বর্ষাটা কেবল শুরু। আকাশটাও গোমড়ামুখো। এই রোদ তো এই বৃষ্টি। দিনভর চলে রোদবৃষ্টির খেলা। ভোর হতেই ঝিরিঝিরি বৃষ্টি। তবুও বেরুতে হবে। কংকন দা অপেক্ষা করছেন প্রেসক্লাবে। তিনি ডেইলি স্টারের দিনাজপুর প্রতিনিধি।
দিনটি ছিল গত বছরের ৩০ জুন। আমাদের গন্তব্য রাজারামপুর চনকালী গ্রাম। দিনাজপুর শহর থেকে তা দশ কিলোমিটার ভেতরে। এদিনটিতে চনকালীতে আদিবাসীরা ঘটা করে আয়োজন করে একটি অনুষ্ঠানের। ভোর হতে শুরু হয় নানা আয়োজন। চলে সন্ধ্যা অব্দি। প্রাকৃতজনদের এ আয়োজন দেখতেই আমরা রওনা হই।
চনকালী গ্রামে কয়েকশ সাঁওতাল পরিবারের বাস। এটি মূলত আদিবাসী গ্রাম। এখানকার সাঁওতালদের কাছে দিনটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। তাদের ভাষায়, ‘সানতাল বিদ্রোহ দিবস’। অনেকেই বলেন, ‘সিদু ও কানহু দিবস’।
আমরা যখন পৌঁছি শ্রদ্ধানিবেদন পর্বটি তখন মাত্রই শেষ হয়েছে। নাম না জানা রঙ-বেরঙের ফুলে ঢেকে গিয়েছে গ্রামের এককোণের স্মৃতিসৌধটি। হঠাৎ মাদলের ছন্দ। সবাই জড়ো হয় একটি মাঠের চারপাশে। মাঠের ভেতরে গেড়ে রাখা হয়েছে একটি কলাগাছ। মাদলের তালে তালে মাঠে নামে বিশ পচিশজন আদিবাসী। সবার হাতে তীর-ধনুক। দূরে থাকা কলাগাছকে লক্ষ্য করে তারা তীর ছোড়ে। সঙ্গে সঙ্গে হৈ হৈ রব ওঠে। অতঃপর প্রস্তুতি চলে পরের খেলাটির।
‘এখন হবে চোখে গামছা বেঁধে লাঠির আঘাতে হাড়ি ভাঙ্গার খেলা’- বললেন বিমল মার্ডী। আয়োজকদেরই একজন তিনি। একইসঙ্গে তিনিই স্থানীয় আদিবাসী সমিতির সভাপতিও। বিমল জানালেন, কলাগাছে তীর বিদ্ধ করা এবং লাঠির আঘাতে হাড়ি ভাঙ্গার মাধ্যমে সাঁওতালরা মূলত অশুভ শক্তির প্রতীকী বিনাশ ঘটায়। তাই এ খেলা দুটি সাঁওতালদের কাছে অত্যাবশ্যকীয়।’ খেলা দেখার ফাঁকে ফাঁকে বিমলের মুখে আমরা শুনি সিদু-কানুর কথা।
সিদু, কানু, চাঁদ ও ভৈরব ছিল চার ভাই। তাঁদের জন্ম সাঁওতাল পরগনার ভাগনাদিহি গ্রামের এক দরিদ্র সাঁওতাল পরিবারে। সাঁওতালরা তখন বন কেটে জমি তৈরি করে ফসল ফলাত। আর জমিদারদের শকুনদৃষ্টি পড়ত সেই জমিতে। মহাজনদের কাছে সাঁওতালদের দেনার জের মিটত না ১০ গুণ পরিশোধের পরও। তাই সপরিবারে মহাজনের বাড়িতে গোলামি খাটতে হতো সাঁওতালদের।সাঁওতালরা আদালত আর পুলিশ থেকেও কোনও সাহায্য পেত না। ফলে জমিদার, মহাজন আর সরকারকে তারা শত্রু মনে করত। একবার সাতকাঠিয়া গ্রামে জনসমক্ষে মহেশ নামের এক দারোগা কয়েকজন সাঁওতালকে গাছে ঝুলিয়ে র্নিদয়ভাবে চাবুক মারে। চোখের সামনে এসব অত্যাচার দেখে ঠিক থাকতে পারে না সিদু-কানু। তাই সিদু-কানু ডাক দেয় আশপাশের সাঁওতালদের। সবার কাছে পাঠায় পাতাসমেত ছোট শালের ডাল। তাঁদের কাছে এটি ‘একতার প্রতীক’। এভাবে ডাকার রীতিটি ছিল সাঁওতালদের ঐতিহ্য।
খানিক থেমে বিমল আবার বলতে থাকেন।
