আল বদরের লোকেরা ধরে নিয়ে যায় সাংবাদিক সিরাজুদ্দীন হোসেন-কে
সিরাজুদ্দীন হোসেন ছিলেন এ দেশের সংবাদপত্র জগতের অন্যতম পুরোধা। তিনি ‘দৈনিক ইত্তেফাক’-এর বার্তা ও কার্যনির্বাহী সম্পাদক ছিলেন৷ পাকিস্তান আমলে যে কয়জন সাংবাদিকের বলিষ্ঠ নেতৃত্বে সাংবাদিকরা ঐক্যবদ্ধ হয়েছিলেন এবং বাঙালি জাতীয়তাবাদী আন্দোলনকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করেছিলেন, সিরাজুদ্দীন হোসেন ছিলেন তাঁদের মধ্যে অন্যতম ৷ তিনি ছিলেন বাংলাদেশে অনুসন্ধানী প্রতিবেদনের জনক।
সাংবাদিক সিরাজুদ্দীন হোসেন ১৯৭১ সালে ৭ই মার্চের বঙ্গবন্ধুর ভাষণটি বেতারে প্রচারের দাবী সম্বলিত একটি বিবৃতি সর্বপ্রথম আওয়ামী লীগ নেতা তোফায়েল আহমেদের নামে ছাপিয়ে দেন ইত্তেফাকে। পরবর্তীতে এ দাবীর প্রতি গুরুত্ব দিয়ে তাজউদ্দিনের বিবৃতি প্রকাশ পায় পত্রিকায়৷ এতে ৭ মার্চের ভাষণ রেডিওতে সরাসরি প্রচারের দাবি ক্রমশ জোরালো হয়ে ওঠে। কর্তৃপক্ষ তখন এ দাবি মেনে নিতে বাধ্য হয়৷ ৭ মার্চ রেসকোর্স ময়দান থেকে সরাসরি বঙ্গবন্ধুর ভাষণ প্রচার না করলেও ৮ মার্চ সকালে বঙ্গবন্ধুর ভাষণ প্রচারের ব্যবস্থা করতে বাধ্য হয় কর্তৃপক্ষ৷ সিরাজুদ্দীন হোসেন সাংবাদিকতার প্রচলিত রীতি লঙ্ঘন করে ইত্তেফাকে তোফায়েল আহমদের নামে ওই বিবৃতিটি প্রকাশের ব্যবস্থা না করলে বঙ্গবন্ধৃর ৭ মার্চের ভাষণটি আদৌ রেডিওতে প্রচারিত হতো কিনা, তা নিয়ে সন্দেহ ছিল।
১৯৭১ সালে তিনি নানা জরুরি তথ্য ওপারে পাঠাতে হলে শফিকুল কবিরকেই খবর দিতেন। তিনি তা আগরতলার কংগ্রেস ভবন পর্যন্ত পৌঁছে দিতেন ৷ সিরাজুদ্দীন হোসেন প্রবাসী সরকারের কাছে পূর্ব পাকিস্তানের আমেরিকান কনস্যুলেটের গোপন প্রতিবেদনটি পাঠিয়েছিলেন, যা পরে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে বারবার প্রচারিত হওয়ার মাধ্যমে বাংলাদেশের পক্ষে বিশ্ব জনমত গড়ে উঠতে সাহায্য করে।
মুক্তিযুদ্ধের সময় সিরাজুদ্দীন হোসেন ‘ইত্তেফাক’-এর পাতায় সম্পাদকীয়, উপ-সম্পাদকীয় লিখতেন এবং বস্তুনিষ্ঠ সংবাদ পরিবেশন করতেন। সে সময় এ রকম সাহস দেখানো ছিল রীতিমত ভয়ঙ্কর৷ যুদ্ধের সময় সিরাজুদ্দীন হোসেন ‘ঠগ বাছিতে গাঁ উজাড়’ নামে একটি উপ-সম্পাদকীয় লেখেন৷ সেখানে তিনি স্পষ্ট ভাষায় বলেন, যে দোষে শেখ মুজিবকে দোষী বলা হচ্ছে, পশ্চিমা রাজনীতিকরা সেই একই দোষে দুষ্ট৷ এ সময় জামায়াতে ইসলামীর মুখপাত্র ‘দৈনিক সংগ্রাম’-এ ‘অতএব ঠগ বাছিও না’ নামে একটি উপ সম্পাদকীয় লিখে জনাব হোসেনকে পরোক্ষভাবে মৃত্যুর হুমকি দেয়৷ কিন্তু এসব হুমকি তাঁর কলমকে থামিয়ে রাখতে পারেনি৷ সকল বাধা উপেক্ষা করে মৃত্যুর পূর্বমুহূর্ত পর্যন্ত তিনি সংবাদ পরিবেশন করেছেন বস্তুনিষ্ঠভাবে৷
ষাটের দশকে পূর্ববঙ্গের বিভিন্ন স্থানে আশঙ্কাজনকভাবে শিশু অপহৃত হচ্ছিল৷ ‘দৈনিক ইত্তেফাক’-এ সম্পর্কিত খবরও ছাপা হয়। সংঘবদ্ধ শিশু অপহরণকারী দলের কারসাজির ফলেই যে এ ধরনের ঘটনা ঘটছে, সে বিষয়ে কারো সন্দেহ ছিল না৷ কিন্তু পুলিশের আইজি এক সংবাদ সম্মেলন করে মন্তব্য করলেন, শিশু অপহরণের এসব বিচ্ছিন্ন ঘটনা, এর পিছনে কোনো সংঘবদ্ধ সংগঠিত দল নেই। সিরাজুদ্দীন হোসেন পুলিশের এই মন্তব্য মিথ্যা প্রমাণ করার জন্য চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করলেন৷ তাঁর এ প্রচেষ্টার ফলে শিশু অপহরণের এক বিরাট কাহিনী উদ্ঘাটিত হয়৷ ময়মনসিংহ জেলার গফরগাঁও, ত্রিশাল ও ভালুকায় শিশু অপহরণকারীদের এক স্বর্গরাজ্য আবিষ্কৃত হয় সিরাজুদ্দীন হোসেনের উদ্যোগে৷ সে সময় আইপিআই (ইন্টারন্যাশনাল প্রেস ইনস্টিটিউট)-এর ক্রোড়পত্রে সিরাজুদ্দীন হোসেন ও উদ্ধারকৃত শিশুদের নিয়ে ছাপা হয় প্রতিবেদন৷ এ জন্য তিনি ম্যাগসেসে মনোনয়ন পেয়েছিলেন৷
