মুক্তিযুদ্ধ

এক মুক্তিযোদ্ধা অন্য মুক্তিযোদ্ধাকে বলছেন রাজাকার

‘৫ ডিসেম্বর ১৯৭১। আমরা তখন বিজয়নগর গ্রামে। ১৩ জনের গেরিলা দলের আমি কমান্ডার। খুব কাছেই যশোরের খোঁজারহাট বাজার। বিকেলের দিকে খবর পেলাম, সেখানে সাত-আটজন পাঞ্জাবি সৈন্য এসেছে। সবার কাছে আছে অস্ত্র। গ্রামের সাধারণ মানুষের বেশ ধরে আমরা কয়েকজন সেখানে গেলাম। ভাঙা ভাঙা উর্দুতে কথা বলে তাদের সঙ্গে ভাব জমালাম। অল্প সময়েই তারা আমাদের অন্তরঙ্গ হয়ে গেল। তারা ছিল বেশ ক্ষুধার্ত। আমরাও সে সুযোগটি নিলাম।

‘একটি স্কুলের বারান্দাতে তাদের বসিয়ে রান্নার আয়োজন করা হলো। জবাই করা হলো খাসি। তা দেখে পাঞ্জাবি আর্মিরা তো বেশ খুশি। তাদের প্রত্যেকের কাছে ছিল রাইফেল। খাবার দেওয়ার ঠিক পূর্ব মুহূর্তে কৌশলে আমরা তাদের অস্ত্রগুলো দূরে সরিয়ে রাখলাম। সংকেত দিতেই আমাদের দলের বাকি গেরিলার চারপাশ থেকে তাদের ঘিরে ফেলল। আমাদের কৌশলের কাছে তারা বোকা বনে গেল। নিরস্ত্র অবস্থায় ধরা দিল সবাই।
‘কিন্তু তাদের কাছে যে গ্রেনেড থাকতে পারে, সে কথা আমাদের চিন্তাতেই ছিল না। হঠ্যাৎ একজন পাঞ্জাবি আর্মি তার সঙ্গে থাকা একটি গ্রেনেডের চাবি দিল খুলে। আমাদের দিকে গ্রেনেডটি ছুড়ে দেবে, এমন সময় সবাই গুলি ছুড়ল তাদের দিকে। সঙ্গে সঙ্গে গ্রেনেড হাতে পাঞ্জাবি সৈন্যটি মাটিতে লুটিয়ে পড়ল।

‘সময় মাত্র সাত সেকেন্ড। এর পরই ঘটবে বিস্ফোরণ। আমরা সরে পড়তে চেষ্টা করলাম। কেউ কেউ সরেও পড়ল। কিন্তু তার আগেই বিস্ফোরিত হলো গ্রেনেডটি। সঙ্গে সঙ্গে একটি স্পি­ন্টার এসে বিদ্ধ হলো আমার কপালে। আমার চোখ তখন ঝাপসা হয়ে আসে। আমি লুটিয়ে পড়ি মাটিতে। চারপাশে তখন দেখি শুধুই অন্ধকার। অতঃপর আর কিছুই মনে পড়ে না। দেশ স্বাধীন হয়। কিন্তু সে স্বাধীনতার আনন্দস্বাদ আমি পাই না। পেছনের কথা মনে করার সক্ষমতা আমি হরিয়ে ফেলি। প্রায় ৪-৫ বছর আমি স্মৃতিভ্রষ্ট হয়েছিলাম।’

মুক্তিযুদ্ধের সময়ে আহত হওয়ার ঘটনা এভাবেই বলছিলেন একজন যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা। তার নাম মো. মতিউর রহমান। পিতা করিম বক্স মৃধা ও মাতা সোনাভান বিবির সাত সন্তানের মধ্যে মতিউর ছিলেন তৃতীয়। গ্রামের বাড়ি যশোরের কোতোয়ালি থানার নুরপুরে। গ্রামেই তার বেড়ে ওঠা। পড়াশোনা করেছেন মুসলিম একাডেমী স্কুলে। ১৯৭১ এ তিনি ছিলেন যশোর সিটি কলেজের ফোর্থ ইয়ারের ছাত্র।

