জীবনকথা

ওস্তাগিরি চলি গেইছে মেডিকেলে

রাস্তার দুপাশে মানুষের ঝটলা। চলছে নানা জিনিসের বিকিকিনি। কেউ বসেছে সবজি নিয়ে। কেউ আবার আম লিচুর খাচি সাজিয়ে। গোমরা মুখে বসে আছে কয়েকজন। তাদের সামনেই বাড়ির পোষা কয়েক জোড়া মুরগি বাঁধা। মাঝে মাঝেই ক্রেতা-বিক্রেতায় চলছে দরকষাকষি। লাল ফিতে আর কাচের চুড়ির বাক্স বসেছে একপাশে। অন্যপাশে গান বাজিয়ে ঝটলা করে বিক্রি হচ্ছে অজানা কোন শক্তিবর্ধক ওষুধ। বস্তায় সাজানো সোনালী ধান নিয়ে অপেক্ষা করছে কয়েকজন কৃষক। চলছে নতুন ধানের বেচাকেনা। এভাবে মানুষের আনাগোনা চলে প্রতি রবি আর বুধবার, দুপুর হতে সন্ধ্যা অবধি।

বিকেলের দিকে দিনাজপুরের বিরল বাজারের হাটে যেতেই দেখি দৃশ্যগুলো। ভিড় ঠেলে এগোই ভেতরের দিকটায়। হঠাৎ দেখি মুদিখানার পাশে অপেক্ষারত এক লোক। পাঞ্জাবি আর লুঙ্গি পরা। লম্বা মতো লোকটি। বয়স পঞ্চাশের অধিক। দু-একজন কাছে আসতেই হাসিমুখে কথা বলছেন। লিখে নিচ্ছেন কিছু একটা। আবারও অপেক্ষা। অজানা কোন আগন্তুকের জন্যে। কে এই লোকটি? স্থানীয় সাংবাদিক এমএ কুদ্দুস। পাশ থেকে জানাল তিনি এখানকার ‘ওস্তা’।
যারা মুসলমানি করানোর কাজে যুক্ত থাকে তাদের বলা হয় ওস্তা। অঞ্চল ভেদে এদেরকে ডাকা হয় ওস্তা, ওস্তাদ, হাজাম কিংবা খলিফা বলে। যুগ যুগ ধরে এরা গ্রামেগঞ্জে মুসলমানির কাজ করছে আদি রীতিতে।

