মুক্তিযুদ্ধ

কোন দেশের জন্য আমরা যুদ্ধ করলাম ?

‘২৫ মার্চ ১৯৭১। রাত ১ টা। হঠাৎ লাম বেজে ওঠে বগুড়ার পুলিশ ব্যারাকে। ঢাকার রাজারবাগ পুলিশ লাইনে আক্রমণ হয়েছে। খবরটি ছড়িয়ে পড়ে ব্যারাকে। আমরা সবাই অস্ত্র নিতে চাইলাম। কিন্ত বাধা দিলেন বিহারী এসপি মঈনুদ্দিন। তার কথা কেউ শুনল না। সেই প্রথম চেইন অব কমান্ড ভেঙ্গে গেল। নিজেকে রক্ষায় আমরা অস্ত্রাগার নিজেদের নিয়ন্ত্রণে রাখলাম। আশপাশের জনতা আমাদের সার্পোট করল। তারা আমাদের খাবার ও খবর দিয়ে সহযোগিতা করতে লাগল।

রংপুর ক্যান্টনমেন্টে ছিল পাকিস্তানী আর্মিদের বড় ঘাটি। এসপির মাধ্যমে তারা প্রথমে আমাদের নিরস্ত্র করার প্রস্তাব দেয়। আমাদের না সুচক জবাব মিলতেই তাদের একটি দল অবস্থান নেয় বগুড়া মহিলা কলেজসহ আশপাশের এলাকায়। ২৮ মার্চ। তাদের ঠেকাতে বগুড়া কটনমিলের পাশে কালিতলায় আমরা পুলিশ জনতা মিলে প্রতিরোধ গড়ে তুললাম। তিনদিন গোলাগুলির পর তারা পিছু হটে। পরে আমরা ৯ মাইল দূরের আর্মিক্যাম্প আক্রমণ করি। পুলিশ ও জনতার আক্রমণের ভয়ে পাকিস্তানীরা সবাই পালিয়ে যায়। সেখানকার অস্ত্রগুলো আমার বিলিয়ে দেই জনতার মাঝে। কিন্ত সে সময়ই আমাদের ওপর বিমান হামলা হয়। আমাদের কিছু লোকও মারা যায়। আমরা এক মেজরকে পরিবারসহ বগুড়ার পুলিশ ব্যারাকে বন্দি করে রাখি।
১৬ এপ্রিল। পাকিস্তানী আর্মিরা চারদিকে থেকে বগুড়া পুলিশ ব্যারাকে আক্রমণের প্রস্তÍতি নিচ্ছে। খবর পেয়ে আমরা একটি দল ভারতের দিকে রওনা হই। এর পূর্বে সুকরানা, পটল, সুরুজের নেতৃত্বে বগুড়ার একটি ব্যাংক ভাঙ্গা হয়। সব টাকা মুক্তিযোদ্ধা ও শরণার্থীদের জন্য পাঠিয়ে দেয়া হয় ভারতে। ১৭ বা ১৮ তারিখে হিলি দিয়ে বালুরঘাট হয়ে আমরা চলে আসি ভারতের কুসুমন্ডি থানায়।
কুসুমন্ডি থানায় কেটে যায় বিশটি দিন। কিন্ত এভাবে আর কতদিন বসে থাকা যায়! ইপিআর হাবিলদার কাঞ্চনের উদ্যোগে প্রথমে আমরা নিজেরাই ১০-১৫ জন ট্রেইন সৈন্য নিয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের একটি দল গড়ে তুলি। সে দল নিয়ে মাঝে মধ্যে আমরা ভারতের বটতলী থেকে বাংলাদেশ সীমান্তে ঢুকে আক্রমণ চালিয়ে আবার চলে আসতাম। এভাবে যুদ্ধ করি বেশ কিছুদিন!

