নেহাল গ্রামের ঋষিদের কথা
মধ্য দুপুর। গোটা রাস্তায় কোনো লোকের দেখা নেই। চারপাশে সুনসান নিরবতা। ধোঁয়ার মতো ঘনকুয়াশা চারপাশে। সূর্যটাও মুখ লুকিয়েছে কুয়াশার চাদরে। এরকম দিনে ঘর থেকে বেরুনোর সাধ্যি কার! তাও আবার কোনো শহরে নয়। দিনাজপুর জেলার বিরল উপজেলার ধুকুরঝারির প্রত্যন্ত পথে।
এখানকার আবহাওয়া নাকি সবসময়ই চরমভাবাপন্ন। তার ওপর জলবায়ু পরিবর্তনের ধাক্কা তো আছেই। তাই বছর কয়েক ধরে শীতের তাপমাত্রা নেমে আসছে ৪ থেকে ৫ ডিগ্রিতে। আর গরমের সময়ে জিভ বের হয়ে যাওয়ার উপক্রম হয়।
প্রচন্ড শীতে মান্কী ক্যাপে ঢাকা পরিচিতজনদের চেনাই দায়। মুখ চিনতে চোখ দুটোই একমাত্র ভরসা। সেভাবেই চিনে নিলাম স্থানীয় যুবক বাবুকে। একটি মোটরসাইকেল নিয়ে ধুকুরঝারির মোড়ে অপেক্ষায় আছে সে।
আমাদের গন্তব্য নেহাল গ্রামের আদিবাসী পাড়ায়। সেখানে আদিবাসী মুসহর সম্প্রদায়ের ৬৫টি পারিবারের বাস। পাকা রাস্তা থেকে পাড়াটি ৭ কিলো ভেতরে। ইউনিয়নের নাম ৩নং ধামইর। ইউনিয়নের নাম জানতে চাইলে, স্থানীয়রা উত্তরে বলে, ‘৩ নং’। মূল নামটিকে আড়ালে রেখে নম্বর বলতেই যেন সবাই স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করে।
বাবুর মোটরসাইকেলটি এগোতে থাকে গ্রামের প্রধান সড়ক ধরে। ডানদিকে বাঁক নিয়ে হঠাৎ সে মোটরসাইকেলটিকে নামিয়ে দেয় সরু একটি মেঠোপথে। দুপাশে বেড়ার ঘের। অনেক দূরে তাকালে দুএকটা গ্রাম চোখে পড়ে। বাবু জানালো একসময় এই জায়গাতেই ছিল আদিবাসী মুসহর সম্প্রদায়ের পাড়াটি। নানা কারণে জায়গাটি চলে আসে স্থানীয় চৌধুরীদের দখলে। এ নিয়ে চৌধুরীদের সাথে মুসহরদের কিছুদিন দ্বন্দ্ব-সংঘাতও চলে। কিন্ত টিকতে পারে না তারা। কিন্ত তাতেও মুসহররা দমে যায় না। তারা চলে যায় আরো ভেতরের দিকে।
জমি কিনতে আদিবাসীরা সবাই মিলে গ্রামীণ ব্যাংক থেকে ঋণ নেয়। অতঃপর নেহাল গ্রামের শেষ প্রান্তে গড়ে তোলে মুসহর পাড়াটি। সেটিও প্রায় বছর দশেক আগের ঘটনা। এখন এই পাড়াতেই নিজের জাতিসত্তা নিয়ে টিকে আছে মুসহর সম্প্রদায়ের আদিবাসীরা। নেহাল গ্রাম ছাড়াও দেরাপাটিয়া, গোবিন্দপুর আর দারুইলে আছে মুসহর সম্প্রদায়ের আরো কিছু সংখ্যক আদিবাসী।
বাবুর কথা হঠাৎ থেমে যায়। সেই সাথে মোটরসাইকেলটিও। বড় একটি আম্রপালির বাগানের ভেতর দিয়ে আমরা হাঁটতে থাকি। এখানে শীত যেন প্রকৃতির ছোঁয়ায় আরো জেকে বসেছে। খানিকটা পথ এগোতেই আমরা পৌঁছে যাই আদিবাসী পাড়াটিতে।
মুসহর পাড়াটিতে ছনে ঢাকা ছোট্ট ছোট্ট ঘর। খানিকটা ভিন্ন ঢঙের। একটি বাড়িতে ঢুকে কাউকে পাওয়া গেল না। বাড়িটির উঠানের মাঝে একটি তুলসি গাছ। গাছটির গোড়াতে মাটির উঁচু ঢিবি করে লেপে দেয়া হয়েছে। উঠানের এককোণে বড় একটি মাটির চুলা। ছোট একটি ঘরের পাশেই লাগোয়া আরেকটি ঘর। এটি যে গোয়াল ঘর তা বেশ বোঝা যায়। ঘরগুলোর মধ্যে কোনো জানালা নেই। বাবু জানালো মুসহরদের বাড়িগুলো নাকি এমনটাই হয়। তবে একসময় এদের অবস্থা আরো ভালো ছিল। তখন বাড়িগুলোতে ছিল সচ্ছলতার ছাপ। এখন আদিবাসী মুসহরদের সবকিছুতেই ছাপ পড়েছে দারিদ্র্যতার।
