নানা বিশ্বাসের আদিবাসী বিয়ে
চা খেতে খেতেই আদিবাসী নিয়ে বিতর্ক জুড়ে দেয় বন্ধু মমিন। প্রগতিশীল রাজনৈতিক চিন্তার মানুষ সে। তবুও তার মনে আদিবাসী নিয়ে নানা প্রশ্ন। আদিবাসী কারা? আদিবাসীরাই যদি এদেশের আদিবাসী হয় তবে আমরা কারা? আদিবাসী বিষয়ে একজন লেখককে পেয়ে এ প্রশ্নগুলো যেন আরো ফুঁসে ওঠে।
আদিবাসী বিষয়ে এ ধরনের প্রশ্ন ঘুরপাক খায় অনেকের মনেই। হয়তো কায়দা করেই ঘুরপাক খাইয়ে রাখা হয়েছে বিষয়টিকে। স্বয়ং সরকার বাহাদুরই এদের একবার ‘উপজাতি’ আবার ‘ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী’Ñ এরকম নানা নামে নামকরণ করে বাঙালি জাতিকে বৃহৎ নৃগোষ্ঠীর সম্মান দেয়ার আপ্রাণ চেষ্টা চালাচ্ছে। কিন্তÍ অপর জাতিকে অবজ্ঞা করে কি সম্মান মিলবে?
অনেকেই মনে করেন আদিবাসীদের ‘আদিবাসী’ হিসেবে স্বীকার করার অর্থ তারাই এ অঞ্চলের আদি বাসিন্দা, বাঙালিরা নয়। কিন্তÍ মজার বিষয় হচ্ছে নৃতাত্ত্বিক দৃষ্টিতে আদিবাসী পরিচয় নির্ণয়ে কারা আদি বাসিন্দা, কারা নন সেটি মুখ্য বিষয় নয়। সাধারণত প্রাক ঔপনিবেশিক সময় থেকে যারা যে এলাকায় বসবাস করে আসছেন তারা সে এলাকার আদিবাসী হিসেবে বিবেচিত হবেন এবং যাদের সঙ্গে প্রাকৃতিক সম্পদের সম্পর্ক আছে, যাদের নিজেদের সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক ব্যবস্থা আছে, যাদের নিজস্ব ভাষা, সংস্কৃতি ও বিশ্বাস আছে তারাই আদিবাসী। তাই অহেতুক বিতর্ক নয়, প্রয়োজন অন্য জাতির প্রতি আমাদের দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন আনা।
খুব সরলভাবেই সবকিছু মেনে নেয় মমিন। আদিবাসী সংস্কৃতি থেকে কিভাবে নানা রীতি ঢুকে পড়েছে বাঙালি সংস্কৃতিতে, আদিবাসীদের নানা বিশ্বাসের বিয়ে ও আনন্দ-উল্লাসের আয়োজন নিয়ে আলাপ চলে বন্ধুটির সঙ্গে।
বাংলাদেশের অধিকাংশ আদিবাসী সমাজে বাল্যবিবাহের প্রচলন নেই। তবে ময়মনসিংহ ও টাঙ্গাইল জেলার গারোদের মাঝে এক সময় ‘ঠ্যাং ধরা বিয়ে’ নামক এক ধরনের বিয়ের প্রচলন ছিল। কনে খুব ছোট থাকা অবস্থায় এ ধরনের বিয়ের অনুষ্ঠান করা হতো। বিয়ের দিন কনের মাতা কনেকে কোলে নিয়ে বিয়ের কুটিরে বসতো। বর এসে গ্রাম্য মোড়ল ও আত্মীয়স্বজনের সম্মুখে কনের মায়ের ঠ্যাং বা পা ধরে বিবাহের স্বীকৃতি দিত এবং শাশুড়িকে নববধূসহ নিজ গৃহে যেতে অনুরোধ করত। মেয়ে বড় না হওয়া পর্যন্ত তার মাতাপিতা তার রক্ষণাবেক্ষণ করত। এমনকি মেয়েসহ মাতা জামাতার বাড়িতে অবস্থান করত। আধুনিক শিক্ষার সংস্পর্শে এসে ঠ্যাং ধরা বিয়ে আজ অবলুপ্ত।
