পাহাড়িয়া গ্রামে রক্ষা গোলা
চৈত্র মাস। দিনভর গরম। কিন্ত রাতে শীত শীত ভাব। ভোরের দিকে এখনও কুয়াশা পড়ছে। রাজশাহীর আবহাওয়া এর আগে কখনও এমনটা হয়নি। সময়ের সঙ্গে বদলে যাচ্ছে দেশের আবহাওয়া। বদলে যাচ্ছে প্রকৃতি। প্রকৃতির সঙ্গে সঙ্গে বদলাচ্ছে মানুষের জীবন প্রবাহ।
রাজশাহী এসে আদিবাসী গ্রামের খোঁজ করছিলাম। বন্ধু কাজিমের উৎসাহে সহজেই মিলে রাজকুমার শাও এর মুঠোফোনের নম্বরটি। তিনি এখানকার আদিবাসী উন্নয়ন সংস্থার নির্বাহী পরিচালক। কাজ করেন আদিবাসীদের ভাগ্যোন্নয়নের জন্য। মুঠোফোনে তাদের কাজ নিয়ে চলে নানা আলোচনা। কথায় কথায় তার কাছ থেকে জানলাম গোলাই গ্রামটির কথা। সে গ্রামটিতে নাকি পাহাড়িয়া সম্প্রদায়ের ষাটটি আদিবাসী পরিবারের বাস। এই আদিবাসী সম্প্রদায়টিকে অনেকে পাহাড়ি বলেও ডাকে। আমরা যেতে আগ্রহী হই। বন্ধু কাজিম ভালোভাবে জেনে নেয় গোলাই গ্রামে যাওয়ার ঠিকানাটি।
রাজশাহী শহর হতে গোলাই গ্রামটি ১০ কিলো ভেতরে। শহরের রাস্তা ধরে কাশিয়াডাঙ্গা মোড় হয়ে কাকনহাট রোডে পড়বে দামকুড়া হাট। সেটি পেরোলেই বামদিকের পথ ধরে এগোলে মিলবে ধামিলা গ্রাম। এই ধামিলা গ্রামের পরের গ্রামটিই গোলাই গ্রাম।
গোদাগাড়ি উপজেলার দেওপাড়া ইউনিয়নের গোলাই গ্রামে যখন আমরা পৌঁছি তখন মধ্য বিকেল। মাটি আর ছনে ছাওয়া ছোট ছোট ঘর। গরমের মধ্যেও ঘরগুলোতে শীতল পরিবেশ। একটি ঘরের বারান্দাতে গা এলিয়ে বসে আছে বেশ কয়েকজন বৃদ্ধা। পাশেই সামান্য উঁচুতে রাখা আছে বড় একটি টেলিভিশন। একদল শিশু ও নারী দলভেদে উপভোগ করছে ডিশ বিনোদনের অনুষ্ঠানগুলো।
‘উজান ভাটি’ ছবির গান চলছিল তখন। সবাই একমনে সেদিকে তাকিয়ে। আমরা খানিকটা অবাক হই। হিন্দি সংস্কৃতির আগ্রাসী থাবা থেকে আজ রক্ষায় পায়নি আদিবাসী গ্রামগুলোও।
গ্রামের প্রধান কে? খোঁজ করতেই সাহায্যে এগিয়ে আসে কয়েকজন যুবক। তাদের সঙ্গে আমরা চলে আসি পাহাড়িয়া গ্রামের শেষ প্রান্তের একটি বাড়িতে। বাড়ির ভেতর থেকে বেড়িয়ে আসেন গ্রাম প্রধান। অপরিচিত মুখ দেখে তিনি খানিকটা চিন্তিত। রাজকুমার শাও এর পরিচয়ের কথা জানতেই তিনি স্বাভাবিক হতে থাকেন।
