আদিবাসী

হাজং বিশ্বাসে রংধনু এবং অন্যান্য

পাহাড়গুলো অন্যরকম। শক্ত তার দেহ, কিন্তু কদাকার নয়। সবুজ গাছের সঙ্গে নেই কোনো বন্ধুত্ব। অথচ চারপাশে সবুজের রাজত্ব। সবুজের মাঝে পাহাড়গুলোকে রূপসী রমণীর মতো দেখায়। লাবণ্যময়ী এ পাহাড়ের গায়ের রং ফর্সা। স্পর্শ করলেই হাতে পড়ে পাউডারের মতো সাদা প্রলেপ।

একটি পাহাড় আরেকটি পাহাড়ের সঙ্গে লাগানো। গতরাতে বৃষ্টি হয়েছে। তাই দুই পাহাড়ের মাঝে জমেছে বৃষ্টির পানি। পানির রং, সে তো অপরূপ। একেবারে নীলাভ সবুজ। সুইজারল্যান্ডের কোনো দ্বীপে চলে আসলাম নাকি ! স্বপ্নের মতো দেখায় চিনামাটির সাদা পাহাড়গুলোকে।
পাহাড়গুলো দেখতে যতটা সুদৃশ্য, পাহাড়ে থাকা মানুষের বাড়িগুলো কিন্তু ততটা সুদৃশ্য নয়। ঘরগুলো  মাটি আর ছনে ছাওয়া। ঘরের অবয়বে কোনো বর্ণিলতা নেই। অধিকাংশই ভাঙ্গাচোরা। বৃষ্টির পানি চুইয়ে পড়ে ঘরের ভেতর। তব্ওু আদিবাসী হাজংরা মাটি আঁকড়ে বেঁচে আছে এই পাহাড়ের বুকে।
বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের বন্ধুদের একটি দলের সঙ্গে এসেছি নেত্রকোনার দুর্গাপুরে।  জমিদারবাড়ি আর মণি সিংহের স্মৃতিসৌধ দেখে আমরা বেরিয়ে পড়ি চিনামাটির পাহাড় আর হাজং গ্রাম দেখতে। গাইড হিসেবে সঙ্গী হন স্থানীয় নাট্যকর্মী গোপাল।
দুর্গাপুরের বিরিশিরিতে ঘুরতে মোটরসাইকেলের কোনো বিকল্প নেই। আমরাও মোটরসাইকেল ভাড়া করি। শিবগঞ্জ গুদারা পার হয়ে কামারখালির পথ পেরোতেই হাজং মাতা রাশিমণির স্মৃতিসৌধ ঠেকে। স্মৃতিসৌধে খানিকটা নীরবতা। অতঃপর মেঠোপথ পেরিয়ে আসি কুল্লাগড়া ইউনিয়নে। এখানেই রয়েছে চিনামাটির পাহাড়গুলো। আমরা চলে আসি ইউনিয়নের একেবারে শেষপ্রান্তে, সীমান্তবর্তী একটি গ্রামে।
গ্রামের নাম বগাউড়া? কেন এমন নামকরণ তা জানা নেই স্থানীয়দের। গতরাতে ঝুম বৃষ্টি হয়েছে। মেঘ কাটিয়ে এখন ঝলমলে রোদ উঠেছে। গ্রামের পুব আকাশে হঠাৎ একটি রংধনু দেখা গেল। তা দেখে হাজং গ্রামের ছেলেমেয়েদের সে কি আনন্দ। যে যার বাড়ির উঠোন থেকে দেখছে তা। রংধনু সৌন্দর্যে বাড়ির বৃদ্ধাদের মুখেও হাসি।
গোপালের পরিচিত একটি হাজং পরিবার থেকে পাহাড়ের পূর্বকোণে। পাহাড় কাটা রাস্তায় আমরা ধীর পায়ে চলে আসি হাজং বাড়িটিতে। বাড়ির ভেতরটাতে আবাল-বৃদ্ধদের যেন সম্মিলন ঘটেছে। আশপাশের বাড়ির অনেকেই এখানে। সবাই রংধনু দেখছে আর নিজেদের মধ্যে আলাপ জমিয়েছে ভিন্ন কোনো ভাষায়।
একটি ঘরের ভেতর থেকে বেরিয়ে আসেন সত্তরোর্ধ্ব এক বৃদ্ধ। নাম মোহন হাজং। এখনও বেশ শক্ত সামর্থ্য। বয়সের ভার তাকে নোয়াতে পারেনি। তাকে ঘিরে ভিড় জমায় সবাই। ঘরের বারান্দাতে মাদুরে বসে তিনি বলতে শুরু করেন কিছু একটা। সবার মতো আমরাও উঠোনের এককোণে বসে শুনি।