মুক্তিযোদ্ধা মতিউরের দুরন্তপনা স্বভাব ছিল ছোটবেলা থেকেই। বন্ধুদের সঙ্গে নানা কাজে বাজি ধরা, উঁচু জামগাছের মগডাল থেকে ঝুঁকি নিয়ে জামপাড়া, দল বেঁধে সিনেমা দেখতে যাওয়া আর বন্ধু নুর মোহাম্মদের রেলে সাইকেল চালানোতেই ছিল আনন্দ।
১৯৬৯ সাল। উত্তপ্ত গোটা দেশ। মতিউর তখন যুক্ত হয় ছাত্রলীগের সঙ্গে। তাদের নেতৃত্বে ছিলেন তৎকালীন নেতা রবিউল আলম, টিপু সুলতান, আবদুল হাই প্রমুখ। মতিউর ৭ মার্চে বঙ্গবন্ধুর ভাষণ শোনেন রেডিওতে। তার কাছে সেটিই ছিল স্বাধীনতার ঘোষণা। মনে মনে তখনই ঠিক করে ফেলেন, দেশের জন্য একদিন যুদ্ধ করতে হবে।

২৫ মার্চে কোথায় ছিলেন এবং সেখানকার অবস্থা কেমন ছিল? এমন প্রশ্নে মুক্তিযোদ্ধা মতিউর রহমান বলেন, ‘যশোর শহরে সিনেমা হলে নাইট শো দেখছিলাম তখন। শো শেষ হয় সাড়ে ১২টায়। বাইরে বেরিয়ে কোথাও কোনো যানবাহন পেলাম না। আগে এমনটা কখনো হয়নি। গোটা শহর জনশূন্য। ক্যান্টনমেন্টের কাছে যেতেই দেখি আরিফপুর রোডে ব্যারাক থেকে বেরোচ্ছে পাকিস্তানি আর্মিদের গাড়িগুলো। সৈন্যরা সবাই ছিল অস্ত্র হাতে, যুদ্ধ সাজে। আমরা তখন ভয় পেয়ে যাই। ভিন্ন পথে ফিরি বাড়ি মুখে।

যশোর ক্যান্টমেন্টের পাশেই বুড়ি ভৈরব নদী। নদীর ওপারে ছিল মতিউরদের গ্রামটি। তাই যেকোনো সময় গ্রামটিতে পাকিস্তানি সেনাদের আক্রমণের ভয় ছিল। ফলে এপ্রিলের প্রথম সপ্তাহে পরিবারসহ মতিউররা আশ্রয় নেয় কনেজপুর গ্রামের এক বোনের বাড়িতে। সেখানে বন্ধু নিলু, মফিজ, আফিজুরসহ পরিকল্পনা করেন ট্রেনিংয়ের জন্য ভারতে যাওয়ার। কিন্তু ভারতে যেতে হলে টাকা লাগবে, কোথায় মিলবে সেই টাকা? সবাই মিলে বুদ্ধি আঁটে। একদিন তারা নিজের গ্রামে ফিরে যায়। এক বন্ধুর বাড়িতে মিলে গরুর গাড়ির দুটি চাকা। তা বিক্রি করে পান ৪০০ টাকা। মাত্র ৪০০ টাকা আর দেশকে মুক্ত করার স্বপ্ন নিয়ে মতিউররা এক রাতে যাত্রা করে ভারতের উদ্দেশে।

এপ্রিলের ১০ কিংবা ১২ তারিখ। রাতে যশোর সীমান্ত দিয়ে বয়রা বাজার হয়ে মতিউররা আসে বনগার টালিখোলায়। সেখানে ট্রেনিংয়ের জন্য নাম লেখানোর পর তাদের প্রথমে পেট্রাপোল এবং পরে পাঠিয়ে দেওয়া হয় বিহারের চাকুলিয়ায়। সেখানেই ক্যাম্প তৈরি করে তাদের সশস্ত্র ট্রেনিং দেওয়া হয়। ভারতীয় সেনাবাহিনীর জাকরিব রেজিমেন্টের অধীনে মতিউররা ট্রেনিং নেন ৪০ দিনের। তাঁর এফএফ নম্বর ছিল ৩২১৮।