গ্রাম প্রধানের নাম রঘুনাথ সিং। বয়স ষাটের মতো। পিতা দিয়াঋষি সিং ও মা পদ্যরাণী সিংয়ের আদরের সন্তান রঘুনাথের জন্ম তানোরের কচুয়া গ্রামে। এক সময় সেখানে স্থানীয় বাঙালিদের সঙ্গে জমি নিয়ে চলে নানা বিরোধ। ফলে নিজ জায়গায় টিকতে পারে না রঘুনাথের পরিবার। জীবনের তাগিদে তাই চলে আসেন গোলাই গ্রামের শ্বশুড় বাড়িতে।
পাহাড়িয়া বা পাহাড়ি সম্প্রদায়ের গ্রামগুলো পরিচালিত হয় একটি গ্রাম পরিষদের মাধ্যমে। এক সময় এ পরিষদের ছিল বেশ কয়েকটি পদ। কিন্ত সময়ের সঙ্গে সেই গ্রাম পরিষদও আজ দুর্বল হয়ে পড়েছে। বর্তমানে পাহাড়িয়াদের গ্রামগুলো পরিচালিত হচ্ছে গ্রাম প্রধান বা মোড়ল ও সাকিদার পদ নিয়ে। আদিবাসী গ্রামের সকলের নিকট নানা খবরাখবর পৌঁছে দেয়ার দায়িত্ব থাকে সাকিদারের। গোলাই গ্রামের সাকিদার বীরেন কুমার সিংয়ের সঙ্গে আমাদের দেখা না হলেও নানা বিষয়ে কথা চলে মোড়ল রঘুনাথ সিংয়ের সঙ্গে।
জানা যায় পাহাড়িয়াদের এই গ্রামটিতে যাদের নিজস্ব জায়গা নেই তাদের বসতবাড়ির জায়গা দিয়েছে অন্য আদিবাসীরা। সে অর্থে পাহাড়িয়ারা নিজেদের টিকিয়ে রাখতে আশ্রয় দিচ্ছে অন্য ভূমিহীন আদিবাসী পাহাড়িয়া পরিবারগুলোকে। এভাবে আদিবাসীরাই আজ সচেতন হয়েছে নিজেদের অস্তিত্ব রক্ষায়। ফলে এক ধরণের ঐক্য তৈরি হয়েছে আদিবাসী পাড়াগুলোতে।
পাহাড়িয়াদের বিয়ে, জন্ম, মৃত্যু, পূজা, বিচারসহ নানা আনুষ্ঠানিকতায় গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করতে হয় গোত্রের মোড়লকে। এদের মোড়ল নির্বাচন হয় গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে, সকলের মতামতের ভিত্তিতে। মোড়লের ছেলে মোড়ল হয় কিনা প্রশ্ন করতেই রঘুনাথ উত্তরে বলেন, ‘যোগ্যতা থাকলে হয়। তবে সেটি কোন নিয়ম নয়। সকলে মিলে আলোচনা করে মোড়ল নির্বাচন করাই পাহাড়িয়াদের নিয়ম।’ রঘুনাথ সিং নিজে মোড়লের দায়িত্ব পালন করলেও তার বাবা গোত্রের কোন পদেই ছিলেন না।
পাহাড়িয়ারা আর কোথায় আছে? পাহাড়িয়াদের পূর্বপুরুষরা এদেশে এসেছে ভারতে মুর্শিদাবাদ, নদীয়া, মালদহো হতে। গোলাই গ্রাম ছাড়াও রাজশাহীর জামদাহ, কানাপাড়া, খৈড়া কান্দিতে রয়েছে পাহাড়িয়াদের আরো গ্রাম। গোত্রের মোড়লের ভাষায়, ‘যত পুবে যাবেন তত পাহাড়ি বেশি, পশ্চিমে তেমন একটা নেই পাহাড়িয়ারা ’।