হাজংদের মাচাঘর
হাজংদের মাচাঘর

বাড়ির গৃহবধূ সুপতা হাজং। গোপালের বিশেষ পরিচিত সে। সুপতা জানাল তার শ্বশুর মোহন হাজং সবাইকে শোনাচ্ছে রংধনু নিয়ে হাজং সমাজের উপকথাগুলো। সুপতার জবানীতে উপকথার ভাবার্থ অনেকটা এরকম;
এক দেশে ছিল এক রাজা। রাজার ছিল এক ছেলে আর এক মেয়ে। ছোটবেলা থেকেই মেয়েটা ছিল বেজায় সুন্দরী। তার আলোকছটা রূপে অন্ধকার ঘরেও কোনো আলোর প্রয়োজন পড়ত না। তার রূপের আলোয় আলোকিত হতো চারপাশ।
দিন গড়িয়ে চলে। রাজার ছেলেমেয়েও বড় হতে থাকে। যৌবনে রাজার মেয়ের রূপ যেন আছড়ে পড়ে চারপাশে। খুব কাছ থেকে তা দেখে রাজার ছেলে মনে মনে ভালোবাসতে থাকে নিজের বোনকেই।
রাজা তার ছেলেমেয়েকে সবসময় ভালোবাসা দিয়ে আগলে রাখেন। কখনও তাদের চোখের আড়াল করেন না। সকাল থেকে ঘুমাতে যাওয়ার পূর্ব পর্যন্ত ছেলেমেয়েকে কাছে কাছে রাখতেন।
ভাইয়ের আচরণে বোনও টের পেয়ে যায়। নিজের ভাই বোনের প্রেমে মত্ত। এ যে বড়ই লজ্জার ব্যাপার! টের পেয়ে রাজার মেয়ে নিজেকে সামলে রাখেন। কিন্তু মুখ ফুটে সে কথা কাউকে বলতে পারেন না। এদিকে বোনের রূপে ভাইয়ের পাগল হওয়া অবস্থা।
একদিন ঘটল এক কাণ্ড। খাওয়ার সময় পেরিয়ে যাচ্ছে অথচ খাওয়ার ঘরে রাজপুত্র নেই। রাজা চিন্তিত হয়ে পড়েন। খোঁজ নিয়ে জানতে পারলেন ছেলে নাওয়া-খাওয়া ভুলে নিজ ঘরে খিল এঁটে বসে আছে। রাজা গিয়ে অনুরোধ করার পরেও রাজপুত্র দরজা খুললেন না। রাজা এপাশ থেকে জানতে চাইলেন , ‘হাতি, ঘোড়া, টাকশালের টাকা – তুমি কী চাও? যা চাবে তাই পাবে।’ উত্তরে রাজপুত্র নিজের রূপসী বোনকে বিয়ে করার প্রস্তাব করে। ছেলের প্রস্তাবে রাজার মাথায় যেন বাজ পড়ে। আদরের ছেলের একি উন্মাদনা! সে সময় ছেলেকে শান্ত করতে রাজা সে প্রস্তাবে রাজি হন। কিন্তু ভেতরে ভেতরে তিনি ছেলের জন্য অন্য পাত্রী ঠিক করে ফেলেন। অন্যত্র বিয়ে হলে হয়ত রাজপুত্রের উন্মাদনা আর থাকবে না। তেমনটাই চিন্তা রাজার।
রাজবাড়িতে রাজপুত্রের বিয়ের ধুমধাম। এর মধ্যেই রাজপুত্র জেনে ফেলে তার জন্য অন্য পাত্রী ঠিক করা হয়েছে। তার সঙ্গেই আজ তার বিয়ে হবে। রাজার ছেলে তখন ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে। বিয়ের পোশাক ফেলে সে তার রূপসী বোনের খোঁজ করতে থাকে।
বোন তখন পুকুর ঘাটে স্নান করছিল। তার ভাই রাজপুত্র সেখানে গিয়েই বোনকে বিয়ের কথা বলে। শুনেই বোনের হৃদয় কেঁপে ওঠে। নিজের আপন বড় ভাইকে সে কি বলবে। রাজার মেয়ে তখন অশ্রুসজল চোখে মহাদেবকে স্মরণ করে। তার কৃপা প্রার্থনা করে। ঠিক তখনই মহাদেবের আশীর্বাদ নেমে আসে। রাজকন্যা পুকুরের জল থেকে সে আশীর্বাদের শক্তিতে আকাশের দিকে উঠতে থাকে। এভাবে এক সময় সে আকাশের মাঝে অদৃশ্য হয়ে যায়।
হাজংরা বিশ্বাস করে এখনও আকাশ থেকে মাঝে মাঝে স্নানের দৃশ্য মনে হলে জলকণার স্মৃতিতে রাজার মেয়ে রংধনু হয়ে ফুটে ওঠে। রংধনু নিয়ে এটিই হাজংদের আদি বিশ্বাস। রংধনু তৈরির আধুনিক বৈজ্ঞানিক তত্ত্বের সঙ্গে যার অনেকটাই মিলে যায়।