ট্রেনিং শেষে তাদের পাঠিয়ে দেওয়া হয় বয়রা ক্যাম্পে। এটি ছিল ৮ নম্বর সেক্টরের সাবসেক্টর। দায়িত্বে ছিলেন কর্নেল হুদা। গেরিলা হিসেবে মতিউররা যুদ্ধ করেন যশোরের চৌগাছাসহ বিভিন্ন এলাকায়।
গেরিলাদের নির্দেশনা ছিল পাকিস্তানিদের যাতায়াতের রাস্তাগুলো ভেঙে দেওয়া, টেলিফোন লাইন বিকল করে দেওয়া, রাস্তায় অ্যামবুস করে পাকিস্তানি সৈন্যদের ওপর আক্রমণ করা। তাদের শিখানো পদ্ধতি ছিল হিট অ্যান্ড রান।

মুক্তিযুদ্ধের তালিকা ও স্বাধীনের পর মুক্তিযোদ্ধাদের সম্পর্কে খোলামেলাভাবে নানা কথা বলেন এই বীর মুক্তিযোদ্ধা। তার মতে, একেক সরকারের সময় একেক পদ্ধতিতে মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা তৈরি উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়। আর সে সুযোগে বেড়ে যায় তালিকায় মুক্তিযোদ্ধাদের সংখ্যা। তিনি বলেন, ‘যারা মুক্তিযোদ্ধার ট্রেনিং নিয়েছে, তাদের প্রত্যেকেরই তালিকা ছিল। আমরা তখন ৬০ টাকা হারে ভাতা পেতাম। সেটি পে-রোলে দেওয়া হতো। কে, কোন মাসের টাকা নিচ্ছি, সেটা সেখানে এট্রি করা থাকত। এই পে-রোল যদি সংরক্ষণ করা হতো, তবে প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধা নিরূপণ সহজ হতো।
এ ছাড়া প্রত্যেক সেক্টর ও সাবসেক্টরে মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা ছিল। প্রত্যেকের ছিল একটি এফএফ নম্বর। ইন্ডিয়ায় যাদের ট্রেনিং হয়েছে, তাদের তালিকাও তাদের কাছে ছিল। তাই মুক্তিযুদ্ধের পর পরই এসব রেকর্ড সংগ্রহ করে মুক্তিযোদ্ধাদের প্রকৃত তালিকা তৈরি করা যেত। খানিক মুচকি হেসে তিনি বলেন, ‘যত দিন পর্যন্ত নতুন তালিকা হবে, তত দিন পর্যন্ত মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকায় মুক্তিযোদ্ধার সংখ্যা শুধু বাড়তেই থাকবে।’

তালিকায় কেন মুক্তিযোদ্ধাদের সংখ্যা এখনো বাড়ছে? এমন প্রশ্নের উত্তরে উদাহরণ টেনে মুক্তিযোদ্ধা মতিউর বলেন, ‘ধরুন, আমার এক আত্মীয় রাজাকার। স্বাধীনের পর প্রেক্ষাপট গেছে পাল্টে। ওই আত্মীয়কে এখন আমি সাফাই দিয়ে মুক্তিযোদ্ধা বানিয়ে দিয়েছি। অথচ যুদ্ধের সময় বাবা ছিল রাজাকার, ছেলে ছিল মুক্তিযোদ্ধা। এমন পরিস্থিতিতে দেশের জন্য ওই ছেলে মেরে ফেলেছিল তার নিজের বাবাকেও।’
তিনি আফসোস করে বলেন, ‘মুক্তিযোদ্ধারা কিন্তু উচ্চবিত্ত ঘরের সন্তান ছিলেন না। অধিকাংশই ছিল খেটে খাওয়া সাধারণ পরিবারের। ফলে স্বাধীনের পর তালিকা নিয়ে এমন খেলা দেখে অনেক মুক্তিযোদ্ধাই আজ হতাশ।’

মুক্তিযোদ্ধাদের রাজনৈতিক দলে বিভক্ত হওয়া প্রসঙ্গে এই যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা বলেন, ‘মুক্তিযোদ্ধারা সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ সন্তান, এটা আমরা ধারণ করতে পারেনি। অভাবের কারণে আমাদেরও স্বভাব হয়েছে নষ্ট। মুক্তিযোদ্ধারা আজ নানা দলে বিভক্ত। স্বার্থের কারণে এখন এক মুক্তিযোদ্ধা অন্য মুক্তিযোদ্ধাকে বলছেন রাজাকার। অথচ একাত্তরে এরাই একসঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে দেশের জন্য যুদ্ধ করেছিল। এগুলো দেখলে মনটা খুবই খারাপ হয়ে যায়।’