আমরা গোটা পাড়াটি ঘুরে দেখি। শীতে কাঁপা দু’একটা কুকুরের পাশে বসে কিছু একটা ভাবছে এক বৃদ্ধা। বয়স নব্বইয়ের মতো। শরীরে কোনো গরম কাপড় নেই। চরম দারিদ্র্যতা যেন ভুলিয়ে দিয়েছে বৃদ্ধার শীত কাঁপুনিকে। পরনের কাপড়টিকে অবলম্বন করেই সূর্যের অপেক্ষায় সে বসে আছে।
মুসহর পাড়ার শেষ প্রান্তে টিনেঘেরা একটি ঘর। সাইনবোর্ড দেখে জানা গেল এটি আদিবাসী শিশুদের একটি স্কুল। স্কুলটি পরিচালনা করে স্থানীয় এক এনজিও। মাতৃভাষায় শিক্ষালাভের জন্য এই স্কুলটিই আদিবাসীদের একমাত্র ভরসা।
স্কুলের পাশেই জটলা বেঁধেছে পাড়ার সবাই। তারা কথা বলছে ভিন্ন কোনো ভাষায়। আমরা তার কিছুই বুঝে উঠতে পারছি না। আমাদের দেখে এগিয়ে আসে কেশো ঋষি। গোত্রের মন্ডল সে। কেশো জানাল, নিজেদের মধ্যে মুসহররা কথা বলে পশ্চিমা ভাষায়। এদের পূর্বপুরুষরা এসেছে ভারতের মুংগাইর জেলা থেকে। ব্রিটিশ আমলে রেললাইনের কাজ হয়েছে সারাদেশে। সে সময় কাজের টানে মুসহরদের পূর্বপুরুষরাও চলে আসে এদেশে। আমরা পরিচিত হই পলিন ঋষির সঙ্গে। গোত্রের একমাত্র শিক্ষিত যুবক সে। পলিন জানাল, মুসহর সম্প্রদায়ের আদিবাসীরা তাদের নামের শেষে টাইটেল হিসেবে ব্যবহার করে ‘ঋষি’ শব্দটি। সে জানাল, মাসখানেক আগের একটি ঘটনা নিয়ে পাড়ার সবাই আলোচনায় বসেছে। ঘটনাটি শুনে বাঙালি হিসেবে আমরাও খানিকটা লজ্জিত হই।
কয়েকজন অপরিচিত বাঙালি এসে জানাল, আদিবাসীদের ভাগ্যোন্নয়নের জন্য একটি এনজিও গরু-ছাগল দিয়ে সাহায্য করবে। তারা মুসহর পাড়ার আদিবাসীদের নানা তথ্য সংগ্রহ করে। তথ্য সংগ্রহের পর তারা প্রত্যেকের কাছ থেকে খরচ হিসেবে নিয়ে নেয় ১৭০ টাকা। সরল মনেই আদিবাসীরা সব বিশ্বাস করে। নির্ন মন্ডল, ছড়িদার আর পারমানি ছাড়া আর কোন পরিষদ নেই। কেশো ঋষি মন্ডলের, গোবিন্দ ঋষি ছড়িদারের এবং সমারু ঋষি পারমানির দায়িত্ব পালন করছে।
গোত্রের মন্ডল গোটা পাড়া ঘুরিয়ে দেখায় আমাদের। হাঁটতে হাঁটতে কথা হয় মুসহর সম্প্রদায়ের বিয়ে নিয়ে। মুসহরদের নিজ গোত্রের বাইরে বিয়ে নিষিদ্ধ। অন্যান্য সম্প্রদায়ের মতো এরাও বিয়ে বাড়িতে কলাগাছ দিয়ে মারোয়া সাজায়। বিয়ের আগে বর ও কনে স্ব-স্ব বাড়িতে জোয়াল পূজা করে। তাদের ভাষায় ‘জোঙ্গাল বা আনকে পূজাইয়ে’। পনকে এরা বলে ‘পোনা দেখাল’। একসময় এদের বিয়েতে পণ দেয়ার বিধান থাকলেও এখন মুসহর সম্প্রদায়ের ছেলেদের খুশিমতো যৌতুক দিতে হয়।
মুসহরদের বিয়ের নিয়ম মোতাবেক বরকে প্রথমেই বরণ করতে হয় শাশুড়ি, খালা শাশুড়ি, চাচি শাশুড়িকে। বরণ করাকে এরা বলে ‘চুমা যায়ে’। এরা বরকে বরণ করে ধানা (ধান), দুবরিয়া ঘাসা (দুর্বা ঘাস), পানা (পান), গোবরা (গোবর) দিয়ে। বিয়েতে মেয়ের বাবাকে তার জামাতাকে দিতে হয় ডোনারিয়া (কাইতন), ধোতিয়া (ধুতি), গামছাবা (গামছা), পাঞ্জাবি প্রভৃতি। একইভাবে ছেলের বাবা তার পুত্রবধূকে দেয় নুউওয়া (বিয়ের শাড়ি), কুর্তা (ব্লাউজ) প্রভৃতি। সাঁওতালদের মতো এক সময় এরাও সাদা কাপড় কাঁচা হলুদে ডুবিয়ে বিয়ের শাড়ি তৈরি করত। কিন্ত এখন সাধ্যের মধ্যে শাড়ি কিনতে পারায় মুসহররা কাঁচা হলুদে আর বিয়ের শাড়ি তৈরি করে না।