পাহাড়িয়ারা মূলত কৃষিকাজের ওপর নির্ভরশীল। এ গ্রামের অধিকাংশেরই নিজের আবাদি জমি নেই। ফলে ফসল লাগানো ও ফসল তোলার সময় অন্যের জমিতে কাজ করে যা পায় তা দিয়েই চলে তাদের সংসার। অন্যান্যদের মতো এ সম্প্রদায়ের পুরুষ ও মহিলা উভয়েই মাঠে কাজ করে। পাশাপাশি মহিলাদের রান্নাসহ ঘরের সকল কাজও করতে হয়।
আদিবাসী সমাজে বছরে তিন থেকে চার মাস থাকে অভাব। অভাবের সময়টা কখন? রঘুনাথ জানান ফসল লাগানোর পর থেকে ফসল কাটার আগ পর্যন্ত। এ সময়টাতে পাহাড়িয়াদের কোনো কাজ থাকে না। তাই চৈত্র – বৈশাখ আর আশ্বিন- কার্তিক এখানকার পাহাড়িয়া আদিবাসীদের অভাবের মাস।
অভাবের মাসে টিকে থাকতে আদিবাসীদের খাদ্যের জন্য ধরণা দিতে হয় মহাজনদের বাড়ি বাড়ি। আগাম শ্রম বিক্রি ছাড়াও মহাজনদের কড়া শর্ত মেনেই চাল ধার নিতে হয় আদিবাসীদের। রঘুনাথের ভাষায়, ‘এক মণ চাল খেলে দিতে হয় দেড় মণ’। ফলে আদিবাসীদের ভাগ্য আটকে থাকে মহাজনদের সুদচক্রে।
গোত্রের মোড়ল দৃঢ়কন্ঠে জানালেন এ গ্রামের পাহাড়িয়ারা অভাবের সময়টাতে এখন আর মহাজনদের কাছে যান না। কিভাবে তারা অভাব মেটান? জানতে চাইলে তিনি আমাদের নিয়ে যান গ্রামের ভেতরের দিকটাতে।
বড় একটি মাটির ঘর। ঘরের বাইরে সাদা রঙে নানা ধরণের আলপনা আঁকা। এটিই পাহাড়িয়াদের রীতি। ঘরটির দরজার পাশে একটি লিখার দিকে আমাদের দৃষ্টি আটকে যায়। সেখানে লিখা ‘গোলাই রক্ষা গোলা’।
রক্ষা গোলাটা কি? ঘরের বারান্দায় বিছানো মাদুরে বসতে বসতে রঘুনাথ সিং জানালেন, এটি তাদের মুষ্টি সমিতি। আদিবাসীদের অভাব মেটাতে তিন বছর আগে গ্রামের ৫০টি পরিবারকে নিয়ে গঠিত হয়েছে এই সমিতিটি। অভাবের সময়ে এই সমিতিই পাহাড়িয়াদের রক্ষার কাজ করে তাই সমিতির এমন নামকরণ।
গোত্রের মোড়ল জানায় রক্ষা গোলায় প্রতিদিন পরিবার প্রতি এক মুষ্টি চাল হিসেবে সপ্তাহে আধা কেজি চাল জমা দিতে হয়। এটিই সমিতির সঞ্চয়। অভাবের মাসে এই চালই ধার হিসেবে বিতরণ করা হয় দরিদ্র আদিবাসী পরিবারগুলোর মাঝে। মোড়লের ভাষায়, ‘যখন অভাব থাকে তখন এই রক্ষা গোলার সদস্যরা এখান থেকে চাল নিয়ে পরিবার চালায়। তিন চার মাস পর তাদেরকে আবার এই চাল ফেরত দিতে হয়।’ ফলে অভাবের সময়টাতে এ গ্রামের পাহাড়িয়াদের এখন আর মহাজনদের সুদের জালে আটকে থাকতে হয় না।
কথায় কথায় হাজির হন যুবক বয়সী শ্যামল কুমার সিং। কথা হয় তার সঙ্গে। শ্যামল বিএ পাশ করেছে রাজশাহী কলেজ থেকে। রক্ষা গোলার হিসাব রক্ষার দায়িত্বটি তার ওপর। শ্যামল জানালো রক্ষা গোলা গঠনের পেছনের কথা।