সহায়-সম্পত্তির মালিকানা নির্ণয় কিংবা সমাজের আত্মমর্যাদা লাভের জন্য আদিবাসী সমাজে এক সময় এধরনের বাল্যবিবাহের প্রচলন ছিল। যদি কোনো পিতার একমাত্র কন্যা থাকে এবং যদি তার শরিকদের সে সম্পত্তি ভোগদখল করার সম্ভাবনা থাকে। তবে সে ক্ষেত্রে মেয়েকে বাল্যকালে বিয়ে দেয়া হতো। যাতে করে সম্পত্তির মালিকানা একমাত্র মেয়ে ও জামাতাই হতে পারে।
এধরনের নানা কারণে রাজবংশীদের আদিম সমাজেও প্রচলিত ছিল এক ধরনের বিয়ের রীতি। এটিকে বলা হতো ‘পেটে পেটে বিবাহ’। এ বিয়েতে গর্ভাবস্থাতেই পুত্র-কন্যা কল্পনা করে দু’পক্ষ বিবাহ চুক্তিতে আবদ্ধ হতো। এ জন্য বিশেষ প্রার্থনা অনুষ্ঠানেরও আয়োজন করা হতো যাতে গর্ভজাত সন্তান যথাক্রমে ছেলে এবং মেয়েরূপে জন্মলাভ করে। এ ধরনের বিয়েতে ভবিষ্যৎ বর-কনের বাবা ও মা লেনদেনের চুক্তিতে আবদ্ধ হয় এবং বর-কনে বয়োপ্রাপ্ত হলে তাদের চুক্তি মোতাবেক সহায়-সম্পত্তি অর্পণ করে।
বাংলাদেশের মুরং, মগ, চাকমা, খাসিয়া, সাঁওতাল, ওঁরাও প্রভৃতি আদিবাসীদের মধ্যে মনোমিলনে বিয়ের প্রচলন রয়েছে। আদিবাসী সাঁওতালদের রাজারাজি বিবাহও এ বিয়ের পর্যায়ভুক্ত। এ ছাড়া জোর জবরদস্তিমূলক বিয়ে একমাত্র সাঁওতালদের মধ্যে প্রচলিত। এ বিয়ে হুরকাটারা বা ইতুত নামে পরিচিত।
কিন্তু পাশ্চাত্য দেশের আদিবাসীদের বলপূর্বক বিয়ের মতো কিন্তু সাঁওতালদের জবরদস্তিমূলক বিয়েটি নয়। বলপূর্বক বিয়ে পাশ্চাত্যের আদিবাসীদের নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার। এই বিয়েতে বর যে যুদ্ধ পরিচালনা করে তার মধ্যে নিহিত থাকে বরের শৌর্য-বীর্যের বহির্প্রকাশ। যেমনÑ আফ্রিকার বুশম্যান যুবক বিবাহ অনুষ্ঠান থেকে বলপূর্বক কনেকে আনতে গেলে আত্মীয়পরিজন কর্তৃক বাধাপ্রাপ্ত হয়। তখন বরের সঙ্গে চলে রীতিমতো যুদ্ধ। যুদ্ধে যদি যুবক জয়ী হয় তবে সে কনে আনবার অধিকার পায় নতুবা তাকে কনে হারাতে হয়।আদিবাসীরা অপদেবতার কোপানলে বিশ্বাসী। আর এই কোপানল থেকে রক্ষা পেতে অনেক আদিবাসী সমাজ বর ও কনেকে প্রথমে যথাক্রমে আমগাছ, শেওড়া গাছ অথবা মহুয়া গাছের সঙ্গে বিয়ে দেয়। অতঃপর অনুষ্ঠানের মাধ্যমে আসল বিয়ে সম্পন্ন করে।
আদিবাসী সাঁওতালদের বিশ্বাস বাল্যকালে কোনো ছেলে বা মেয়ের ওপরের মাড়িতে যদি প্রথম দাঁত ওঠে তবে তার ওপর দেবতার কুনজর থাকে। আর এই কুনজর থেকে রক্ষা পেতে তাকে প্রথমে কুকুর বা শেওড়া গাছ অথবা মহুয়া গাছের সঙ্গে বিয়ে দিতে হয়। এই ধরনের বিয়েকে সাঁওতালি ভাষায় যথাক্রমে শেতা বাপলা, দাইবান বাপলা, মাতকোম বাপলা বলে।
