মুজিবনগরে গার্ড অব অনারে
বৈদ্যনাথতলা থেকে পলাশীর দূরত্ব মাত্র কুড়ি মাইল। ১৭৫৭ সালে পলাশীর আম্রকাননে অস্তমিত হয়েছিল বাংলার স্বাধীনতার শেষ সূর্যটি। কিন্ত মেহেরপুরের বৈদ্যনাথতলার আম্রকাননের ইতিহাসটি গৌরবের। ১৭ এপ্রিল ১৯৭১। এখানেই বাংলার স্বাধীনতার সূর্য উদিত হয়। দেশি-বিদেশি সাংবাদিক ও হাজারো জনতার সামনে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ (প্রবাসী) সরকারের প্রধানমন্ত্রী ও মন্ত্রিরা শপথ নেয়। সেই থেকে ইতিহাসের হাত ধরে বৈদ্যনাথতলা হয়ে যায় মুজিবনগর।
সূর্যটা তখন হেলে পড়েছে। হালকা আলো এসে পড়েছে ধবধবে সাদা ভাস্কর্যগুলোতে। ভাস্কর্য বা ম্যুরালচিত্রের মাধ্যমে মুজিবনগর স্মৃতি কমপ্লেক্সে তুলে ধরা হয়েছে মুক্তিযুদ্ধের সময়কার উল্লেখযোগ্য ঘটনাগুলোকে। সাতই মার্চের ভাষণ, গার্ড অব অনার, মন্ত্রিপরিষদ, সেক্টর কমান্ডারস, মুক্তিযোদ্ধাদের অপারেশন প্রভৃতি এখানে প্রায় জীবন্ত। আম্রকানন আর স্মৃতিসৌধটিও দাঁড়িয়ে আছে কালের সাক্ষী হয়ে।
সেদিন মুজিবনগর শপথগ্রহণ অনুষ্ঠানে ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলামকে গার্ড অব অনার দেওয়া হয় । গার্ড অব অনার প্রদানকারী ১২ জনের মধ্যে বেঁচে আছেন মাত্র চারজন আনসার সদস্য। এক যুবক জানালেন তথ্যটি। ফোন নম্বর দিয়ে সহায়তাও করলেন। মুঠোফোনে তাঁদের সঙ্গে কথা হয়। অতঃপর কেটে যায় মিনিট দশেক সময়। একে একে উপস্থিত হন কালের সাক্ষী চারজন আনসার। মোঃ সিরাজ উদ্দিন ও মোঃ হামিদুল হকের বয়স ষাট পেরোলেও মোঃ আজিমুদ্দিন ও মোঃ লিয়াকত আলীর বয়স সত্তরোর্ধ্ব।
‘২৬ মার্চের পরেই আমরা বৈদ্যনাথতলা ইপিআর ক্যাম্পটি দখলে নিই। ক্যাম্পে ওড়ানো পাকিস্তানি পতাকা নামিয়ে আমরা আগুন ধরিয়ে দেই। এর পর থেকেই ক্যাম্পের দায়িত্বে থাকি আমরা ১২জন আনসার। সংগ্রাম কমিটির লোকেরা আমাদের চাল-ডাল সংগ্রহ করে দিতেন। আমরা নিজেরাই তা রান্না করে খেতাম।’ এভাবেই কথা শুরু করেন আজিমুদ্দিন শেখ। তিনি ছিলেন ভবরপাড়া গ্রামের সে সময়কার আনসার কমান্ডার।
শপথগ্রহণ অনুষ্ঠানের কথা উঠতেই তিনি বলেন, ‘১৬ এপ্রিল আসরের একটু পরেই ক্যাম্পে আসেন সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দীন আহমদ, কামরুজ্জামান, এম মনসুর আলী, ওসমানী ও তৌফিক-ই-ইলাহীসহ ( বর্তমানে প্রধানমন্ত্রীর জ্বালানী উপদেষ্টা) অনেকেই। তৌফিক-ই- ইলাহী ছিলেন মেহেরপুরের তৎকালীন এসডিও। তিনি ছাড়া আমাদের কাছে বাকিরা ছিলেন অপরিচিত। ’ আজিমুদ্দিন বলেন, ‘ক্যাম্পের পেছনের গেট দিয়ে তাঁরা চলে যান আম্রকাননে। সেখানে অনুষ্ঠানের জায়গা নির্ধারণ করে তাঁরা আবার ফিরে আসেন ক্যাম্পে। তৌফিক-ই-ইলাহী কিছু নির্দেশনা দিয়ে বলেন, ‘আগামীকাল এখানে কয়েকজন মেহমান আসবে। আপনারা আজ একটু সজাগ থাকবেন। আর কাল সকালে রেডি থাকবেন।’
