মুক্তিযুদ্ধ

বুকের ভেতরটা এখনও কেঁপে ওঠে

‘ট্রেনিং শেষ। এবার রণাঙ্গনে যাওয়ার পালা। ইন্দ্রনগর ট্রেনিং ক্যাম্প হতে আমাকে পাঠানো হয় ৪ নং সেক্টারে। সেক্টর কমান্ডার ছিলেন বীর উত্তম সিআর দত্ত। সেখানে ৩০ জনের দল করে আমরা অপারেশন করি। আমার দলের লিডার ছিলেন মাহাবুব নুর সাদী। এখনও মনে পড়ে কানাইঘাট থানা অপারেশনের কথা। চোখের সামনে দেখেছি সহযোদ্ধাদের মৃত্যু যন্ত্রণা। জীবন বাজি রেখে করছিলাম যুদ্ধ। আমাদের ঠিকানা শুধুই স্বাধীনতা।

৫ মাস পেরিয়ে আসে ২২ সেপ্টেম্বর ১৯৭১ তারিখ। আমাকে বদলী করা হয় ৩ নং সেক্টরের হেড কোয়ার্টার হেজামারায়। কামান্ডার ছিলেন কে এম শফিউল্লাহ। সেখানে সাহসী মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে গড়ে তোলা হয় সেক্টর টুপস কোম্পানি। ৩ নং সেক্টরের কোম্পানি কমান্ডার ছিলেন জেনারেল মতিন ( সাবেক উপদেষ্টা )। তখন তিনি ছিলেন ক্যাপ্টেন। একটি কোম্পানির জন্য তিনি আমাকে বেছে নেন। আমার কোম্পানির নাম ছিল ইকো কোম্পানি।
আজমপুরে ছিল পাকিস্তান সেনাবাহিনীর শক্তিশালি ঘাঁটি। সেখান থেকে মাত্র ৫০০ গজ দূরে আমরা বান্কার বানানোর প্রস্ততি নেই। ছোট ছোট বেলচা ছিল আমাদের সঙ্গে। মাটি এত শক্ত ছিল যে কোদাল দিয়ে গর্ত করাই যাচ্ছিল না। তবুও দিনরাত খেটে দুদিনে মাত্র কয়েকটি বান্কার বানাই আমরা।
ডিসেম্বর ৩ তারিখ। আমাদের প্রস্ততি দেখতে আসেন কোম্পানি কমান্ডার মতিন স্যার। হঠাৎ পাকিস্তানিরা আমাদের লক্ষ্য করে সেল নিক্ষেপ করতে থাকে। একটি বান্কারে আমরা ছিলাম দুজন। নিজেকে রক্ষা করতে একজন সৈন্যসহ মতিন স্যার আশ্রয় নেন আমাদের বান্কারে। ছোট বান্কারে জায়গা হচ্ছিল না। আমি শরীরটাকে বাইরে রেখে কোন রকমে সামালে নিচ্ছিলাম। শোঁ শোঁ শব্দে গুলি আর সেল যাচ্ছিল শরীরের পাশ দিয়ে। এই বুঝি লেগে যাবে। কমান্ডার স্যার তখন চিৎকার দিয়ে বলে, ‘ওই সামসু তোমার শরীরটা একটু নামাও’। সে যাত্রায় ভারতীয় সৈন্যদের সার্পোটিং সেলে ও ফায়ারের কারণে বেঁচে যাই আমরা। কিন্ত তখনও জানি একদিন পরে কি ঘটবে।
ডিসেম্বরের ৪ তারিখ। একই জায়গায় চলছে তুমুল যুদ্ধ। পাকিস্তানিরা শত শত সেল নিক্ষেপ করছে। আমরাও বান্কার থেকে পাল্টা জবাব দিচ্ছি। হঠাৎ আমার বান্কার থেকে মাত্র দেড় হাত সামনে এসে পড়ে একটি সেল। ধুম করে একটি শব্দ হয়। চোখ ঝাপসা হয়ে আসে আমার। গোটা বান্কার ধসে পড়ে আমার ওপর। আমি চাপা পড়ি ঢালাই কবরে। সঙ্গীরা আমাকে পা ধরে টেনে বের করে আনে। আমার সারা শরীর অবশ হয়ে যাচ্ছিল। তখনও বুঝি নি স্পাইনাল কট ভেঙ্গে গেছে। ভাবিনি আমি আর কখনও দাঁড়াতে পারব না। আগরতলায় জিবি হাসপাতালের ডাক্তাররা বললেন, ‘যুদ্ধ আর করতে পারব না’। শুনেই বুকের ভেতরটা ধপ করে ওঠে। চোখ ভিজে যায় সহযোদ্ধা আর শহীদদের মুখগুলো স্মরণ করে।’