যুদ্ধাপরাধীদের বিচার প্রসঙ্গে মতিউর বলেন, ‘আরও আগে রাজাকারদের বিচারের উদ্যোগ নিলে তাদের এতটা দম্ভ হতো না। স্বাধীন করা আমাদের এ দেশে মুজাহিদ-নিজামীদের গাড়িতে ফ্লাগ উড়ছে-ভাবলেই কষ্ট লাগে। মুক্তিযোদ্ধাদের মনে এমন কষ্ট থাকবে চিরকাল।’ মুক্তিযোদ্ধা মতিউর রহমান চাকরি করতেন মুক্তিযোদ্ধা কল্যাণ ট্রাস্টে। বর্তমানে তিনি অবসরে রয়েছেন।

এক ছেলে, এক মেয়ের জনক এই মুক্তিযোদ্ধা নিজের সন্তানদের পড়াশোনা করিয়ে সুশিক্ষিত করাকেই মূল কাজ বলে মনে করেন। যুদ্ধাহত ও অবসরকালীন ভাতা থেকে যা পান, তা দিয়েই কোনো রকমে চালিয়ে নেন নিজ পরিবার। নতুন প্রজম্মের কথা উঠতেই মতিউরের মুখে আশার আলো ফুটে ওঠে। তাদের উদ্দেশে তিনি বলেন, ‘আমাদের কাজ শেষ। অনেক ত্যাগের বিনিময়ে আমরা আজ স্বাধীন দেশের নাগরিক। বাকি কাজটা পরবর্তী প্রজম্মের। আমরা চেয়ে আছি তাদের পানে। তারা এই স্বাধীন দেশটাকে একদিন এগিয়ে নিয়ে যাবে, সকল প্রতিকূলতাকে পেছনে ফেলে। আর সেদিনই এ দেশের মুক্তিযোদ্ধারা পাবেন সত্যিকারের তৃপ্তি।

 লিখাটি প্রকাশিত হয়েছে সাপ্তাহিক কাগজে

© 2012 – 2021, https:.

এই ওয়েবসাইটটি কপিরাইট আইনে নিবন্ধিত। নিবন্ধন নং: 14864-copr । সাইটটিতে প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো তথ্য, সংবাদ, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করলে আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।

Show More

Salek Khokon

সালেক খোকনের জন্ম ঢাকায়। পৈতৃক ভিটে ঢাকার বাড্ডা থানাধীন বড় বেরাইদে। কিন্তু তাঁর শৈশব ও কৈশোর কেটেছে ঢাকার কাফরুলে। ঢাকা শহরেই বেড়ে ওঠা, শিক্ষা ও কর্মজীবন। ম্যানেজমেন্টে স্নাতকোত্তর। ছোটবেলা থেকেই ঝোঁক সংস্কৃতির প্রতি। নানা সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠনের সঙ্গে জড়িত। যুক্ত ছিলেন বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র ও থিয়েটারের সঙ্গেও। তাঁর রচিত ‘যুদ্ধদিনের গদ্য ও প্রামাণ্য’ গ্রন্থটি ২০১৫ সালে মুক্তিযুদ্ধ ভিত্তিক মৌলিক গবেষণা গ্রন্থ হিসেবে ‘কালি ও কলম’পুরস্কার লাভ করে। মুক্তিযুদ্ধ, আদিবাসী ও ভ্রমণবিষয়ক লেখায় আগ্রহ বেশি। নিয়মিত লিখছেন দেশের প্রথম সারির দৈনিক, সাপ্তাহিক, ব্লগ এবং অনলাইন পত্রিকায়। লেখার পাশাপাশি আলোকচিত্রে নানা ঘটনা তুলে আনতে ‘পাঠশালা’ ও ‘কাউন্টার ফটো’ থেকে সমাপ্ত করেছেন ফটোগ্রাফির বিশেষ কোর্স। স্বপ্ন দেখেন মুক্তিযুদ্ধ, আদিবাসী এবং দেশের কৃষ্টি নিয়ে ভিন্ন ধরনের তথ্য ও গবেষণামূলক কাজ করার। সহধর্মিণী তানিয়া আক্তার মিমি এবং দুই মেয়ে পৃথা প্রণোদনা ও আদিবা।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

Back to top button