গোলাই গ্রাম থেকে চার কিলো ভেতরে রয়েছে আরেকটি আদিবাসী গ্রাম। নাম নিলকুরি গ্রাম। সেখানে বাস করে শতাধিক উরাও পরিবার। সে গ্রামের প্রধান নিরঞ্জন কুজু। তার উদ্যোগেই উরাওরা সে গ্রামে প্রথম গড়ে তোলে একটি রক্ষা গোলা। দিনে দিনে মুষ্টি চালে সঞ্চয় করে সচ্ছতা আসে সে গ্রামের আদিবাসীদের।
একবার নিলকুর গ্রামের পাশেই কাজ করতে যায় পাহাড়িয়া গ্রামের মহিলারা। কথায় কথায় উরাওদের কাছ থেকে তারা মুষ্টি চালে সঞ্চয়ের কথা শুনতে পায়। সব জেনে গোলাই গ্রামের আদিবাসীরাও আগ্রহী হয়। ফলে পরবর্তীতে মোড়ল রঘুনাথসহ অন্যরা যায় সেখানে। রক্ষা গোলা তৈরিতে ওই গ্রামের নিরঞ্জন কুজু তাদের সব রকম সহযোগিতা করেন। সে থেকেই শুরু। এভাবেই মুষ্টি চালে বদলে যাচ্ছে আদিবাসী গ্রামের চিত্রগুলো। ধর্মান্তরিত না হয়েও নিজের চেষ্টায় এখানকার পাহাড়িয়ারা টিকিয়ে রাখছে পূর্বপুরুষদের রীতিনীতি ও সংস্কৃতিটাকে।
মোড়লকে সঙ্গে নিয়ে আমরা পাহাড়িয়া গ্রামটি ঘুরে দেখি। একটি বাড়িতে ঢুকেই দেখি অন্য দৃশ্য। বোঝা যায় গত রাতেই এখানে কোন বিয়ের অনুষ্ঠান সম্পন্ন হয়েছে। বাড়িটি বেশ পরিপাটিভাবে সাজানো। বারান্দার মেজেতে নজরে পড়ে বেশ কয়েকটি মাটির হাড়ি। হাড়ির মধ্যে কি আছে ? জানতে চাইলে বাড়ির কর্তা বীরেন খানিক লজ্জিত ভংগিতে উত্তরে বলেন ‘টাডি’। অজানা এই শব্দটি শুনেই আমরা নিরব হয়ে যাই। মোড়ল মুচকি হেসে জানায় হাড়িয়াকে পাহাড়িয়া ভাষায় বলে টাডি। পূর্বপুরুষদের রীতির অংশ হিসেবে যে কোন অনুষ্ঠানেই পাহাড়িয়ারা টাডি পান করে। টাডি তাদের সংস্কৃতিরই অংশ এবং প্রিয় পাণীয়। গোত্রের মোড়লের ভাষায়, ‘হিন্দু ধর্মালম্বীরা যেমন পূজায় বা অন্য আচারের সময় দুধ ব্যবহার করে পাহাড়িয়ারাও তেমনি ব্যবহার করে টাডিকে।’
রক্ষা গোলা নিয়ে গোলাই গ্রামের পাহাড়িয়া সম্প্রদায়ের আদিবাসীরা আজ স্বপ্ন বিভোর। মুষ্টি চালে পালটে যাবে আদিবাসীদের জীবন। আদিবাসীরা হবে অধিকার সচেতন ও স্বনির্ভর। এক সময় তাদের আর অভাব বলে কিছু থাকবে না। মহাজন নামক শব্দটি মুছে যাবে তাদের জীবন থেকে।
লিখাটি প্রকাশিত হয়েছে সাপ্তাহিকে, ১৯ এপ্রিল ২০১২
© 2012 – 2018, https:.