পায়ে গুলিবিদ্ধ হওয়ার চিহ্ন
পায়ে গুলিবিদ্ধ হওয়ার চিহ্ন

জুলাই মাসে আমরা ৭ নং সেক্টরের সাব সেক্টর হামজাপুর থেকে যুদ্ধ করি। নেতৃত্বে ছিলেন ডেপুটি কমান্ডার ক্যাপ্টেন ইদ্রিস। আমরা যুদ্ধ করি হিলি, কামার পাড়া, বিরল, পীরগঞ্জ, রানীশংকৈল এলাকায়।
১২ নভেম্বর ১৯৭১। ভারতীয় সেনাবাহিনীর সহযোগিতায় পরিকল্পনা হয় দিনাজপুর মুক্ত করার। কোন দল কোন দিক দিয়ে আক্রমণ করবে চুড়ান্ত হয়। সীমান্ত পাড় হয়ে রাত ২টার দিকে আমরা ঢুকে পরি রামসাগর এলাকার জামালপুর গ্রামে। রমজান মাস। আমাদের জানা ছিল না রামসাগরে খানদের এত বড় দুর্গ আছে। তাদের সাথে থেমে থেমেই গোলাগুলি চলছিল। কিন্ত আমাদের অবস্থা খুব সুবিধাজনক ছিল না। এরই মধ্যে সকাল হয়ে গেল। পাকিস্তানীরা বৃষ্টির মতো গুলিবর্ষণ করছে। বেঁচে থাকব কিনা জানি না? মার কথা তখন খুব মনে পড়ছিল। মনের ভেতর যেন ঝড় উঠেছে। মৃত্যু চিন্তায় খানিকটা ভরকেও গেলাম। একপাশে ছিলেন ক্যাপ্টেন ইদ্রিস অন্যপাশে বন্ধু জববার।
গুলি থামিয়ে সিগারিট ধরাতে যাব ওমনি একটি গুলি এসে লাগে আমার বাম পায়ে। প্রথম কিছুই বুঝতে পারিনি। মনে হয়েছে সাপে কেটেছে। পরে খেয়াল করলাম গলগলিয়ে রক্ত বের হচ্ছে। পাশে জব্বারের গোঙ্গানির শব্দ। তাকিয়ে দেখি তার পেটেও গুলি লেগেছে। সে তখন গড়িয়ে পেছনে চলে যায়। কিন্ত পায়ে গুলি লাগায় আমি পড়ে থাকি বগের মতো। পা নাড়াতে পারি না। এগোতে বা পেছাতেও পারি না। একটি গামছা দিয়ে আমি পা’টাকে বেধে ফেলি।
সে সময় সীমান্তের ওপার থেকে আর্টিলারি সেল নিক্ষেপ শুরু হয়ে যায়। পাল্টা সেল নিক্ষেপ করে পাকিস্তানীরাও। দুয়ের মাঝে পড়ে আমরা আল্লাহর নাম ঝপি। যেন আজাবের মধ্যে আছি।
প্রচুর বৃষ্টি হচ্ছিল তখন। আমি উঠতে পারছিলাম না। গড়িয়ে গড়িয়ে কোন রকমে চলে আসি খানপুর স্কুলের পাশের পুকুরে। গোটা পুকুর কচুরিপানায় ঢাকা। সকাল ৮টা থেকে গোটা দিন লুকিয়ে ছিলাম সেখানে।  সন্ধ্যার দিকে গোলাগুলি বন্ধ হয়। আমি পুকুর থেকে উঠে একটি ধানক্ষেতের কাছে পড়ে ছিলাম। গ্রামের দুজন লোক আমাকে ঘাড়ে করে সীমান্তের ওপারে পৌঁছে দেয়। প্রথম গঙ্গারামপুরে এবং পরে রায়গঞ্জ মিলিটারী হাসপাতালে চিকিৎসা চলে আমার। সে অপারেশনে দেবেন, আমজাদসহ শহীদ হয়েছিল আরো ২৩ জন। যুদ্ধের পর আমার পরিবারও জানত আমি বেঁচে নেই। বাড়িতে দোয়া পড়ানোও হয়ে গেছে। যখন ফিরে আসলাম বুকে জড়িয়ে ধরল বাবা। এ যেন আমার পুনজন্ম।’
বিরলের নিজ বাড়িতে বসে কথা হচ্ছিল মুক্তিযোদ্ধা আব্দুল মালেকের সঙ্গে। পিতা দারাজ তুল্যাহ ও মাতা আয়শা খাতুন এর ছেলে মালেকের গ্রামের বাড়ি দিনাজপুরের বিরল উপজেলার জগতপুর গ্রামে। বিরল হাই স্কুল থেকে এসএসসি ও সেতাবগঞ্জ কলেজ থেকে এইচএসসি পাশের পর তিনি ১৯৭০ সালে যোগ দেন পুলিশ বাহিনীতে। মুক্তিযুদ্ধ করেছেন ৭ নং সেক্টরের হামজাপুর ক্যাম্পের অধীনে।এফএফ নং ছিল ৯২৩।
ছোট বেলা থেকেই মালেক ছিলেন বেশ দুরন্ত। আকবর, সামাদ, জালাল ছিল খেলার সাথী। মুল্লুক দেওয়ান পুকুরের পাশের বনে ঘুরে বেড়ানো আর বৃষ্টিরদিনে গ্রামের ডোবায় ডোবায় দলবেধে মাছ ধরার স্মৃতি আজো তার মনে পড়ে।