এভাবেই মুক্তিযুদ্ধের সময়কার স্মৃতিচারণ করছিলেন বীরপ্রতীক মোঃ সামসুদ্দিন। ১/৬, বীর উত্তম এ এন এম নুরুজ্জামান সড়ক, মোহাম্মদপুরের বাড়িতে বসে তাঁর সঙ্গে কথা হচ্ছিল মুক্তিযুদ্ধের নানা বিষয় নিয়ে।
বীরপ্রতীক সামসুদ্দিনের গ্রামের বাড়ি ব্রাহ্মণবাড়িয়ার জেলার বিজয়নগর উপজেলার বিষ্ণপুর গ্রামে। বাবা আজগর আলী ও মা লাতুনী বেগমের এই সন্তানটি ছোটবেলা থেকেই ছিল দুরন্ত।
সামসুদ্দিনের শৈশব কেটেছে বিষ্ণপুর গ্রামে। প্রথমে বিষ্ণপুর মডেল প্রাইমারি স্কুলে এবং পরে পড়াশুনা করেছেন মিশনারি হাই স্কুলে। এসএসসি পরীক্ষার্থী ছিলেন ১৯৬৪ সালের। কিন্ত নানা কারণে তখন পরীক্ষা দেয়া হয়নি। ফলে লেখাপড়ার ওখানেই ইতি। নেতাদের সঙ্গে ঘোরাঘুরি আর কন্ঠে আকাশে তুলে স্লোগান দিতেন, ‘সংগ্রাম সংগ্রাম চলবেই চলবেই’।
৬ মার্চ ১৯৭১। সামসুদ্দিনের বয়স তখন ৩১। দেশ ছিল পাকিস্তান কিন্ত নিয়ন্ত্রণ করতেন শেখ মুজিব।  দেলোয়ারসহ সিদ্ধান্ত হয় ঢাকা যাওয়ার। শীতের রাত। রাত পোহালেই শেখের ভাষণ। রাত তিনটায় ব্রাহ্মণবাড়িয়া থেকে চিটাগাং মেইল ট্রেনে চড়ে বসে দুই বন্ধু। কনকনে শীতের মধ্যে দাঁড়িয়েই চলে আসেন ঢাকাতে। সামসুদ্দিন বলেন, ‘আমরা ঢাকা পৌঁছাই ভোর ৭টায়। রেসকোর্স ময়দানে তখন বড় বড় বাঁশ দিয়ে নৌকা তৈরির কাজ চলছে। দুপুরের পর শুরু হয় ভাষণ। আমি ছিলাম মঞ্চ থেকে মাত্র ১০০ গজ দূরে। আহারে! কি সেই কন্ঠ! এখনও কানে বাজে। এবারের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম। গায়ের লোপ দাঁড়িয়ে যায়। মনে মনে তখনই ভেবেছি স্বাধীনতার জন্য ঘর ছাড়তে হবে।’
এপ্রিল ৯ তারিখ। দেশে তখন যুদ্ধ চলছে। বিষ্ণপুর গ্রামের চেয়ারম্যান বজলুর রহমান ভূইয়ার উৎসাহে মুক্তিযুদ্ধে যান সামসুদ্দিন। গ্রামের ১৮জন যুবকের সঙ্গে প্রথমে আখাউড়ার পূর্বপার্শ্বে  পার্বত্য ত্রিপুরার উষা বাজার শরণার্থী ক্যাম্পে এবং পরে চলে আসেন শিমলাতে। শিমলা ছিল ৩ নং সেক্টরের হেড কোয়ার্টার। ক্যাম্পের দায়িত্বে ছিলেন মেজর জেনারেল সৈয়দ মোহাম্মদ ইব্রাহিম। সেখানে ৭দিন চলে লেফটরাইট। সামসুদ্দিনের ভাষায়, ‘সৈয়দ মোহাম্মদ ইব্রাহিম তখন ছিলেন ল্যাফটেন্যান্ট। আমরা তাকে যমের মতো ভয় পেতাম। তিনি সবাইকে লাইন ধরে দাঁড় করিয়ে প্রশ্ন করতেন , ‘আমরা এখানে কেন এসেছি ?’ একদিন আমি উত্তরে বলি, ‘স্যার, আমরা মাতৃভূমিকে মুক্ত করতে এসেছি। ট্রেনিংয়ের সময় আমার এফএফ নং ছিল ৫৩৩৩।’
সামসুদ্দিন উচ্চতর ট্রেনিং নেন আসামের ইন্দ্রনগরে, ১মাস ৯দিন। ট্রেনিং করান বিগ্রেডিয়ার বাকছি। ট্রেনিং শেষে রণাঙ্গনের নানা স্মৃতি আজও তাকে তাড়া করে।
সেক্টর ট্রুপস এ থাকাকালীন এক রাতে পজিশন নিয়ে বসে আছি। অপেক্ষা কখন   শক্রুর দেখা মিলবে। বৃষ্টির রাত। বিদুৎ চমকাচ্ছে অবিবরত। আলোর ঝলকানিতে হঠাৎ চোখে পড়ে লোকমতো কে একজন দা দিয়ে কোপ দিতে আসছে। আলো সরে যেতেই মিলিয়ে যায় সে দৃশ্য। সামসুদ্দিন বলেন, ‘কয়েকবার দেখে খানিকটা ভয় পেয়ে যাই। এরপর যখনই দেখি তখনই তা লক্ষ্য করে গুলি করি। কিন্ত অবাক বিষয়, লোক তো আর মরে না। বিদ্যুৎ চমকালে বার বার সে ফিরে আসে। দা দিয়ে কোপ দিতে চায়। আমিও গুলি করি। মনের মধ্যে অজানা এক আতন্ক। এভাবেই কেটে যায় সারা রাত। ভোরের দিকে দেখি, যেটাকে মানুষ মনে করে গুলি করছিলাম সেটি আসলে বটগাছের নিচে তৈরি করা হিন্দুদের এক কালী মূর্তি।’
