো ‘ অনুকরণ খোলস ভেদি কায়মনে বাঙ্গালি হ, ……. বিশ্বমানব হবি যদি শাশ্বত বাঙ্গালি হ, সম্পুর্ণ বাঙ্গালি হ ‘। সাধনার পথ আসলে অনন্ত । তাই বাঙালির স্বাধীন রাষ্ট্রের স্বপ্ন সকল হলেও ছায়ানটের সাধনা শেষ হয়নি । জীবনকে তো প্রতিনিয়ত ধুয়ে নিতে হয়, মলিনতার গ্লানি ক্ষালন করতে হয় । কিন্ত এ সাধনা কি কেবল সঙ্গীতচর্চা দিয়েই সফল হতে পারে ?
পারে না বলেই স্বাধীন বাংলাদেশের নববর্ষ অনুষ্ঠানে বোমা হামলা ঘটে যায় । সেই আঘাতেই আমাদের চেতনা হয়, আমরা সর্বাত্মক সাধনার কথা ভাবিনি এতদিন । অনেক কাজই বাকি রয়ে গেছে, যা করবার কথা ভাবা উচিত ছিল । খেয়াল হলো, শিশুদের স্বাভাবিক বিকাশের সহায়তা করে আনন্দময় শিক্ষায় যথার্থ শিক্ষিত করে তুলতে হবে । কর্তব্যবোধ থেকেই আঁকা-গড়া নাচ-গান- খেলাধুলার সাহায্যে পাঠের আদর্শ হিসেবে নালন্দা বিদ্যালয় গড়ে তুলতে হলো । অন্য বিদ্যালয়ের শিশুকিশোরদের দেশি সংস্কৃতির সঙ্গে পরিচিত করে তুলবার জন্য ‘ শিকড়’ কার্যক্রম শুরু করবার কথাও ভাবনায় এলো । অটিস্টিক শিশুদের আনন্দ দিয়ে মানসিকভাবে খানিকটা সুস্থতার দিকে টেনে আনবার জন্য ‘ সুরের জাদু রঙের জাদু’ প্রকল্প নেওয়া হলো । আর, বয়স্ক নাগরিকদের বাংলা ভাষা-সাহিত্যের প্রতি প্রীতিবোধ আর চেতনা বাড়িয়ে তোলার জন্য ‘ভাষার আলাপ’ – এর বৈঠক শুরু করা হলো । শুদ্ধসঙ্গীত বিভাগে এখন চালু হয়েছে গুরুমুখী বিদ্যা শিক্ষা ।
ইদানীং উতসবে উতসবে প্রাণচঞ্চল হয়ে উঠেছে ছায়ানট সংস্কৃতি- আয়োজন । দেশঘরের গান, শুদ্ধসঙ্গীত – উতসব, নজরুল- উতসব, রবীন্দ্র-উতসব, নৃত্যোতসবের ভিতর দিয়ে আমরা বাঙালির সংগ্রামক্লিষ্ট জীবনে আনন্দের রস সিঞ্চন করতে চাই । মূলে, জাতীয় সংস্কৃতির পরিচয় লাভের জন্যেই ছায়ানটের সকল আয়োজন -উদ্যোগ । ছোটো-বড়ো নানা মানুষ এ সমাজে রয়েছে যারা গানের পরিচয় লাভ করতে চায়, কিন্ত সঙ্গীতবিদ্যায়তনের মূল ধারার শিক্ষগ্রহণের জন্যে প্রয়োজনীয় ভর্তি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে পারে না । তাদের জন্য পরীক্ষা না দিয়ে ভর্তি হয়ে একবছর মেয়াদি সঙ্গীত-পরিচয় লাভের ব্যবস্থা করা হয়েছে । আর কিছুটা গান-জানা বয়স্ক ব্যক্তিদের বিশেষ শ্রেণীতে বাংলা কাব্যগীতি আর প্রধান কিছু লোকসঙ্গীত শেখানো হচ্ছে ।
এইবারে স্মরণ করব, ষাটের দশকে চট্রগ্রামে সামুদ্রিক জলোচ্ছ্বাসের সময় থেকেই সব রকমের প্রাকৃতিক বিপর্যয়ে ছায়ানট ক্ষতিগ্রস্থ সাধারণের পাশে দাঁড়িয়েছে। এখনও ছায়ানট ত্রাণ নিয়ে ছুটে যায় বিপর্যস্ত এলাকায় । ছায়ানটকে প্রতিনিয়ত গঠনমূলক কার্যক্রম হাতে নিতে হয় । ত্রাণ দিয়ে নয়, মানুষ গড়ে তুলতে পারলেই মানুষ বাঁচবে ।
ছায়ানট নানা সেমিনার আর প্রকাশনা করে আসছে স্বাধীনতা অর্জনের পর থেকে । বছর চারেক অতিক্রান্ত হতে চলেছে ‘ বাংলাদেশের হৃদয় হতে’ নামের একটি সঙ্গীত-সংস্কৃতি বিষয়ক ত্রৈমাসিক প্রকাশিত হচ্ছে ।
কেবল সঙ্গীত নয়, শিক্ষা আর সংস্কৃতিক্ষেত্রের বহুতর সাধনার ভিতর দিয়ে জীবনের সকল স্তরে সমৃদ্ধ হয়ে উঠতে চাই আমরা । শাশ্বত বাঙালি হয়ে বিশ্বমানব হয়ে উঠবার সার্বিক প্রয়াস আমাদের । আসুন, আমরা সকলে মিলে মানুষ হই, আদর্শ মানবতার পথে একত্র যাত্রা করি ।
– সনজিদা খাতুন
( লিখাটি ছায়ানটের পঞ্চাশ বছর পুর্তি উপলক্ষে প্রকাশিত ফোল্ডার হতে সংগ্রহ করা । )
© 2011 – 2018, https:.