কাশেম মোল্লার রেডিও
১৯৭১ সাল। পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর একটি ক্যাম্প ছিল পাকশী পেপার মিল ও হার্ডিঞ্জ ব্রিজ এলাকায়। খুব কাছেই রূপপুর গ্রাম। গ্রামের প্রধান রাস্তার পাশে কড়ইতলীতে ছিল ছোট্ট একটি চায়ের দোকান। দোকানির নাম কাশেম মোল্লা। গ্রামের মানুষ ভালোবেসে ডাকত ‘মোল্লা’ বলে।
মুক্তিযুদ্ধের সময় রূপপুরের সবাই উৎকণ্ঠা আর আতঙ্কে দিন কাটাচ্ছে। দেশের খবর জানে না কেউ। রেডিও পাকিস্তানে নেই সঠিক কোনো খবর। খবর শুধুই বিবিসি, ভয়েস অব আমেরিকা, কলকাতা বেতার আর স্বাধীন বাংলা বেতারে।
দশ গ্রামের মধ্যে রেডিও ছিল না কারও কাছেই। কিন্তু কাশেম মোল্লার ছিল থ্রি ব্যান্ডের একটি ফিলিপস রেডিও। প্রতি সন্ধ্যায় নিজের দোকানে তিনি শর্টওয়েভে সবাইকে বিবিসির খবর শোনাতেন। বিবিসির টানে দিনকে দিন তাঁর দোকানে ভিড় বাড়তে থাকে। আশপাশে বসে আরও কয়েকটি দোকান। সন্ধ্যা হলেই রূপপুর গ্রামের লোকজন একে অন্যকে বলেন, ‘চল, বিবিসি শুনতে যাই।’ বিবিসির খবর শোনাকে কেন্দ্র করে এভাবেই গড়ে ওঠা বাজারের নাম প্রথমে ‘বিবিসি শোনার বাজার’ এবং পরে তা হয়ে যায় ‘বিবিসি বাজার’।
ঈশ্বরদীর লালন শাহ সেতু হাইওয়ে থেকে কিলো খানেক ভেতরে বিবিসি বাজার। দোকানের সংখ্যা শতাধিক। কিন্তু সেখানে বাজারের প্রবর্তক কাশেমের দোকান খুঁজে পেলাম না।
খোঁজ করতে গিয়ে কথা হয় আশরাফ মালিথা ও রূপপুরের মুক্তিযোদ্ধা মো. ওমর আলীর সঙ্গে। মোল্লার চায়ের দোকানে বসে বিবিসির খবর শোনার স্মৃতি আজও তাঁদের কাছে জীবন্ত। তাঁরা জানালেন, পাকিস্তানিদের গাড়ির শব্দ পেলেই মোল্লার দোকান থেকে সবাই সরে পড়তেন। লুকিয়ে থাকতেন ঝোপঝাড় আর গাছের আড়ালে। সে সময় অনেকেই বিবিসির খবর শুনে উদ্বুদ্ধ হয়ে মুক্তিযুদ্ধে গিয়েছিলেন।
চা খেতে আসা নানা জনের নানা তথ্য থাকত কাশেমের কাছে। কখনো কখনো গোপনে ছদ্মবেশে আসতেন মুক্তিযোদ্ধারাও। তাঁরাও জেনে নিতেন রাজাকার আর পাকিস্তানিদের নানা খবর।
কিন্তু কাশেম মোল্লা আছেন কোথায়? পাকশী রেলবাজারে তাঁর একটি মিষ্টির দোকানের কথা জেনে আমরা রওনা দিই সেদিকে।
ভাঙাচোরা একটি দোকান। এক কোণে ঝুলছে বড় একটি ছবি। ছবিতে কাশেম মোল্লার সঙ্গে সাংবাদিক আতাউস সামাদসহ বেশ কয়েকজন। দোকানে বসা তাঁর মেজ ছেলে আবদুস সামাদ। ছবি দেখিয়ে তিনি জানালেন, বিবিসি নামে একটি বাজারের নামকরণের কথা শুনে ১৯৯২ সালে এখানে এসেছিলেন বিবিসির তৎকালীন ‘ইস্টার্ন সার্ভিস সেকশন’-এর প্রধান ব্যারি ল্যাংরিজ, বাংলা সার্ভিসের উপপ্রধান সিরাজুল ইসলাম, প্রযোজক ও উপস্থাপক দীপঙ্কর ঘোষ এবং সংবাদিক আতাউস সামাদ।