সিরাজুদ্দীন হোসেন ১৯২৯ সালের মার্চ মাসে জন্মগ্রহণ করেন ৷মাত্র সাড়ে ৩ বছর বয়সে তিনি তাঁর বাবাকে হারান। তাঁর চাচা মৌলবী মোহাম্মদ ইসহাক তাঁর পরিবারের সাহায্যে এগিয়ে আসলেও পারিবারিক ভুল বোঝাবুঝির কারণে তিনি চাচার কাছ থেকে সরে আসেন৷ চাচার কাছে থাকাকালীন সময়ে তিনি মুর্শিদাবাদের নবাব বাহাদুর স্কুল, যশোর জেলা স্কুলে পড়াশোনা শুরু করেন৷ পরে যশোরের ঝিকরগাছার কাছে মিছরিদিয়াড়া গ্রামের এক বিধবার বাড়িতে জায়গির থেকে ঝিকরগাছা স্কুলে পড়াশোনা করতে থাকেন৷ ঐ পরিবার সিরাজুদ্দীন হোসেনকে নিজের ছেলের মতো স্নেহ করত৷
ম্যাট্রিক পরীক্ষা নিকটবর্তী হলে সেই উদারপ্রাণ বৃদ্ধা তাঁর বাড়ির একটি বড় মোরগ বিক্রি করে ফি-এর ঘাটতির টাকার সংস্থান করে দেন৷ তারপর তিনি ম্যাট্রিক পাশ করেন এবংযশোর মাইকেল মধুসূদন দত্ত কলেজে আইএ-তে ভর্তি হন৷ আইএ পাশ করার পর সিরাজুদ্দীন হোসেন কলকাতার ইসলামিয়া কলেজে বিএ পড়া শুরু করেন। অন্যের বই আর শিক্ষকদের লেকচারের উপর ভিত্তি করে নিজের তৈরি নোটের মাধ্যমে তিনি লেখাপড়া করেন।
১৯৪৭ সালে ছাত্রাবস্থায় তিনি ‘দৈনিক আজাদ’-এ সাংবাদিকতা শুরু করেন এবং অল্প বয়সেই তিনি ‘আজাদ’-এর বার্তা সম্পাদক হন৷ ১৯৫২ সালে ছাত্র হত্যার প্রতিবাদ জানিয়ে ব্যানার সংবাদকে মূল শিরোনাম বানানোর কারণে দৈনিক আজাদের সম্পাদক মওলানা আকরাম খাঁ বিনা নোটিসে তাকে চাকরিচ্যুত করেন। এরপর তিনি ঢাকার ইউএসআইএস অফিসে জুনিয়র এডিটর হিসবে কিছুদিন কাজ করেন৷ ১৯৫৪ সালে তিনি তোফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়া সম্পাদিত ইত্তেফাকের বার্তা সম্পাদক হিসেবে যোগ দেন। ১৯৬৬ সালে আইয়ুবী দুঃশাসনামলে ইত্তেফাক বন্ধ হয়ে গেলে সিরাজুদ্দীন হোসেন সংবাদ প্রতিষ্ঠান পিপিআই -এর ব্যুরো চীফ হিসেবে কাজ করেন। সিরাজুদ্দীন হোসেন দীর্ঘদিন ইত্তেফাকের বার্তা সম্পাদক থাকার পর ১৯৭০ সালে নির্বাহী সম্পাদক নিযুক্ত হন।
১৯৭১ সালের ১০ ডিসেম্বর সাংবাদিক সিরাজুদ্দীন হোসেনকে তাঁর শান্তিনগর, চামেলীবাগের ভাড়া বাড়ি থেকে ধরে নিয়ে যায় পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী এবং তাদের এদেশীয় দোসর আল বদর বাহিনীর লোকেরা। এর পর তিনি আর ফিরে আসেননি৷ ২০১০ সালে সিরাজুদ্দীন হোসেনকে মানিক মিয়া স্বর্ণপদক (মরণোত্তর) দেয়া হয়। তাঁর প্রকাশিত গ্রন্থ- ছোট থেকে বড়ো, মহীয়সী নারী, ইতিহাস কথা কও। তাঁর স্ত্রীর নাম নূরজাহান সিরাজী। তাঁদের আট পুত্ররা হলেন – শামীম রেজা নূর (প্রবাসী), শাহীন রেজা নূর (কার্যনির্বাহী সম্পাদক, দৈনিক ইত্তেফাক), ফাহীম রেজা নূর (সাংবাদিক), নাসিম রেজা নূর (প্রকৌশলী), সেলিম রেজা নূর (প্রবাসী), শাহীদ রেজা নূর (প্রকৌশলী), জাহীদ রেজা নূর(উপ ফিচার সম্পাদক, প্রথমআলো), তৌহীদ রেজা নূর (পিএইচডি গবেষক)।
তথ্য ও ছবি : সংগৃহীত
© 2012 – 2021, https:.