সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে আমৃত্যু সংগ্রাম করেছেন সুফিয়া কামাল
বেগম সুফিয়া কামাল বাংলাদেশের একজন প্রথিতযশা কবি, লেখিকা, নারীবাদী ও নারী আন্দোলনের অন্যতম পথিকৃত। তিনি১৯১১ সালের ২০জুন বরিশালের শায়েস্তাবাদে মামার বাড়িতে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতার পিতার নাম সৈয়দ আব্দুল বারী। যে সময়ে সুফিয়া কামালের জন্ম তখন বাঙ্গালি মুসলিম নারীদের কাটাতে হত গৃহবন্দি জীবন। স্কুল কলেজে পড়ার কোনো সুযোগ তাদের ছিলো না। পরিবারে বাংলা ভাষার প্রবেশ এক রকম নিষিদ্ধ ছিল।
যে পরিবারে সুফিয়া কামাল জন্মগ্রহণ করেন সেখানে নারীশিক্ষাকে প্রয়োজনীয় মনে করা হতোনা। তিনি তাঁর মা সাবেরা বেগমের কাছে বাংলা পড়তে শেখেন। মাত্র বার বছর বয়সে তাঁকে সৈয়দ নেহাল হোসেনের সাথে বিয়ে দেয়া হয়। নেহাল অপেক্ষাকৃত আধুনিকমনস্ক ছিলেন, তিনি সুফিয়া কামালকে সাহিত্যপাঠে উৎসাহিত করেন। সুফিয়া সে সময়ের বাঙালি সাহিত্যিকদের লেখা পড়তে শুরু করেন। ১৯১৮ সালে কলকাতায় গিয়েছিলেন সুফিয়া কামাল। সেখানে তাঁর সঙ্গে দেখা হয় বেগম রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেনের। সুফিয়া কামালের শিশু মনে বিশেষ জায়গা করে নেয় বেগম রোকেয়ার কথা ও কাজ।
সাহিত্য পাঠের পাশাপাশি সুফিয়া কামাল সাহিত্য রচনা শুরু করেন।১৯২৬ সালে তাঁর প্রথম কবিতা বাসন্তী সেসময়ের প্রভাবশালী সাময়িকী সওগতে প্রকাশিত হয়। ত্রিশের দশকে কলকাতায় অবস্থানকালে বাংলা সাহিত্যের উজ্জ্বল নক্ষত্র রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, শরতচন্দ্র প্রমুখের দেখা পান তিনি। মুসলিম নারীদের সাংস্কৃতিক কর্মকান্ডে অংশগ্রহণকে উৎসাহিত করার জন্য বেগম রোকেয়ার প্রতিষ্ঠিত সংগঠন ‘আঞ্জুমানে খাওয়াতিনে ইসলামে’ রোকেয়ার সঙ্গে সুফিয়া কামালের পরিচয় হয়। বেগম রোকেয়ার চিন্তাধারা ও প্রতিজ্ঞা তাঁর মধ্যেও সঞ্চারিত হয়, যা তাঁর জীবনে সুদূরপ্রসারী প্রভাব ফেলে।সামাজিক সচেতনতা বৃদ্ধির পাশাপাশি তাঁর সাহিত্যচর্চা চলতে থাকে। ১৯৩৭ সালে তাঁর গল্পের সংকলন কেয়ার কাঁটা প্রকাশিত হয়।১৯৩৮ সালে তাঁর প্রথম কাব্যগ্রন্থ সাঝেঁর মায়ার মুখবন্ধ লিখেন কাজী নজরুল ইসলাম। বইটি বিদগ্ধজনের প্রশংসা কুড়ায় যাদের মাঝে ছিলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর।
১৯৩২ সালে তাঁর স্বামীর আকস্মিক মৃত্যু তাঁকে আর্থিক সমস্যায় ফেলে। তিনি কলকাতা কর্পোরেশন স্কুলে শিক্ষকতা শুরু করেন এবং ১৯৪২ সাল পর্যন্ত এ পেশায় নিয়োজিত থাকেন। এর মাঝে ১৯৩৯ সালে কামালউদ্দীন আহমেদের সাথে তাঁর বিয়ে হয়। দেশবিভাগের পূর্বে তিনি নারীদের জন্য প্রকাশিত সাময়িকী বেগমের সম্পাদক ছিলেন।
১৯৪৭ সালে দেশভাগের পর সুফিয়া কামাল পরিবারসহ ঢাকায় চলে আসেন।ভাষা আন্দোলনে তিনি নিজে সক্রিয়ভাবে অংশ নেন এবং এতে অংশ নেয়ার জন্য নারীদের উদ্বুদ্ধ করেন।১৯৫৬ সালে তিনি শিশুদের সংগঠন কচিকাঁচার মেলা প্রতিষ্ঠা করেন। তিনিই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম মহিলা হোস্টেলকে ‘রোকেয়া হল’ নামকরণের দাবী জানান। ১৯৬১ সালে পাকিস্তান সরকার কর্তৃক রবীন্দ্রসঙ্গীত নিষিদ্ধের প্রতিবাদে সংগঠিত আন্দোলনে তিনি জড়িত ছিলেন। এই বছরে তিনি ছায়ানটের সভাপতি নির্বাচিত হন। ১৯৬৯ সালে তিনি মহিলা সংগ্রাম কমিটির সভাপতি নির্বাচিত হন, গণঅভ্যুত্থানে অংশ নেন, পাকিস্তান সরকার কর্তৃক ইতিপূর্বে প্রদত্ত তমঘা-ই-ইমতিয়াজ পদক বর্জন করেন। তিনি ১৯৭০ সালে মহিলা পরিষদ প্রতিষ্ঠা করেন। ১৯৭১ সালের মার্চে অসহযোগ আন্দোলনে নারীদের মিছিলে তিনি নেতৃত্ব দেন।
স্বাধীন বাংলাদেশে নারীজাগরণ আর সমঅধিকার প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে তিনি উজ্জ্বল ভূমিকা রেখে গেছেন।১৯৯০ সালে স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলনে শরিক হয়েছেন, কার্ফ্যু উপেক্ষা করে নীরব শোভাযাত্রা বের করেছেন। মুক্তবুদ্ধির পক্ষে এবং সাম্প্রদায়িকতা ও মৌলবাদের বিপক্ষে তিনি আমৃত্যু সংগ্রাম করেছেন।
১৯৯৯ সালের ২০ নভেম্বর ঢাকায় সুফিয়া কামাল মৃত্যুবরণ করেন। তাঁকে পূর্ণ রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় সমাহিত করা হয়। বাংলাদেশী নারীদের মধ্যে তিনিই প্রথম এই সম্মান লাভ করেন।
তথ্য ও ছবি: সংগৃহীত
© 2012 – 2018, https:.