শহীদ আসাদ : গভীর শ্রদ্ধায় স্মরি তোমায়
আমানুল্লাহ আসাদুজ্জামান যিনি শহীদ আসাদ নামেই বেশি পরিচিত।তিনি আইয়ুবশাহীর পতনের দাবীতে মিছিল করার সময় জানুয়ারি ২০, ১৯৬৯ সালে পুলিশের গুলিতে নিহত হন। শহীদ আসাদ হচ্ছেন ১৯৬৯ সালের গণ-আন্দোলনে পথিকৃৎ তৎকালীন পূর্ব-পাকিস্তানের তিন শহীদদের একজন, অন্য দু’জন হচ্ছেন – শহীদ রুস্তম ও শহীদ মতিউর।
শহীদ আসাদ ১০ই জুন, ১৯৪২ইং সালে নরসিংদী জেলার শিবপুর থানার ধনুয়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তার ভাই অধ্যাপক মোহাম্মদ মনিরুজ্জামান মিঞা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (২০-তম) উপচার্য ও বাংলাদেশের একজন বিশিষ্ট কূটনীতিবিদ ছিলেন। শিবপুর উচ্চ বিদ্যালয় থেকে ১৯৬০ সালে মাধ্যমিক শিক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে উচ্চ শিক্ষার্থে জগন্নাথ কলেজ (বর্তমান জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়) ও মুরারী চাঁদ মহাবিদ্যালয়ের পড়াশোনা করেন।১৯৬৩ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে স্নাতক (সম্মান) শ্রেণীতে ভর্তি হয়ে ১৯৬৬ সালে বি.এ এবং ১৯৬৭ সালে এম.এ ডিগ্রী অর্জন করেন। এই বৎসরেই আসাদ ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি (ন্যাপ)এবংকৃষক সমিতির সভাপতি মওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাষানী’র নির্দেশনায় কৃষক সমিতিকে সংগঠিত করার লক্ষ্যে শিবপুর,মনোহরদী,রায়পুরা এবং নরসিংদী এলাকায় নিজেকে নিযুক্ত করেন।
ঢাকা’র সিটি কলেজে তিনি ১৯৬৮ সালে আরো ভালো ফলাফলের জন্যে ২য় বারের মতো এম.এ বা স্নাতকোত্তর ডিগ্রী অর্জনের জন্য চেষ্টা করছিলেন। ১৯৬৯ সালে মৃত্যুকালীন সময়ে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগে এম.এ শেষ বর্ষের ছাত্র ছিলেন তিনি। শহীদ আসাদ তৎকালীন ঢাকা হল (বতর্মান শহীদুল্লাহ হল) শাখার পূর্ব-পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়নের সভাপতি হিসেবে এবং পূর্ব-পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়ন (ইপসু-মেনন গ্রুপ), ঢাকা শাখার সাধারণ সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে নিবেদিত প্রাণ আসাদুজ্জামান গরীব ও অসহায় ছাত্রদের শিক্ষার অধিকার বিষয়ে সজাগ ছিলেন। তিনি শিবপুর নৈশ বিদ্যালয় নামে একটি নৈশ বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেন এবং শিবপুর কলেজ প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে স্থানীয় শিক্ষানুরাগী ব্যক্তিদেরকে সাথে নিয়ে আর্থিক তহবিল গড়ে তোলেন।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ৬-দফা দাবীর স্বপক্ষে এবং আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় অন্যান্য আসামীদের মুক্তি দাবীর আন্দোলনে আসাদের মৃত্যু পরিবেশকে আরো ঘোলাটে করে তুলে ও গুরুত্বপূর্ণ ঘটনায় রূপান্তরিত হয়। ৬ ডিসেম্বর, ১৯৬৮ সালে মাওলানা আবদুল হামিদ খান ভাষাণী’র ডাকে হরতাল আহ্বানের ফলে ব্যবসায়ীরা তাতে পূর্ণ সমর্থন জানায়। এ প্রেক্ষাপটে গভর্ণর হাউজ ঘেরাওয়ের ফলে ছাত্র সংগঠনগুলো পূর্ব থেকেই নতুন করে আন্দোলনের প্রস্তুতি নিয়েছিল।