একসময় দোকানে আসেন কাশেম মোল্লা। বয়স সত্তরের অধিক। লাঠিতে ভর দিয়ে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে চলছেন। বিবিসি বাজার নিয়ে কথা হয় তাঁর সঙ্গে। স্ত্রী আনোয়ারা বেগমের আবদারেই কেনা হয় রেডিওটি। ভিড় জমাতেই তিনি সেটা নিয়ে যেতেন দোকানে। মানুষকে শোনাতেন বিবিসি, ভয়েস অব আমেরিকা ও স্বাধীন বাংলা বেতারকেন্দ্রের অনুষ্ঠান।
একচিলতে হাসি দিয়ে কাশেম মোল্লা জানালেন, সে সময় বিবিসির খবর সবাই আগ্রহ নিয়ে শুনতেন। দেরিতে এলও খবরপাঠকের কণ্ঠ শুনে ঠিক ঠিক বলতে পারতেন কার কণ্ঠ শুনছেন—সিরাজুর রহমান, নুরুল ইসলাম, শ্যামল নাকি কমল বোসের।
দেশ স্বাধীন হওয়ার কয়েক দিন আগের কথা। রাজাকারদের খবরের ভিত্তিতে পাকিস্তানি সেনারা হানা দেয় কাশেমের চায়ের দোকানটিতে। কাশেম মোল্লার ভাষায়, ‘‘পাকিস্তানি সেনারা আমারে হুংকার দিয়া অশ্রাব্য ভাষায় গালি দিয়া বলে, তোম এধার আও, তোমহারা দোকান মে রেডিও বাজতা হায়, শাল্যে, তুমকো খতম কারদে গা, তুম রেডিও নিকালো।’ সেনাদের কথায় আমার তো জানে পানি নাই। ভেবেছিলাম, মাইরে ফেলবি। আমি কলেম, ও চিজ হামারা নেহি হে, আদমি লোক খবর লেকে আতা হে, শুনালকে লেকে চলে যাতা হে।’
কাশেমের কথায় তারা আরও উত্তেজিত হয়ে ওঠে। হাতের রোলার আর রাইফেলের বাঁট দিয়ে তারা কাশেমের ডান পায়ে আঘাত করতে থাকে। যন্ত্রণায় তিনি চিৎকার করে ওঠেন। সেই থেকে আজও তিনি ডান পায়ে ভর দিয়ে চলতে পারেন না। মুক্তিযোদ্ধা সংসদের ঈশ্বরদী উপজেলা কমান্ডার মো. আবদুর রাজ্জাকের মতে, মোল্লা একজন ত্যাগী মুক্তিযোদ্ধা, যাঁর হাতে অস্ত্র হিসেবে ছিল রেডিও আর নানা সংবাদ।
মুক্তিযুদ্ধের নানা স্মৃতি বুকে নিয়ে বেঁচে আছেন অন্য রকম এই মুক্তিযোদ্ধা। দিন কাটছে অভাব-অনটনের সঙ্গে যুদ্ধ করে। টাকার অভাবে পায়ের চিকিৎসাও থেমে গেছে। বিজয় ও স্বাধীনতা দিবস এলেই উপজেলায় নানা অনুষ্ঠানের আয়োজন চলে ঘটা করে। কিন্তু একজন কাশেম মোল্লার খোঁজ রাখে না কেউ।
লিখাটি প্রকাশিত হয়েছে প্রথমআলোতে ২ জানুয়ারি ২০১২
বিঃ দ্রঃ মৃত্যুর আগ পর্যন্ত এ মানুষটি পাননি মুক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতি। আবুল কাশেম মোল্লা রোগশোকে ভুগে ৬ ফেব্রুয়ারি ২০১৫ তারিখ ভোর চারটায় ৭৫ বছর বয়সে মৃত্যুবরণ করেন। তিনি চার ছেলে ও পাঁচ মেয়ে এবং অসংখ্য গুণগ্রাহী রেখে গেছেন।
© 2012 – 2021, https:.
GOOOOOOOOOD