স্মৃতির পাতা থেকে তিনি যেন পড়ে শোনান সে সময়কার নানা ঘটনার কথা। তার ভাষায়,‘নানা বৈষম্যের কথা জানতাম রেডিও থেকে। পূর্ব পাকিস্তানে কোন জিনিসের দাম দশ আনা হলে পশ্চিম পাকিস্তানে হতো মাত্র ছয় আনা। গণতন্ত্রের জায়গায় বসানো হলো সামরিকতন্ত্র। ইত্তেফাক বন্ধের প্রতিবাদে একবার গ্রাম থেকে মিছিল নিয়ে গিয়েছিলাম দিনাজপুর শহরে। ১৯৭১ এর জানুয়ারির ৫ তারিখে যোগ দেই পুলিশে। আমার পোষ্টিং হয় বগুড়াতে।’
ব্যারাকের ভেতর বৈষম্য কেমন ছিল? উত্তরে মালেক বলেন, ‘তারা আমাদের থেকে শক্তিশালী ছিল। অফিসাররা অধিকাংশই ছিল বিহারী। তাদের কথাই আমাদের মেনে নিতে হতো। উন্নতমানের খাবার দেয়া হতো তাদের সৈন্যদের। অপরাধ করলে আমাদের সাথে সাথে শাস্তি দেয়া হতো । কিন্ত তাদেরকে মাফ করে দেয়া হতো।’
মুক্তিযোদ্ধা আব্দুল মালেকের কাছে বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণই স্বাধীনতার ঘোষণা। তিনি বলেন, ‘ এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম – এর চেয়ে বড় ঘোষণা আর কি হতে পারে!’
৭ মার্চের পর আপনারা ব্যারাকের ভেতর কি করলেন? মুক্তিযোদ্ধা মালেক বলেন, ‘ গোপনে আমরা আলোচনা করতাম। রহনপুরের শাহাদাত হোসেন , মনসুর আলী, হিলির ধনঞ্জয়, বিরামপুরের রইসউদ্দিন, হাকিমপুরের মিজান ছিল আমাদের সঙ্গে। আমরা তখন ব্যারাকের ভেতরেই বিভিন্ন দাবীতে অসহোযোগ গড়ে তুললাম।’।
মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা তৈরি প্রসঙ্গে তিনি দুঃখ করে বলেন, ‘তালিকা হওয়া উচিত ছিল বাহাত্তরে। যুদ্ধের সময় আমরা মাসে ১২০ টাকা ভাতা পেতাম। সব সেক্টর ও সাব সেক্টরে ছিল মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা। সেই তালিকা ধরে সহজেই তৈরি করা যেত মুক্তিযোদ্ধাদের পূর্ণাঙ্গ একটি তালিকা।’
স্বাধীন দেশে ভালোলাগার অনভূতি প্রকাশ করেন এই বীর মুক্তিযোদ্ধা। তিনি বলেন, ‘আমরা যুদ্ধ করে একটি পতাকা পেয়েছি। পেয়েছি পৃথিবীর মানচিত্রে একটি দেশ। আমরা স্বাধীন দেশের নাগরিক, স্বাধীন ভাবে চলছি – এটিই পরম পাওয়া।’
স্বাধীন দেশে কোন বিষয়টি মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে আপনাকে ব্যাথিত করে? এমন প্রশ্নে তিনি খানিকটা নিরব থাকেন। অতঃপর উত্তরে বলেন,‘যুদ্ধ করেছি পাকিস্তানীদের বৈষম্য, আত্মীয়করণ, কালোবাজারীর বিরুদ্ধে। কিন্ত এখন এই স্বাধীন দেশেও দেখি সেগুলো হচ্ছে। দেশের অর্থনৈতিক মুক্তি আসেনি অদ্যাবধি। যুব সমাজকে রাজনৈতিক স্বার্থে লেলিয়ে দেয়া হচ্ছে। তাহলে কোন দেশের জন্য আমরা যুদ্ধ করলাম? এগুলো দেখলে সত্যি খুব কষ্ট লাগে।’
কথার পিঠে কথা চলে। নানা আক্ষেপ আর কষ্ট ভোলাতে চলে আশাবাদের কথাও। পরবর্তী প্রজন্ম সুশিক্ষিত হয়ে এদেশে সুশাসন প্রতিষ্ঠা করবে। এমনটাই আশা এই সূর্যসৈনিকের। তার ভাষায়, ‘একদিন গোটা পৃথিবীকে তারা জানিয়ে দেবে – আমরা বাংলাদেশের মানুষ, এদেশের জন্য আমাদের পূর্বপুরুষরা আত্মত্যাগ করেছিল, আমরা আমাদের চিন্তা, চেতনা আর দেশপ্রেম দিয়ে তাদের স্বপ্নগুলোকে বাস্তাবায়ন করেছি।’