বৃদ্ধর কথা শেষ হতেই সকলের মুখে হাসি। পাশ থেকে তখন সুপতা জানান। রাজার মেয়ে যখন আকাশে উঠছিল তখন পিছু ডাকছিল তার রাজপুত্র ভাই। নিজের ভাইকে আকাশ থেকে সে তখন ধমক দিচ্ছিল। রাজকন্যার সে ধমক  আজও বজ্রের সঙ্গে মিশে আছে। তাই হাজংদের কাছে বজ্রপাত হলো রাজকন্যার ধমক।
আবার রাজকন্যা যখন আকাশে উঠছিল তখন তার চোখেমুখে ফুটে ছিল লম্পট ভাইয়ের হাত থেকে মুক্তি পাওয়ার আনন্দ। তার সে আনন্দ আর মুখের হাসি ফুটে উঠছিল বিদ্যুতের ঝলকানিতে। হাজংদের বিশ্বাসে সেটিই বিদ্যুৎ চমকানো আলো।
গল্প তখনও চলছিল। আমরা আলাপ জমাই পাশে বসা সুদীপ হাজংয়ের সঙ্গে। পাহাড়ের ওপারেই তার বাড়ি। তার হাতে বাঁশের তৈরি ঢালার মতো কিছু একটা। সুদীপ জানায় হাজং ভাষায় এটি ‘যাক্ষা’। যাক্ষা দিয়ে নদীতে মাছ ধরে যা পান তাই দিয়ে চলে তার সংসার। সুদীপ কথা বলে বাংলা ও হাজং ভাষার সংমিশ্রণে। চারদিকের বাংলা ভাষার আধিক্যে হারিয়ে যেতে বসেছে তার মায়ের ভাষাটিও।
হাজংরা মঙ্গোলীয় জাতির হলেও এদের ভাষা ইন্দো-ইউরোপীয়। কাছারের (আসাম) ভাষার অসংখ্য শব্দ এই ভাষায় ব্যবহৃত হয়। এদের জীবন প্রণালির সঙ্গে গারো ও কোচদের অনেক মিল আছে। হাজংরা বিশ্বাস করে এক সময় তাদের ভাষা অন্যরকম ছিল। কিন্তু আসামের হাজোনগর ছেড়ে ময়মনসিংহ ও গারো পাহাড় সংলগ্ন এলাকায় বসতি গড়ার সঙ্গে সঙ্গে এদের ভাষারও পরিবর্তন ঘটে। দীর্ঘদিন বাঙালি সমাজের সঙ্গে বসবাসের কারণে কোনো কোনো বাংলা শব্দের সঙ্গে হাজং শব্দের, হাজং শব্দের সঙ্গে অহমিজ শব্দের এবং অহমিজ শব্দের সঙ্গে বাংলা শব্দের মিল তৈরি হয়।
কথায় কথায় সুপতা হাজং জানাল, অন্যান্য আদিবাসী সম্প্রদায়ের মতো হাজংরাও বিয়ের অনুষ্ঠানে কুলার মধ্যে ধান, দুর্বা, আতপ চাউল, মিষ্টি, সিঁদুর ইত্যাদি দিয়ে বর-কনেকে বরণ করে। হাজংদের কাছে এটি একটি আবশ্যিক বিষয়। এরা বিশ্বাস করে ধান, দুর্বা, আতপ চাউলে রয়েছে জীবন-সার, সিঁদুর যৌন ও বিজয় চিহ্ন। তাই এই আচারের মাধ্যমে ভাবি দম্পতির ভবিষ্যৎ জীবন ধনে-ধান্যে পরিপূর্ণ হবে তেমনটাই কামনা করা হয়।
সুদীপ জানাল হাজংদের বিশ্বাসে পৃথিবী কেঁপে ওঠার কারণটি। হাজংরা বিশ্বাস করে পৃথিবীটা বিরাট এক ষাঁড়ের মাথায় অবস্থান করে। এই ষাঁড় যখন পৃথিবীর ভারসাম্য রক্ষা করতে না পেরে ঝাঁকুনি দেয় ঠিক তখনই পৃথিবী কেঁপে ওঠে। আর আমরা এটাকে বলি ভূমিকম্প। সুদীপের ভাষ্য এখন ভূমিকম্প কি হবে! আমরা মানুষই তো সব ভূমি কেটে নষ্ট করে ফেলছি।
আসর ভাঙতেই কথা হয় বৃদ্ধা মোহন হাজংয়ের সঙ্গে। তিনি দুঃখ করে বললেন এক সময় এ অঞ্চলে ছিল বড় বড় পাহাড়। ছিল চিনামাটির প্রাকৃতিক সম্পদ। দিনে দিনে তা কেটে পুকুর করে ফেলা হচ্ছে। পাহাড়ে থাকা আদিবাসীরা জীবন বাঁচাতে নেমে আসছে সমতলে।
মোহন হাজংয়ের সঙ্গে আমরাও একমত হই। প্রাকৃতিক সম্পদের লোভে মানুষ প্রকৃতিকে যেভাবে হত্যা করছে যার পরিণতি হবে ভয়াবহ। এক সময় হয়ত প্রকৃতিই ফিরিয়ে দেবে তার কাঙ্খিত জবাবটি।