এখনও গ্রামেগঞ্জে মুসলমানির দিন থেকে সাতদিন ঐ বাড়িতে চলে নানা আচার। সাতদিনের দিন হলুদ মেখে গোসল করানো হয় সদ্য মুসলমানি হওয়া ছেলেটিকে। একই সঙ্গে আত্মীয়স্বজনকে খাওয়ানো হয় দাওয়াত। যা সুন্নতে খাত্না নামে পরিচিত। তাই মুসলমানি কেন্দ্রিক বাঙালি সংস্কৃতির সঙ্গে মিশে আছে ওস্তা নামটি।
কাছে গিয়ে আলাপ জমাই ওস্তার সঙ্গে। নাম তার মহসিন আলী। বাড়ি বিরলের  মোখলেসপুর গ্রামের সোনাহার পাড়ায়। ওস্তাগিরি করছেন ৩৫ বছর ধরে। বাবা জাহির ও দাদা আজর ছিলেন দশ গ্রামের নামকরা ওস্তা।
কেন এই পেশায়? প্রশ্ন করতেই মহসিন বলেন, ‘বাপ-দাদা করি আইছে তাই হামরা করি’। মুসলমানি করানোর পর ওস্তা জানিয়ে দেয় নানা বিধিনিষেধ। মহসিনের ভাষায়, ‘ইলিশ, পাঙ্গাশ, বোয়াল, বেগুন আর ছাগলের গোস্ত -এলা জিনিস খাবার পারিবে না। গরুর গোস্ত খাবার পারিবে। পোলাও খিলানো যাবে নি’। ওস্তাদের আর কী বলে ডাকা হয়? মহসিন বলেন, ‘ওস্তাক খলিফা কয়, হাজাম কয় আর কয় ওস্তাদ’। কত পান? খানিকটা চুপ থেকে উত্তর, ‘তিনশ দেয়, সাথে লুঙ্গি দেয় আর দেয় পাঞ্জাবি। কেহ দেয়, কেহ দেয় না।’ প্রতিমাসে কয়টি মুসলমানির কাজ করেন?  তিনি বলেন, ‘নির্ধারিত নাই। গত মাসে করছি ১৫টি’।
দুজন জজ সাহেবসহ এলাকার অনেক গণ্যমান্য ব্যক্তির মুসলমানি হয়েছে মহসিনের হাতে। এখনও তাদের সঙ্গে দেখা হলে তারা তাকে শ্রদ্ধা করে। মহসিনের ভাষায়, ‘সালাম দেয়, ভালোমন্দ পুছ করে’। তিনি বলেন, ‘কেহ অসম্মান করে না, আল্লাহ দিলে এটায় সবাই দাম দেয়। হামাক গ্রামোতে সবাই এক নামে চিনে’।
মহসিনের তিন ছেলে এক মেয়ে। বড় ছেলে লেখাপড়া করছে দিনাজপুর ভোকেশনালে। নিজে ওস্তাগিরি শিখেছেন বাবা জাহিরের কাছ থেকে। কিন্তু মহসিনের ওস্তাগিরি পছন্দ করে না তার বড় ছেলে। এ নিয়ে কোন আফসোস নেই তার। কারণ ছোট ছেলে রশিদুল আবার আগ্রহী  বাপ-দাদার ওস্তা পেশার প্রতি।
মহসিন জানালেন শীত মৌসুমে মুসলমানির কাজ বেশি থাকলেও বর্ষায় তেমন কাজ পায় না ওস্তারা। ওস্তাগিরি করতে কোনো সনদ লাগে কী না এমন প্রশ্নে তিনি মুচকি হেসে বলেন, ‘হামাক মেডিকেল সার্টিফিকেট লাগে না। থানা থেকি লোক জানে কে ওস্তা’।
ওস্তারা মুসলমানিতে ব্যবহার করে বাঁশের চল্লি বা ক্ষুর। এন্টিসেপটিক হিসেবে গোবর পোড়ানো ছাই। মহসিনের ভাষায় ‘ঘুঠা’। সুতিকাপড় পুড়িয়ে আদি রীতিতে চলে মুসলমানির কাজ।  সময়ের গতিতে এখন ওস্তাদের মধ্যেও সচেতনতা এসেছে। ফলে ওস্তারাও এখন ব্যবহার করছেন নানা ধরনের আধুনিক ওষুধপত্র। কিন্তু তবুও ওস্তা দিয়ে মুসলমানি করানোর প্রবণতা কমে যাচ্ছে দিনে দিনে।
এক সময় মুসলমানি করানোর জন্য ওস্তাই ছিল একমাত্র ভরসা। কিন্তু এখন নাতির মুসলমানির জন্য পরিবারের নানা-দাদারা ওস্তার ওপর নির্ভর করতে চাইলেও অধিকাংশ শিক্ষিত বাবা-মারা নির্ভরতা খুঁজে পায় ডাক্তারদের ওপর। ফলে কর্মহীন হয়ে পড়ছে ওস্তারা। টিকে থাকছে না প্রাচীন এই পেশাটি। একইসঙ্গে হারিয়ে যাচ্ছে মুসলমানি কেন্দ্রিক বাঙালি আচারগুলো।
দীর্ঘশ্বাস নিয়ে মহসিন বলেন, ‘বাপ-দাদার সময় তো দশ গ্রামের লোক আসত বাড়িত। হামাক এখন হাটত খোঁজখবর নিবা হছে’। তার ভাষায়, ‘আগের থাকি ওস্তাগিরি কমি গেইছে’। মহসিন আক্ষেপ করে বলেন, ‘ওস্তাগিরি চলি গেইছে মেডিকেলে’।
হাট জমে উঠেছে পুরোদমে। কিন্তু ওস্তা মহসিনকে ঘিরে ভিড় জমে না। তবুও অপেক্ষায় থাকে মহসিন। বাপ-দাদার ওস্তা পেশা তার রক্তে। জীবনধারণের জন্য না হলেও এই পেশা ছাড়তে পারে না ওস্তারা। ফলে এক ধরনের কষ্ট নিয়ে টিকে আছে এরা। তাই ফেরার পথে ভাবি নানান কিছু। ওস্তা মহসিন কী পারবে তার পূর্বপুরুষদের ওস্তাগিরি ধরে রাখতে?

লিখাটি প্রকাশিত হয়েছে সাপ্তাহিকে ৮ নভেম্বর ২০১১

© 2011 – 2018, https:.

এই ওয়েবসাইটটি কপিরাইট আইনে নিবন্ধিত। নিবন্ধন নং: 14864-copr । সাইটটিতে প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো তথ্য, সংবাদ, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করলে আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।

Show More

Salek Khokon

সালেক খোকনের জন্ম ঢাকায়। পৈতৃক ভিটে ঢাকার বাড্ডা থানাধীন বড় বেরাইদে। কিন্তু তাঁর শৈশব ও কৈশোর কেটেছে ঢাকার কাফরুলে। ঢাকা শহরেই বেড়ে ওঠা, শিক্ষা ও কর্মজীবন। ম্যানেজমেন্টে স্নাতকোত্তর। ছোটবেলা থেকেই ঝোঁক সংস্কৃতির প্রতি। নানা সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠনের সঙ্গে জড়িত। যুক্ত ছিলেন বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র ও থিয়েটারের সঙ্গেও। তাঁর রচিত ‘যুদ্ধদিনের গদ্য ও প্রামাণ্য’ গ্রন্থটি ২০১৫ সালে মুক্তিযুদ্ধ ভিত্তিক মৌলিক গবেষণা গ্রন্থ হিসেবে ‘কালি ও কলম’পুরস্কার লাভ করে। মুক্তিযুদ্ধ, আদিবাসী ও ভ্রমণবিষয়ক লেখায় আগ্রহ বেশি। নিয়মিত লিখছেন দেশের প্রথম সারির দৈনিক, সাপ্তাহিক, ব্লগ এবং অনলাইন পত্রিকায়। লেখার পাশাপাশি আলোকচিত্রে নানা ঘটনা তুলে আনতে ‘পাঠশালা’ ও ‘কাউন্টার ফটো’ থেকে সমাপ্ত করেছেন ফটোগ্রাফির বিশেষ কোর্স। স্বপ্ন দেখেন মুক্তিযুদ্ধ, আদিবাসী এবং দেশের কৃষ্টি নিয়ে ভিন্ন ধরনের তথ্য ও গবেষণামূলক কাজ করার। সহধর্মিণী তানিয়া আক্তার মিমি এবং দুই মেয়ে পৃথা প্রণোদনা ও আদিবা।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

Back to top button