১৮৫৫ খ্রিস্টাব্দের ৩০ জুন। সিদু-কানুর ডাকে ভাগনাদিহি গ্রামে জড়ো হয় প্রায় ১০ হাজার সাঁওতাল কৃষক। সেদিন সিদু-কানু সবাইকে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার ডাক দেন। সিদু-কানুর বক্তব্যে সাঁওতালরা গর্জে ওঠে। বিদ্রোহী কণ্ঠে সবাই স্লোগান দেয়- ‘জমি চাই, মুক্তি চাই’। সাঁওতালদের শক্তি দেখে জমিদার, মহাজন ও ঠকবাজ বেপারীরা পালাতে থাকে। একসময় বিদ্রোহীরা ডাক ও রেল বন্ধ করে দেয়। এভাবে বিদ্রোহ ছড়িয়ে পড়ে বীরভূম, ভাগলপুর ও মুর্শিদাবাদ জেলায়। সাঁওতালদের বিদ্রোহ দমাতে বহরমপুর থেকে সেনাদল আসে মুর্শিদাবাদে। সেখানকার জেলা শাসক টুগুডে ১৫ জুলাই মহেশপুরে বিদ্রোহীদের সাথে সংঘর্ষে লিপ্ত হয়। এই সংর্ঘষে বিদ্রোহীরা পরাস্ত হয়। ১০ নভেম্বর সামরিক আইন জারি করে জেনারেল লয়েড ও জেনারেল বার্ড ১৪ হাজার সৈন্য নিয়ে বিদ্রোহ-এলাকা ঘিরে ফেলে। ৩১ ডিসেম্বরের মধ্যে অন্তত ১০ হাজার সাঁওতালকে হত্যা করে তারা বিদ্রোহ পুরোপুরি দমন করে।
সিদু-কানুর কী হয়েছিল ? উত্তরে দীর্ঘ নিঃশ্বাস ছেড়ে বিমল বলেন, ‘ নভেম্বরের শেষ ভাগে জামতাড়া এলাকা থেকে বন্দি হয় কানু। সিদু ধরা পড়ে তার আগেই ঘাটিয়ারিতে। পরে তাকে ভাগনাদিহি গ্রামে নিয়ে হত্যা করা হয়। কানুর বিচার হয় আদালতে। বিচারে তাঁকেও হত্যা করা হয় গুলি করে।
বিদ্রোহে সাঁওতালরা কিভাবে জয়ী হলো ? উত্তরে বিমল বলেন, বিদ্রোহের পর ইংরেজ সরকার সাঁওতালদের ক্ষুদ্র জাতি হিসেবে স্বীকৃতি দেয়। তাদের বসবাসের জন্য সাঁওতাল পরগনা নামের একটি নতুন জেলা গঠন করে। মহাজনদের দেওয়া সব ঋণ বাতিল হয়। সাঁওতালরা জমির মালিকানা অর্জন করে। শুধু তাই নয়, সাঁওতাল বিদ্রোহ বাংলার ও ভারতের কৃষক-সংগ্রামের ঐতিহ্যকে গৌরবান্বিত করেছিল। বিদ্রোহীদের বীরত্বের কাহিনি পরবর্তীকালের কৃষক সংগ্রামে ও সিপাহি বিদ্রোহকেও প্রেরণা জুগিয়েছিল।
আমাদের কথা থামে মাদলের শব্দে। এরই মধ্যে আকাশের মেঘ কেটে গেছে। উঠেছে ঝলমলে সূর্য। মাঠের মধ্যে দল বেঁধে নাচছে একদল আদিবাসী নারী। মাদলের তালে তালে দোলে তাদের সমবেত কণ্ঠগুলো। কংকন দা তখন ব্যস্ত হয়ে পড়েন ছবি তোলায়। আজো অন্যায়, অত্যাচার আর নানামুখি বৈষম্যের বিরুদ্ধে সাঁওতালদের রুখে দাঁড়ানোর প্রাণশক্তি ওই সিদু-কানু। সাঁওতালরা বিশ্বাস করে, তাদের সত্ত্বায় সিদু-কানু বারবার ফিরে আসে। তাই এদিনে কন্ঠ আকাশে তুলে সাঁওতালরা গান ধরে: “নুসাসাবোন, নওয়ারাবোন চেলে হঁ বাকো তেঙ্গোন, খাঁটি গেবোন হুলগেয়া হো খাঁটি গেবোন হুলগেয়া হো” অর্থাৎ “আমরা বাঁচব, আমরা উঠব, কেউ আমাদের পাশে দাঁড়াবে না আমরা সত্যি বিদ্রোহ করব আমরা সত্যি বিদ্রোহ করব।”
লিখাটি প্রকাশিত হয়েছে বাংলানিউজ২৪.কমে ২ জুলাই ২০১২
© 2012 – 2018, https:.