লিখাটি প্রকাশিত হয়েছে সাপ্তাহিকে ২২ মার্চ ২০১২

© 2012 – 2018, https:.

এই ওয়েবসাইটটি কপিরাইট আইনে নিবন্ধিত। নিবন্ধন নং: 14864-copr । সাইটটিতে প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো তথ্য, সংবাদ, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করলে আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।

Show More

Salek Khokon

সালেক খোকনের জন্ম ঢাকায়। পৈতৃক ভিটে ঢাকার বাড্ডা থানাধীন বড় বেরাইদে। কিন্তু তাঁর শৈশব ও কৈশোর কেটেছে ঢাকার কাফরুলে। ঢাকা শহরেই বেড়ে ওঠা, শিক্ষা ও কর্মজীবন। ম্যানেজমেন্টে স্নাতকোত্তর। ছোটবেলা থেকেই ঝোঁক সংস্কৃতির প্রতি। নানা সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠনের সঙ্গে জড়িত। যুক্ত ছিলেন বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র ও থিয়েটারের সঙ্গেও। তাঁর রচিত ‘যুদ্ধদিনের গদ্য ও প্রামাণ্য’ গ্রন্থটি ২০১৫ সালে মুক্তিযুদ্ধ ভিত্তিক মৌলিক গবেষণা গ্রন্থ হিসেবে ‘কালি ও কলম’পুরস্কার লাভ করে। মুক্তিযুদ্ধ, আদিবাসী ও ভ্রমণবিষয়ক লেখায় আগ্রহ বেশি। নিয়মিত লিখছেন দেশের প্রথম সারির দৈনিক, সাপ্তাহিক, ব্লগ এবং অনলাইন পত্রিকায়। লেখার পাশাপাশি আলোকচিত্রে নানা ঘটনা তুলে আনতে ‘পাঠশালা’ ও ‘কাউন্টার ফটো’ থেকে সমাপ্ত করেছেন ফটোগ্রাফির বিশেষ কোর্স। স্বপ্ন দেখেন মুক্তিযুদ্ধ, আদিবাসী এবং দেশের কৃষ্টি নিয়ে ভিন্ন ধরনের তথ্য ও গবেষণামূলক কাজ করার। সহধর্মিণী তানিয়া আক্তার মিমি এবং দুই মেয়ে পৃথা প্রণোদনা ও আদিবা।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

Back to top button