পনিল জানাল, নিয়ম মোতাবেক মুসহরদের বিয়েতে বর-কনেকে মারোয়ায় বসিয়ে লগ্ন মিলন করতে হয়। লগ্ন মিলন কাজটি করতে হয় একটি কাঁসার বাটিতে রাখা পানির মধ্যে। বরের ভাগির মা (ভাগিনা) বাটির পানিতে আমপাতা ডুবিয়ে তাতে সিন্দুর (সিঁদুর) লাগানো চার (চাউল) ছেড়ে দেয়। দুটি চাল ভাসতে ভাসতে একসাথে লেগে গেলেই তা ধরে ফেলা হয়। ধরে নেয়া হয় এটিই বিয়ের উপযুক্ত সময়। মুসহরদের ভাষায় বলে,‘কাংনা বানেল লাগা’। ঠিক সে সময়েই বর কনেকে কানি আঙ্গুলে সিঁদুর লাগিয়ে দেয়। বিয়ের পরে চলে ‘দান্না কারবি’ পর্ব। একে একে সবাই আশীর্বাদ করে উপহার তুলে দেয় এ পর্বে। পাশাপাশি চলে নাচ, গান আর হাড়িয়া খাওয়া।
গোত্রের ম-ল জানাল, অন্যান্য সম্প্রদায়ের মতো মুসহরদের বিয়েতে কনেপক্ষকে বরের বাড়িতে দাওয়াত করা হয় না। বরং আটদিন পর বরই আবার কনেকে তার বাবার বাড়িতে নিয়ে আসে। মুসহরদের ভাষায়, ‘বেটিয়া দামদা আঠারোয়া এতে’। অর্থাৎ বেটি আটদিন পরে জামাইসহ বাবার বাড়িতে আসে।
মুসহর পাড়ার একেবারে শেষ প্রান্তে একটি বাঁশঝাড়ের পাশে বসে আমাদের গল্প চলে। আমাদের আসরে যোগ দেয় দারা ঋষি। বছরের কোন সময়টা মুসহরদের জন্য খারাপ সময়। প্রশ্ন করতেই দারা ঋষি জানাল, ভাদ্র, আশ্বিণ, কার্তিক। এ সময়টাতে অন্যান্য আদিবাসীদের মতো এরাও মহাজনদের কাছে আগাম মজুর বিক্রি করে। পূর্বপুরুষদের আমল থেকেই অভাবের এই সময়টাতে এরা জংলি আলু খেয়ে বেঁচে থাকে। জংলি আলুকে এরা বলে ‘অরুয়া চোতা হাওয়া’। কোথায় পাওয়া যায় এটি। জানতে চাইলে দারার উত্তর, ‘চোতা হাওয়া হওয়া হে বাসাক জাংলাম’ অর্থাৎ জংলি আলু হয় বাঁশের ঝোপে।
পাশ থেকে ম-ল জানাল, অন্যান্য আদিবাসীদের মতো এদেরও পূজার সময়টাই আনন্দের সময়। মুসহরদের সবচেয়ে বড় উৎসব ছটপূজা। এ পূজা হয় আশ্বিন-কার্তিকে ডালা বা চিতিয়া পূজার পর পরই। প্রথানুসারে এ পূজায় নিকটস্থ নদী বা পুকুরে সূর্য ডোবার আগে এদের পূজা দিতে হয়। ঠিক তার পরের দিনই সূর্য উঠার আগে আগে আবার পূজা শেষ করতে হয়। এটি অনেকটাই আদিবাসী ভুনজারদের সূর্যাহু পূজার মতোই। এছাড়া গৃহদেবতা হিসেবে এরা তুলসি পূজা করে। গৃহদেবতাকে মুসহর ভাষায় বলে ‘সিরবা খারা’।
মুসহরদের সাথে গল্প যেন আরো জমে ওঠে। কথার পিঠে কথা চলে। চারদিকে অন্ধকার নামে। জোনাকির বাগানে চলে ঝিঁঝির ডাক। দূরে ডেকে ওঠে শেয়ালের দল। নেহাল গ্রামের আদিবাসী পাড়ায় বাজে মাদলের বাদ্য। আমরা হারিয়ে যাই অজানা সব কাহিনীর রাজ্যে।
লিখাটি প্রকাশিত হয়েছে সাপ্তাহিকে ৩ মার্চ ২০১১
© 2011 – 2018, https:.