স্মৃতির কথা বলতে বলতে এই বীরপ্রতীকের চোখ ভিজে যায় জলে। চোখের সামনে শহীদ হতে দেখেছেন নিজের সহযোদ্ধাদের । সামসুদ্দিন বলেন, ‘প্রতিনিয়ত মৃত্যু আমাদের তারা করে ফিরত। একজন অন্যজনকে আগে চিনতাম না। অথচ যুদ্ধ করছি এক হয়ে। কখনও কখনও অপারেশনে যাওয়ার পথে একে অন্যের দিকে তাকিয়ে থাকতাম। মনে মনে ভাবতাম এটাই বুঝি শেষ দেখা।’
অনেকেই তো মুক্তিযদ্ধে যায়নি। আপনি কেন গেলেন? এমন প্রশ্নের উত্তরে সামসুদ্দিন বলেন, ‘ ক্লাসের ক্যাপ্টেন, খেলার ক্যাপ্টেন আর যুদ্ধে যাওয়া সবার কাজ না। যারা উদ্যোগী, উৎসাহী ,প্রতিবাদী আর সাহসী তাদের পক্ষে এটা সম্ভব। তাই সে সময় যারা সাহসী ছিল তারাই শুধু দেশকে মুক্ত করতে যুদ্ধ করেছিল।’
মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা প্রসঙ্গে খোলামেলাভাবে নিজের মতামত ব্যক্ত করেন এই বীরপ্রতীক। সামসুদ্দিন বলেন, ‘ মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকাকরণের উপযুক্ত সময় ছিল স্বাধীনের পর পর। এরপরে তো মুক্তিযোদ্ধার গুয়ে যারা পা দিয়েছে তারাও মুক্তিযোদ্ধা হয়ে গেছে। স্বাধীনের পর সরকার বদল হয়। আওয়ামীলীগ আসুক কিংবা বিএনপি। সরকারের সঙ্গে সঙ্গে তালিকা বদলায়। মুক্তিযোদ্ধার সংখ্যা দিনে দিনে বাড়ে। এটি দুঃখজনক। আমার মতে এটা একটা অপকৌশল। সুবিধা দিয়ে তালিকা করে ভোট বাগানোর অপচেষ্টা। সেটি বিএনপিও করেছে, করেছে আওয়ামীলীগও।’
তিনি দুঃখ করে বলেন, ‘ আমি যুদ্ধ করে পঙ্গু হয়েছি দেশের স্বাধীনতার জন্য। আর অনেকে যুদ্ধ না করে কিংবা রাজাকার হয়েও সনদ পেয়েছে। তারা সরকারি ভাতা পেয়ে যখন বলে সামসু আমিও মুক্তিযোদ্ধা তখন মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে আমাদের আর কি থাকে।’
মুক্তিযুদ্ধের ৪০ বছর পর ভালো লাগা জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘স্বাধীনতা ও বিজয় দিবসে রাস্ট্রপতি ও প্রধান মন্ত্রীর পর পরই যখন আমরা পঙ্গু মুক্তিযোদ্ধারা স্মৃতিসৌধে ফুল দেই। সারা দেশে লালসবুজের পতাকা ওড়ে। তখন প্রাণটা ভরে যায়।’
৪০ বছর পরেও কিসে দুঃখ পান ? মুক্তিযোদ্ধা সামসুদ্দিন বলেন, ‘ বাবারে, যখন দেখি রাজাকার, আল বদর আর আল শামসদের ডাকা হচ্ছে যুদ্ধাপরাধী বলে, তাদের বিচার নিয়ে চলছে রাজনীতি। তখন খুবই কষ্ট লাগে। এই স্বাধীন দেশে মাথা নিচু করে বাঁচবে মুক্তিযোদ্ধারা আর বুক ফুলিয়ে রক্তচক্ষু দেখিয়ে টিকে থাকবে রাজাকাররা তা তো হতে পারে না। যুদ্ধাপরাধীর মতো সুমিষ্ট শব্দ নয় তাদের ডাকতে হবে খুনি ও ধ্বর্ষণকারী, লুটেরা বলে।’
সামসুদ্দিনের ভাষায়, ‘ রাজনীতিবিদদের দেশ প্রেম না থাকলে দেশ এগোবে না’। তিনি মনে করেন এদেশের পরবর্তী প্রজম্মের মধ্যে দেশপ্রেম আছে। তাই শত প্রতিবন্ধকতা থাকলেও দেশ এগিয়ে যাবে বলে এই মুক্তিযোদ্ধার আশা।