৪ জানুয়ারি, ১৯৬৯ইং তারিখে ছাত্রদের ১১-দফা এবং বঙ্গবন্ধুর ৬-দফা দাবীর সাথে একাত্মতা পোষণ করে ছাত্র সংগঠনের নেতৃবৃন্দ, যাতে প্রধান ভূমিকা রাখেন শহীদ আসাদ।১৭ জানুয়ারি, ১৯৬৯ইং সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অনুষ্ঠিত বৈঠকে ছাত্ররা দেশব্যাপী সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধের ডাক দেয়। ফলে গভর্ণর হিসেবে মোনেম খান ১৪৪-ধারা আইন জারী করেন যাতে করে চার জনের বেশী লোক একত্রিত হতে না পারে।
পূর্ব পরিকল্পনা অনুসারে ২০ জানুয়ারি, ১৯৬৯ইং তারিখ দুপুরে ছাত্রদেরকে নিয়ে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজের পার্শ্বে চাঁন খাঁ’র পুল এলাকায় মিছিল নিয়ে অগ্রসর হচ্ছিলেন আসাদুজ্জামান। পুলিশ তাদেরকে চাঁন খাঁ’র ব্রীজে বাঁধা দেয় ও চলে যেতে বলে। কিন্তু বিক্ষোভকারী ছাত্ররা সেখানে প্রায় এক ঘন্টা অবস্থান নেয় এবং আসাদ ও তার সহযোগীরা স্বৈরাচারী সরকারের বিরুদ্ধে স্লোগান দিতে থাকে। ঐ অবস্থায় খুব কাছ থেকে আসাদকে লক্ষ্য করে এক পুলিশ অফিসার গুলিবর্ষণ করে। তৎক্ষণাৎ গুরুতর আহত অবস্থায় আসাদকে হাসপাতালে নেয়া হলে কর্তব্যরত চিকিতসক তাকে মৃত বলে ঘোষণা করেন।
হাজারো ছাত্র-জনতা আসাদের মৃত্যুতে একত্রিত হয়ে পুণরায় মিছিল বের করে এবং শহীদ মিনারের পাদদেশে জমায়েত হয়। কেন্দ্রীয় প্রতিরোধ কমিটি তাকে শ্রদ্ধা জানাতে ২২, ২৩ ও ২৪ জানুয়ারী সারাদেশে ধর্মঘট আহ্বান করে। ধর্মঘটের শেষ দিনে পুলিশ পুণরায় গুলিবর্ষণ করে। ফলশ্রুতিস্বরূপ আসাদের মৃত্যুতে ফিল্ড মার্শাল আইয়ুব খান সরকার দু’মাসের জন্য ১৪৪-ধারা আইনপ্রয়োগ স্থগিত রাখতে বাধ্য হয়।
শোকাতুর ও আবেগে আপ্লুত অগণিত ছাত্র-জনতার মিছিলে শহীদ আসাদের রক্তমাখা শার্ট দেখে বাংলা সাহিত্যের আধুনিক কবি শামসুর রহমান তাঁর অমর কবিতা “আসাদের শার্ট” লিখেন। এছাড়াও, বাংলাদেশের অন্যতম কবি হেলার হাফিস এ ঘটনায় ক্রোধে ফেঁটে পড়েন এবং ক্ষোভ প্রকাশ করে কালজয়ী “নিষিদ্ধ সম্পাদকীয়“ কবিতাটি লিখেন। ছাত্র আন্দোলনে আসাদের মৃত্যুতে প্রত্যক্ষদর্শী হিসেবে বাংলাদেশের অন্যতম জনপ্রিয় আলোকচিত্র শিল্পী প্রয়াত রাশীদ তালুকদার তার ক্যামেরায় স্থিরচিত্র হিসেবে ছাত্র-জনতার দীর্ঘ মিছিলসহ আসাদের শার্টের ছবি ওঠান।
বাংলাদেশের অনেক জায়গায় জনগণ আইয়ুব খানের নামফলক পরিবর্তন করে শহীদ আসাদ রাখে বিশেষতঃ জাতীয় সংসদ ভবনের ডান পার্শ্বে অবস্থিত আইয়ুব গেটের পরিবর্তে আসাদ গেট রাখা হয়। এছাড়াও, আইয়ুব এভিন্যিউ’র পরিবর্তে আসাদ এভিন্যিউ এবং আইয়ুব পার্কের পরিবর্তে আসাদ পার্ক নামকরণ করা হয়। ১৯৭০ সালে ১ম শহীদ আসাদ দিবসে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের প্রধান ফটকে জনগণ “ঊনসত্তরের গণ-অভ্যুত্থানের স্মারক ও অমর আসাদ” শিরোনামে একটি স্মৃতিফলক নির্মাণ করে যেখানে আসাদ গুলিতে নিহত হয়েছিলেন। শিবপুর ও ধনুয়া এলাকার স্থানীয় লোকজন ১৯৭০ সালে শিবপুর শহীদ আসাদ কলেজ নামে একটি মহাবিদ্যালয় এবং ১৯৯১ সালে আসাদের নিজের গ্রাম ধনুয়া’য় স্থানীয় অধিবাসীরা ” শহীদ আসাদ কলেজিয়েট গার্লস স্কুল ও কলেজ” প্রতিষ্ঠা করে।
প্রতি বছরই জানুয়ারির ২০ তারিখে শহীদ আসাদের মহান আত্মত্যাগ ও অবদানকে বাঙ্গালী জাতি অত্যন্ত গুরুত্ব সহকারে ও গভীর শ্রদ্ধায় শহীদ আসাদ দিবস পালন করে থাকে।
লিখা ও ছবি : সংগৃহীত
© 2012 – 2021, https:.