সাঁওতালদের মতো আদিবাসী মু-াদের মাঝেও এ ধরনের ‘অসবর্ণ’ পদ্ধতিতে বিবাহ রীতির প্রচলন আছে। মুন্ডারা এ বিয়ের দিন বর ও কনের গায়ে ভালো করে তেল ও হলুদ মেখে বরকে আমগাছ ও কনেকে মহুয়া গাছের সঙ্গে বিয়ে করায়। মু-া ছাড়াও সাঁওতাল, রাজবংশীরা মনে করে এ ধরনের বৃক্ষ বিয়ের ফলে অপদেবতা কোপ থেকে মুক্তির পাশাপাশি নতুন দম্পতির সন্তান-সন্ততি লাভ সহজ হয়। আদিবাসী বিশ্বাসে বৃক্ষ হলো উর্বরতা শক্তির প্রতীক। কাজেই বৃক্ষের সঙ্গে সুখ সম্পর্ক থাকলে সংসার জীবনেও সুখের দেখা মিলবে এরকমটিই তাঁদের বি�নেকে বরণ করার রীতি বাংলাদেশের অধিকাংশ আদিবাসী সমাজে চালু রয়েছে। আদিবাসীরা বিশ্বাস করে এ রীতি ভাবী দম্পতির ভবিষ্যৎ জীবন ধন-ধান্যে পরিপূর্ণ হবে। ধান, দুর্বা, আতপ চাল ইত্যাদি বস্তুতে রয়েছে জীবনসার এবং সিঁদুর আদিবাসীদের যৌন-চিহ্ন।
আবার বিয়ের পূর্বে বর ও কনেকে তেল, হলুদ মেখে স্নান করানোর রীতি প্রায় সব আদিবাসী পালন করে থাকে। এ রীতিকে অনেকে বলে ‘তেলাই’। আদিবাসীদের বিশ্বাস তেলাইয়ের মাধ্যমে পবিত্রকরণ করা হয় বর-কনেকে। যাতে অপদেবতার ‘আসর’ বিনষ্ট হতে পারে।
আদিবাসী বিশ্বাসে জল অতি পবিত্র। জলের মধ্যে সারবস্তু রয়েছে অধিক মাত্রায়। এ কারণে চাকমা, মগ, টিপরা, দালুই, সাঁওতাল, ওঁরাও, রাজবংশী প্রভৃতি আদিবাসীদের মধ্যে বিয়ের পর মঙ্গলঘট থেকে আমপাতা-জামপাতা দিয়ে জল ছিটিয়ে আশীর্বাদ করার রীতি প্রচলিত আছে। বর-কনের জীবন যাতে সুখী হয় সেটিই তাদের আশীর্বাদের মূল উদ্দেশ্য।
বিয়েতে নবদম্পতির ভবিষ্যৎ জীবন কিরূপ হবে চাকমা সমাজে সে পরীক্ষা রীতি চালু রয়েছে। মহিলার কলার খোল দিয়ে দুটো নৌকা তৈরি করে একটিতে পান এবং অপরটিতে সুপারি দিয়ে নদীতে ভাসিয়ে দেয়। নৌকা দুটি যদি পাশাপাশি ভাসতে থাকে তবে মনে করা হয় নবদম্পতির মিলের সম্ভাবনা। আর যদি বিপরীতমুখো হয়ে ভাসতে থাকে তবে অমিলের সম্ভাবনা। অমিল ঠেকাতে বিপরীত মুখো হয়ে ভাসা নৌকা দুটি টেনে একত্র করে তার নিচ থেকে কলসি ভরে জল এনে নবদম্পতিকে স্নান করিয়ে দেয়া হয়।
সাঁওতাল, ওঁরাও, রাজবংশী প্রভৃতি আদিবাসীরাও এই নিয়ম পালন করে থাকে কিছুটা ভিন্ন উপায়ে। বিয়ের পরের দিন বাড়ির আঙিনায় ছোট একটি পুকুর কাটা হয়। অতঃপর তাতে জলভর্তি করে বর ও কনেকে সেই পুকুরে পয়সার লুকোচুরি খেলায় নামতে হয়। প্রথমে বর একটি পয়সা লুকিয়ে রাখে এবং স্ত্রী তা বের করে। পরে স্ত্রী তা লুকায় এবং বর বের করে। যদি উভয়েই সফল হয় তবে তাদের মধ্যে ভবিষ্যৎ জীবনে দ্বন্দ্ব কলহ দেখার দেবা সম্ভাবনা থাকে না। আমাদের গ্রামবাংলার হিন্দু ও মুসলিম সমাজেও এই পয়সার লুকোচুরি খেলার নিয়ম প্রচলিত রয়েছে।
এভাবে শুধু বিয়ে নয়, যুগ যুগ ধরে নানা আদিবাসী রীতি স্থান করে নিয়েছে বাঙালি সংস্কৃতিতে। আদিবাসীদের সমাজের কাছে যেটি ধর্মীয়, বাঙালি সংস্কৃতিতে সেটা শুধুই সামাজিক রীতি। পার্থক্য এটুকুই। এভাবেই বাংলার লোকসংস্কৃতিতে মিশে যায় আদিবাসী সংস্কৃতির নানা রীতিনীতি। কিন্তু মিটে না শুধু আদিবাসী আর বাঙালি শব্দের দ্বন্দ্ব।
লিখাটি প্রকাশিত হয়েছে সাপ্তাহিকে ৯ ডিসেম্বর ২০১০
© 2011 – 2018, https:.