ছবি : জুবায়ের সুহান

লিখাটি প্রকাশিত হয়েছে ম্যাগাজিন সাপ্তাহিক এর চলতি সংখ্যায় এবং সচলায়তন.কমে

© 2012 – 2021, https:.

এই ওয়েবসাইটটি কপিরাইট আইনে নিবন্ধিত। নিবন্ধন নং: 14864-copr । সাইটটিতে প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো তথ্য, সংবাদ, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করলে আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।

Show More

Salek Khokon

সালেক খোকনের জন্ম ঢাকায়। পৈতৃক ভিটে ঢাকার বাড্ডা থানাধীন বড় বেরাইদে। কিন্তু তাঁর শৈশব ও কৈশোর কেটেছে ঢাকার কাফরুলে। ঢাকা শহরেই বেড়ে ওঠা, শিক্ষা ও কর্মজীবন। ম্যানেজমেন্টে স্নাতকোত্তর। ছোটবেলা থেকেই ঝোঁক সংস্কৃতির প্রতি। নানা সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠনের সঙ্গে জড়িত। যুক্ত ছিলেন বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র ও থিয়েটারের সঙ্গেও। তাঁর রচিত ‘যুদ্ধদিনের গদ্য ও প্রামাণ্য’ গ্রন্থটি ২০১৫ সালে মুক্তিযুদ্ধ ভিত্তিক মৌলিক গবেষণা গ্রন্থ হিসেবে ‘কালি ও কলম’পুরস্কার লাভ করে। মুক্তিযুদ্ধ, আদিবাসী ও ভ্রমণবিষয়ক লেখায় আগ্রহ বেশি। নিয়মিত লিখছেন দেশের প্রথম সারির দৈনিক, সাপ্তাহিক, ব্লগ এবং অনলাইন পত্রিকায়। লেখার পাশাপাশি আলোকচিত্রে নানা ঘটনা তুলে আনতে ‘পাঠশালা’ ও ‘কাউন্টার ফটো’ থেকে সমাপ্ত করেছেন ফটোগ্রাফির বিশেষ কোর্স। স্বপ্ন দেখেন মুক্তিযুদ্ধ, আদিবাসী এবং দেশের কৃষ্টি নিয়ে ভিন্ন ধরনের তথ্য ও গবেষণামূলক কাজ করার। সহধর্মিণী তানিয়া আক্তার মিমি এবং দুই মেয়ে পৃথা প্রণোদনা ও আদিবা।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

Back to top button