মোঃ সিরাজ উদ্দিন জানান, মঞ্চ তৈরির দায়িত্ব ছিল স্থানীয় সংগ্রাম কমিটির। নাম জানতে চাইলে তিনি মোমিন, জজ মাষ্টার, আইয়ুব ডাক্তার, সৈয়দ মাষ্টার, রফিক মাষ্টর, রুস্তম উকিল, জামাত মাষ্টার, সুশীল কুমার বিশ্বাস প্রমুখের নাম জানালেন। তিনি বলেন, ‘মঞ্চ তৈরি শুরু হয় রাত ১০টার পর। আমরা তখন টহলে ছিলাম। গ্রাম থেকে লোক আসে। মাটির ওপরে তক্তা বিছানো হয়। কাপড়, দড়ি, বাঁশ, দেবদারুর পাতা দিয়ে সাজানো হয় অনুষ্ঠানস্থল। দুটি বাঁশ পুঁতে দেবদারুর পাতায় তৈরি করা হয় গেট। চেয়ার, মাইক আর টেবিল আসে ভারত থেকে। শেষরাতের দিকে আমাদের ক্যাম্প থেকে আনা হয় চৌকি।’
ভোররাতের কথা জানালেন হামিদুল হক। তাঁর ভাষায়, ‘আমরা তখনো জানি না, এখানে কী হবে। শেষরাতে শুনি, চারপাশে গাড়ির শব্দ। আমরা ক্যাম্প থেকে কিছু ঠাহর করতে পারি না। ভোরের দিকে দেখি, শত শত ভারতীয় বিএসএফ। সাদা পোশাকে তারা ঘিরে রেখেছে গোটা এলাকাটি।’
সকালের দিকে আনসার সদস্যরা অস্ত্রসহ আসেন অনুষ্ঠানস্থলে। তাঁদের বলা হয় গার্ড অব অনারের প্রস্ততি নিতে। সকাল নয়টায় আম্রকাননে অতিথিরা আসতে থাকেন। আশপাশের হাজার হাজার মানুষও জড়ো হয়। উপস্থিত হন দেশি-বিদেশি শতাধিক সাংবাদিক। অনুষ্ঠান শুরু হয় সকাল ১১ টায়। জাতীয় নেতারা মঞ্চে ওঠেন। অনুষ্ঠান শুরু হয় কোরআন তেলাওয়াত আর জাতীয় সংগীতের মাধ্যমে।
আজিমুদ্দিন জানান, ‘আসাদুল আর আইয়ুব জাতীয় সংগীতে কন্ঠ দেন। আর কোরআন তেলওয়াত করেন বারেক। এরপরই শুরু হয় গার্ড অব অনার পর্বটি।’ তাঁর ভাষায়,‘প্রথমে আমাদের কমান্ডে ছিলেন আনসার ইয়াদ আলী। পেছনের লাইনে ছিলাম আমরা ১১জন। ইয়াদ আলীকে লাইনে পাঠিয়ে কমান্ড করলেন মাহাবুব উদ্দিন আহমেদ। তিনি ছিলেন মাগুরা মহকুমার পুলিশ কর্মকর্তা। পেছনে আমরা ১২জন গার্ড অব অনার প্রদান ও সশস্ত্র সালাম দিই।’ অন্য আনসার সদস্যদের নাম জানতে চাইলে লিয়াকত আলী জানালেন, ফকির মোহাম্মদ, নজরুল ইসলাম, মফিজ উদ্দিন, অস্থির মল্লিক, মহিম শেখ, কিসমত আলী, সাহেব আলী, এবং ইয়াদ আলীর নাম।
সেদিনের অনুষ্ঠানের বর্ণনা করেন আজিমুদ্দিন শেখ। তিনি বলেন, ‘সৈয়দ নজরুল ইসলাম প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীনসহ মন্ত্রিপরিষদের অন্য সদস্যদের পরিচয় করিয়ে দেন। অতঃপর শপথ নেন তাঁরা। সেনাপতি হিসেবে ঘোষণা করা হয় আতাউল গনি ওসমানীর নাম। বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র পাঠ করেন অধ্যাপক ইউসুফ আলী।’ সে অনুষ্ঠানে বক্তব্য দেন ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম ও প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ। সেদিনই বৈদ্যনাথতলার নামকরণ করা হয় মুজিবনগর। আর মুজিবনগর হয়ে যায় বাংলাদেশের অস্থায়ী রাজধানী।
তাঁরা দুঃখ করে বলেন, ‘আমরা গার্ড অব অনার দিয়েছিলাম ১২জন আনসার। অথচ মুজিবনগর কমপ্লেক্সের ভাস্কর্য বা মুর্যালচিত্রে দেখানো হয়েছে ৮ জনকে। সকলের ছবি থাকা সত্ত্বেও ভাস্কর্যে সকলের সঠিক অবয়বও আনা হয়নি।’ তাঁদের দাবী সরকার অবিলম্বে মুজিবনগর কমপ্লেক্সের সকলক্ষেত্রে সঠিক ইতিহাস তুলে ধরবেন।
লিখাটি প্রকাশিত হয়েছে প্রথমআলোতে ১৭ এপ্রিল ২০১২
© 2012 – 2021, https:.