লিখাটি প্রকাশিত হয়েছে সাপ্তাহিক কাগজে,  ৮ এপ্রিল ২০১২

© 2012 – 2021, https:.

এই ওয়েবসাইটটি কপিরাইট আইনে নিবন্ধিত। নিবন্ধন নং: 14864-copr । সাইটটিতে প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো তথ্য, সংবাদ, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করলে আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।

Show More

Salek Khokon

সালেক খোকনের জন্ম ঢাকায়। পৈতৃক ভিটে ঢাকার বাড্ডা থানাধীন বড় বেরাইদে। কিন্তু তাঁর শৈশব ও কৈশোর কেটেছে ঢাকার কাফরুলে। ঢাকা শহরেই বেড়ে ওঠা, শিক্ষা ও কর্মজীবন। ম্যানেজমেন্টে স্নাতকোত্তর। ছোটবেলা থেকেই ঝোঁক সংস্কৃতির প্রতি। নানা সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠনের সঙ্গে জড়িত। যুক্ত ছিলেন বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র ও থিয়েটারের সঙ্গেও। তাঁর রচিত ‘যুদ্ধদিনের গদ্য ও প্রামাণ্য’ গ্রন্থটি ২০১৫ সালে মুক্তিযুদ্ধ ভিত্তিক মৌলিক গবেষণা গ্রন্থ হিসেবে ‘কালি ও কলম’পুরস্কার লাভ করে। মুক্তিযুদ্ধ, আদিবাসী ও ভ্রমণবিষয়ক লেখায় আগ্রহ বেশি। নিয়মিত লিখছেন দেশের প্রথম সারির দৈনিক, সাপ্তাহিক, ব্লগ এবং অনলাইন পত্রিকায়। লেখার পাশাপাশি আলোকচিত্রে নানা ঘটনা তুলে আনতে ‘পাঠশালা’ ও ‘কাউন্টার ফটো’ থেকে সমাপ্ত করেছেন ফটোগ্রাফির বিশেষ কোর্স। স্বপ্ন দেখেন মুক্তিযুদ্ধ, আদিবাসী এবং দেশের কৃষ্টি নিয়ে ভিন্ন ধরনের তথ্য ও গবেষণামূলক কাজ করার। সহধর্মিণী তানিয়া আক্তার মিমি এবং দুই মেয়ে পৃথা প্রণোদনা ও আদিবা।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

Back to top button